ঐতিহাসিক মে দিবস

মাহবুবুর রহমান সেলিম :
১৮৮৬ সালের পহেলা মে আমেরিকার শিল্পনগরী শিকাগো শহরের হে মার্কেটে সংঘটিত শ্রমিকদের বীরোচিত আত্মত্যাগের কাহিনী,রক্তের কালিতে লেখা ইতিহাস। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন তের হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে কর্মবিরতি ঘোষণা দিয়ে জড় হন ঐতিহাসিক হে মার্কেট স্কোয়ারে, সেখানে তিন লাখেরও বেশি শ্রমিক উপস্থিত ছিলেন এবং ক্রমান্বয়ে দুইদিনের মধ্যে এর সংখ্যা দশ লাখ অতিক্রম করেছিল। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি দেওয়া বিশেষ করে, আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে উদ্ভূত দৃঢ়চেতা আপোষহীন শ্রমিকেরা এই ঐতিহাসিক দিনে একত্রিত হয়েছিলেন শিকাগোর ম্যাককরমিক ওয়াক্স কারখানার সামনে। আকাশে হালকা বৃষ্টি দিনের আলো খসে পড়েছে কিছুক্ষণ আগে, এই ঐতিহাসিক সমাবেশের প্রধান বক্তা ছিলেন অগাস্ট স্পাইস। তার বক্তব্যের সময় সমাবেশে আগতদের পিছু হটাতে হাজির ছিল দাঙ্গা পুলিশের বিশাল দল। মুষ্টিবদ্ধ হাজারো মেহনতি মানুষের গগনভেদী হুংকার আট ঘন্টা কাজের দাবিতে তারা ছিল সেদিন অটল। এই ঐতিহাসিক সমাবেশে পুলিশ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে ধেয়ে আসার সময় কেউ একজন পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ে, যদিও হামলাকারী পরিচয় জানা যায়নি, তবে পরক্ষণই পুলিশ বেপরোয়া হয়ে শ্রমিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে তার ফলশ্রুতিতে অনেক মেহনতি জনতার রক্ত ঝরে ঐতিহাসিক এই রাজপথে। এরপরও থেমে নেই, শাসক গোষ্ঠী উস্কানিতে পরবর্তীতে পুলিশ মামলা রুজু করে মেহনতী মানুষের বিরুদ্ধে। শুরু হয় প্রহসনমূলক বিচার, ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসির মঞ্চে ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর একদিন আগে লুই কিং নামে এক মেহনতি শ্রমিক কারাগারের অভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন। অপর একজন অস্ফার নীবে নামক এক মেহনতি জনতার দেওয়া হয় পনের বছরের কারাদন্ড। মেহনতী মানুষের ইতিহাসে এই ঘটনা লেখা থাকবে রক্তের কালিতে। মনে আছে সেই দিন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে মেহনতি জনতার উদ্দেশ্যে আগস্ট স্পিজ বলেছিলেন The day will come when our silent will be more powerful than the voice you are throwing today .আজ আমাদের এই ফাঁসি, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক বেশি শক্তিশালী হবে।
ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে আ্যডল্ফ ফিশার উদাত্ত্ব কন্ঠে বলেছিলেন This is happiest moment of my life . এর পর ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আলবার্ট পারসন্স ও বলেছিলেন Let the Voices of people be heard. এই বাক্যটি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মৃত্যর কোলে ঢলে পড়ল এই আত্ত্বত্যগী মহান বিপ্লবী।
সবচাইতে করুন যা হলো এই মিথ্যা বিচার শেষ পর্যন্ত মিথ্যায় পরিণত হল ২৬ শে জুন ১৮৯৩ সালে ইলিনয়ের গভর্নর জন পিটার অটগেল্ড এর পক্ষ থেকে জানানো হলো মিথ্যা ছিল এই বিচার। পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হলো। ইতিহাস তার রায় পেল।
১৮৮৯ সালে সালে ঐতিহাসিক ফরাসী বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে থেকে১৮৯০ সালে, শিকাগোর হে মার্কেটের ঘটনার জোড়ালো নিন্দা করে, আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের শোক পালনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় তখন এই প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাবিন যা ১৮৯১সালে আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় কংগ্রেসে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ১৯০৪ সালে আমষ্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সমাজতন্ত্রিদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে একটি ঐতিহাসিক প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই প্রস্তাবে ছিল, দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পহেলা মে মিছিল শোভাযাত্রা আয়োজন। মুষ্টিবদ্ধ হাজারও মেহনতি মানুষের গগনভেদী হুংকার আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে অটল। এব্যাপারে সকল সমাজবাদী প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল এবং ট্রেড ইউনিয়নকে আহ্বান জানানো হয়। এই সম্মেলনে কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের সম্ভাবনা না থাকলেও বিশ্বব্যাপী সকল শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১লা তারিখে বাধ্যতামূলক কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিশ্বের অনেক দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো পহেলা মে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের জন্য দাবি জানায়। এবং অনেক দেশেই তা কার্যকরী হয়।
তাই আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস মে দিবস।
শৃংখল ছাড়া প্রলেতারিয়েতদের হারাবার আর কিছুই নেই
১৮৮৬ সালের এই দিনে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারে শ্রমিকদের যে বিরচিত অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে এই আত্মত্যাগের দিনটিকে সামনে রেখেই সারাবিশ্বে মে দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নন। পহেলা মে সরকারি ছুটির দিন। মে দিবসের প্রতিপাদ্য শ্রমিক-মালিক গড়বো দেশ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। শ্রমিকদের সার্বিক অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ন্যায্য মজুরি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ আন্তরিকভাবে নিশ্চিত করতে সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান। মে দিবসের সাথে শ্রমজীবি মেহনতী মানুষের স্বার্থ কল্যাণ ও অধিকার উপযুক্ত মজুরি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এবং কালজয়ী ইতিহাস রচনায় অপরিশীম গৌরবময় দিবস।আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতিশ্রুতি মেহনতী মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে শোষণমুক্ত আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। শ্রমিকদের সর্বাত্মক শুরেখ্যার লখ্যে শ্রম আইন সংশোধন এবং যুগপযোগী শ্রম বিধিমালা প্রনয়ন এবং শ্রমিক কল্ল্যান ফাউন্ডেশন গঠন। শোষণ-বঞ্চনার পূর্ণাঙ্গ অবসানের লক্ষ্যে কাজ করা। করনার করাল গ্রাসে বিশ্বের সাথে সাথে বাংলাদেশেও জর্জরিত। সেই মুহূর্তে এই করুন প্রেক্ষাপট বিচার করে মেহনতী মানুষের কল্যাণে সরকার এবং মালিক শ্রেণীর আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। শিশু শ্রম এবং তাদেরকে কম মজুরিতে খাটিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে সকলকে থাকতে হবে সোচ্চার এবং আপষহীন।
আমরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই অর্থাৎ ১৮৬০সালের দিকে শ্রমিকরা তাদের বরাদ্দকৃত মজুরি না কমিয়ে পূর্ণ দিবসে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে সম্পূর্ণ অটল থাকে।এবং একটি গঠনমূলক প্রস্তাব আকারে কাজের সময় নির্ধারণের দাবি জানায়। তারই প্রেক্ষাপটে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার নামে একটি শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়।
মে দিবসের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অবমুক্ত শৃংখল শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের বদ্ধপরিকর মেহেনতি জনতা। জয় হোক মেহনতী জনতার।
দুনিয়ার মজদুর এক হও।

শেয়ার করুন

Leave a Reply