করেনা আমাকে লিখতে বসালো : ভ্রমণ কাহিনী

পূর্ব প্রকাশের পর

অ্যাডভোকেট জেসমিন সুলতানা ::

তিন দিন সিমলা কাটিয়ে সকাল আটটায় আমরা ভ্রমন পিয়াসীদের অভিযাত্রা কুল্লু মানালীর উদ্দেশ্যে। পাহাড়ে ঘেরা সৌন্দর্যের রাণী সিমলায় সকালের সূর্যটা একটু দেরিতেই দেখা দেয়। তাই আমরা সকাল আটটায় সবাই গাড়িতে উঠে গেলাম।
সিমলা থেকে মানালী যাওয়ার রাস্তা খুব সুন্দর সাজানো। আমরা গাড়িতে যাচ্ছি আর প্রাণ ভরে রাস্তার দু’ পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি।
সাড়ে ৯টার দিকে ক্ষুধার দেবী জানান দিলো আমরা সকালে নাস্তা খেয়ে আসিনি। তবে ছয়জনের বাংলাদেশ থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হরেক রকমের ড্রাই মিষ্টি, বিস্কুট, চানাচুর, ড্রাই ফ্রুটস, মুড়ি, ভাজাচিড়ে, ড্যানো গুড়ো দুধ, চা, ফ্লাক্স, গরম পানি, ফাস্ট এইডবক্স, সুই, সুতা, দড়ি, কেচি, কাঁচি, ছুরি সবই আমাদের সাথে।
তারপরও আমরা একটি ধাবায় নেমে গেলাম। সবাই মিলে রুটি, আন্ডা, সবজী, মুরগী ফ্রাই, চা খেয়ে নিলাম। তারপর শুরু চলা। চলছি অজানার পথে। কখন শেষ হবে জানিনা। মনে মনে গেয়ে চললাম।
“এ পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?”


অপূর্ব সব দৃশ্য। দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের কাছাকাছি পাহাড়। ওই দূর আকাশের কাছাকাছি মানব বসতি।
আমাদের গাড়ি পাহাড়ের কোল ঘেষে উপরের দিকে উঠছে তো উঠছে। মনে মনে ভয় পাচ্ছি। যদি গাড়িটির ব্রেক ফেইল করে বা কোন ত্রুটি দেখা দেয় বা এক্সিডেন্ট করি। কেউ আমাদের বাঁচাতে পারবেনা, কেউ বাঁচাতে আসবে না, এখানে খাদে পরে গেলে কেউ বাঁচেনা
অজানা আশংকায় আমার বুক ধুক ধুক করতে লাগলো। আমাদের সহযাত্রী বন্ধু একজনের পাহাড়ের চূড়ায় ভয় লাগার ফোবিয়া। দেখলাম সে জড়োসরো হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি গাড়ি সাইডে থামিয়ে বন্ধুকে মাঝে বসিয়ে অন্য পারিবারিক গল্পে মশগুল হয়ে গেলাম। এভাবে যখন বেলা আড়াইটা আমরা সমতল ভূমিতে নেমে এলাম।
এদিকে আড়াইটা বাজে দুপুরের খাবার সময় আমরা একটি হোটেল নেমে ফ্রেস হয়ে মজার মজার ইন্ডিয়ান ফুড যার যা পছন্দ হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানী, দোসা, ইদলী, রাজ কচুরী, ছোলা ভাটুরা, দইবড়া, সবজী, ভাত যার যা পছন্দ খেয়ে নিলাম। আর যার খাবার বেশী সুস্বাদু হয়েছে সেটা শেয়ার করে খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। অসাধারন সব দৃশ্যাবলী শুধুই প্রাণ ভরে দেখে নেয়া, চোখের তৃষ্ণা মেটানো।
কিছুদূর যাওয়া পর রাস্তার পাশে সারি সারি ফলের দোকান দেখে নেমে পরলাম। সুস্বাদু কমলা, তাজা আপেল, কলা, জাফরান, কাজু, পেস্তা, ফিগ, তবক, কিনে গাড়িতে বসে একটা কমলা ছোলার পর দেখলাম কমলার মৌ, মৌ গন্ধে গাড়ির ভিতর কমলাময়। আর তরতাজা আপেলের মজাই আলাদা। বাংলাদেশে ফরমালিনযুক্ত ফল খেতে খেতে আমরা ফলের আসল স্বাদ, গন্ধ আজ ভুলতে বসেছি। আমার ঘরের মানুষটির ধারণা আমি মরে গেলে লাশ পঁচবেনা। কেননা শত বারন সত্বেও আমি ফরমালিনযুক্ত ফল খেয়ে চলেছি।
একসময় মান্ডি প্রবেশ করলাম। এরপর কুল্লু শহর গাড়িতে বসেই দেখলাম। কুল্লু পরেই অপূর্ব বয়ে যাওয়া বিয়াস নদী। কুল্লুতে এসে গাড়ি থামিয়ে ভেড়ার লোমের শাল, সুন্দর গরম কাপড়, কারুকাজ করা ওয়ালমেট কিনে গাড়িতে চলছি আর শুনছি নির্ঝনীর ঐক্যতান। একদিকে বিয়াসের স্রোতধারা অন্যদিকে পাহাড় যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
বিয়াসের স্রোতধারা আর প্রবহমানতা এতোই মুগ্ধ করছিলো যে একসময় গাড়ি থামিয়ে নেমে গেলাম বিয়াস নদীতে। পা ভেজালাম, পা থেকে মাথা অবধি সারা শরীর শীতল তায় ভরে দিলো। সারাদিনের ভ্রমনের ক্লান্তি বিয়াসের পানি দূর করে দিলো। কি এক প্রশান্তি! এক অনাবিল শান্তি!
নদীতে সবাই রাফটিং-এ করছে। ইচ্ছে হলো নদীতে রাফটিং করি। কিন্তু সাহস হলোনা। নদীর স্রোতধারা স্বাভাবিক নয়। অনেক ভয়ের। তবে আমি মেঘনা পাড়ের মেয়ে বিয়াস নদীর স্রোতধারা আমার মেঘনার কাছে কিছুই না।
এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। একদিকে নদী, পাহাড়ী ঝর্না, আরেক দিকে পাহাড়ের কোল ঘেসে কখনো বা পাহাড়ের পেটের ভিতর ঢুকে আমাদের চলা। একসময় পাহাড়ে কেটে তৈরী করা একটি ট্যানেল অতিক্রম করলাম। প্রকৃতি এতো সুন্দর করে সাজতে পারে- না দেখে কেউ এ সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারবে না।
মার্চ মাস বৃষ্টিও হয় কথিত আছে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ী ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। কখনো বা বড় পাথরের নুড়ি রাস্তায় পরে গেলে সরাতে সময় নেয়। তাই ঝির ঝির বৃষ্টি দেখে অজানা এক ভয় আঁকড়ে ধরছিল।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, পাহাড়ের কোল ঘেসে সরু রাস্তা। কিন্তু সারা রাস্তায় একজন ড্রাইভারকে একটি হর্ন বাজাতে দেখেনি। এমনকি ভয়ংকর সব বাঁকগুলোতেও নয়।
মনে হলো
“আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় অই
পাহাড়ের ঝর্না আমি, ঐ পাহাড়ের ঝর্না
আমি উধাও হয়ে বই গো, উধাও হয়ে বই
পাহাড় ঘুমায় অই”।
এদিকে রাত নেমে এসেছে উঁচু পাহাড়ে ঘর-বাড়িগুলোতে নিয়ন বাতি জ্বলছে। দূর থেকে মনে হলো বুঝি জোনাকীরা মিটি মিটি জ্বলছে আর নিভছে।
রাত দশটায় আমরা প্রবেশ করলাম স্বপ্নের শহর মানালির একটি হোটেলে। বনবনানীর ছায়া ঘেরা নিরিবিলি একটি হোটেল, বেশ সাজানো-গোছানো।
রাতে হোটেলে খাবার খেয়ে ক্লান্ত অবসন্ন সবাই ঘুমিয়ে পরলাম।
প্রাত্যাহিক সকাল ৫টায় ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস। আজো ব্যত্যয় ঘটলোনা। আমি সকালে ফজর নামাজ আদায়ের পর জানালার গ্লাস সরিয়ে দূরে দেখলাম এক বিশাল পাহাড়। পাহাড়ের উপর মেঘ জমে আছে আর ভোরের সূর্যের আলো মেঘের উপর সোনালী আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। এক অপরূপ সম্মোহনী সৌন্দর্য্য। মনে হলো একি দেখছি- নিজের চোখকেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। এতো দূর থেকে দেখা হিমালয়ের চূড়া। হোটেলে ফোন করে নিশ্চিত হলাম। সম্ভবত ভারতের এক শেষ প্রান্ত মানালী।


সকালের নাস্তা শেষ করে আমরা রেডি হয়ে চললাম বরফ দর্শনে। একসময় গাড়িটা সোজা হয়ে উঠি গেল এতো উঁচু খাঁড়া পাহাড় দার্জিলিংয়ে দেখেছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম মনে। কিন্তু প্রকাশ করিনি।এক সময় আস্তে নেমে গেলাম সমতলে। বরফ আর বরফ বরফের রাজ্য। গাছপালা সব বরফে আচ্ছন্ন। ঢুকার মুখে ২৫০ রুপী দিয়ে বরফে চলার পোশাক, বুট, টুপি ভাড়া করে নিলাম। যদিও গা ঘিন ঘিন করছিল পোশাকগুলো গায়ে জড়াতে। পোশাক পরে নিজকে তেনজিং হিলারি মনে হচ্ছিল।


আমাদের গাড়ি বরফের উপর দিয়ে চলছে। উদ্দেশ্যে, আমরা যাবো রোথাং পাস। কিছু দূর যাওয়ার পর গাড়ি আটকে দেয়া হলো। প্রচন্ড বরফ পড়েছে। তাই আর উপরে যাওয়া যাবেনা।

গাড়ি থেকে নেমে এক অনাবিল আনন্দে মেতে উঠলো সবাই। ভুলেই গেলাম আমাদের বয়স হয়েছে। মেতে উঠলাম বরফ খেলায়। ফিরে গেলাম সেই আমাদের দূরন্ত শৈশবে, পুরনো পৃথিবীতে।


বরফ নিয়ে বল খেলা, বরফে গড়ানো, পুতুল, বিড়াল, কুকুর ঘর বানানো কিছুই বাদ হলোনা সাথে ফটোসেশান। মনে হলো আর কখনোই এতো দীর্ঘ ভ্রমণে মানালী আসা সম্ভব নয়। তাই মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে মানালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম।


এরপর আমরা চলে এলাম সোলাং ভ্যালী। এখানে পাহাড় ও বরফের মাঝে ছোট ছোট দোকান সেখানে চা, মম, চওমিন, নুডলস, ভাত, ডাল, ডিম সবজী- সব আছে। কিছুদূর যেয়ে দেখি মানালির শিল্পীরা তাদের স্হানীয় সংগীত পরিবেশন করছে নাচ, গান সাথে। স্থানীয়দের পোশাক পড়ে ছবি ওঠানোর জন্য একদল পিছনে আঠার মতো লেগে রইলো। অগত্যা রাজী হয়ে ওদের পোশাক পরে নানা রঙ্গে-ঢংগে ছবি উঠালাম। দুপুর বেলা রেস্টুরেন্টে গরম গরম খাবার খেয়ে বরফের খেলা সাঙ্গ করে গাড়িতে ওঠার জন্য হেঁটে আসছি। এমন সময় মদ্যপ এক গাড়ি চালক আমার ডান পায়ের আঙ্গুলের উপরদিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলো। বুট জুতা, বরফে শক্ত হয়েছিল বলে আঙ্গুলগুলো ভেঙ্গে যায়নি। তবে হোটেলে এসে বুঝলাম ব্যথা পেয়েছি প্রচন্ড। ব্যান্ডেজ করলাম বাসায়। আমার ডাক্তার ভাইকে ফোন করে ওষুধ নিলাম। আজ ভাই নেই। ডাঃ বন্ধু নেই। সবাই হারিয়ে গেল এতো তাড়াহুড়া কেন বুঝলাম না।
পরের দিন সবাই স্থানীয় মার্কেট, মন্দির ও দর্শনীয় স্থানগুলোতে গেলো। আমি পরে রইলাম নির্জন হোটেলে। তবে সাথী বন্ধুদের যত্নের কমতি ছিলোনা।
দু’দিন থেকে আমরা সকাল আটটায় রওয়ানা হয়ে রাত একটায় পৌঁছালাম দিল্লীতে। পথে চন্ডিগড়ের আঁকা বাকা পাহাড়ী রাস্তা, পান্জাবের খাবার, হরিয়ানার কুলফি খেতে খেতে কোন ভ্রমনের ক্লান্তি বোধ করিনি। তবে আমার পায়ের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। দিল্লীতে দু’দিন থেকে কোলকাতা হয়ে ঢাকা। বেশ ভালো মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ।
ভাবিনি এভাবে লিখবো তাহলে সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলো, ইতিহাস ঐতিহ্য সমূহ আরো সঠিকভাবে উপস্হাপনা করা যেতো।
করোনা থেকে নিজকে, নিজের মনকে, বন্ধুদের একটু হতাশা ও বিষাদের ঘর থেকে বের করার জন্য এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
ভালো থাকি সবাই।

লেখক : অ্যাডভোকেট জেসমিন সুলতানা, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
সভাপতি : ঢাকাস্থ চাঁদপুর জেলা আইনজীবী কল্যাণ সমিতি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply