করোনামুক্ত হয়ে হাজীগঞ্জ ইউএনও বৈশাখী বড়ুয়ার আবেগঘন স্ট্যাটাস, হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন আরও ৭ দিন

ইব্রাহীম রনি :
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের ইউএনও বৈশাখী বড়ুয়ার দ্বিতীয় রিপোর্টও নেগেটিভ এসেছে। এর ফলে তিনি এখন করোনামুক্ত।
গত ২৯ এপ্রিল এই কর্মকর্তার করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর সংশয়ের ভিত্তিতে ওই দিনই আবারও পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। সাত দিনের মাথায় ৬ মে বুধবার তার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। দ্বিতীয় রিপোর্ট আসার আগের দিনই আবারও নমুনা দেন। যার রিপোর্ট নেগেটিভ আসে ৯ মে শনিবার।

এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, ৯ মে ওনার দ্বিতীয় রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তবে আক্রান্ত হওয়ার পর ওনার ১৪ দিন পূর্ণ হবে আগামীকাল ১০ মে। তাই আমরা তাকে অফিসিয়ালি সুস্থ ঘোষণা করবো রোববার। তিনি বলেন, দ্বিতীয় রিপোর্ট নেগেটিভ আসলেও তিনি আরও ৭ দিন হোমকোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। এরপর তিনি অফিসিয়াল কাজে অংশ নেবেন।

এদিকে পরপর দু’টি রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে এ সম্পর্ক আবেগঘন পূর্বাপর বিস্তারিত লিখেছেন তিনি।

তিনি লিখেছেন, ২৪এপ্রিল থেকে শরীরটা খারাপ লাগছিলো। কয়েকদিন ধরে খুব হাচি, মাথাব্যাথা, হালকা জ্বর। রসুন, কালিজিরা, লেবু গরম পানি সারা বছরই খাই। তবু বাচ্চাটার কাছে যেতে ভয় হয়। ২৭এ প্রিল অনেক ভেবেচিন্তে, জেলা প্রশাসক স্যারের সাথে কথা বলে সেম্পল দিলাম। কয়েকদিন আগে ঘন ঘন বের হয়েছি অফিসে, ত্রাণ বিতরণে ,মোবাইল কোর্টে। যদিও সহকারী কমিশনার (ভূমি) দায়িত্বে ছিল মোবাইল কোর্টের জন্য। ভাবতাম, ছোট বোনটা একাই খেটে যাবে? ওর কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবনা। তাই নিজেও অফিসের অন্যান্য কাজ শেষ করে বের হই। করোনা সংক্রমন প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ, কোয়ারেন্টিন ও লকডাউন নিশ্চিতকরণ, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে নিয়মিত বাজার মনিটরিং, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, ত্রাণ বিতরণ সমন্বয়করণ ও তদারকি, ফোন/মেসেজের মাধ্যমে ত্রাণ পৌছানো, কন্ট্রোল রুম মনিটরিং সবকিছুই করছিলাম অবাধে। কখনো ভয় পাইনি। ভাবতাম, কিছু হলে আগে আমার হোক। আমার সহকর্মী, আমার অফিসে প্রিয় কর্মচারীরা যারা আমার এক একটি অঙ্গ, তারা ভালো থাক। তাদেরকে সবসময় সাহস দিয়েছি, করোনাকে ভয় করে আমরা কখনো কাজ থেকে দূরে থাকব না, রোগ/দুঃখ/মৃত্যু থেকে কেউ পালাতে পারে না।
এভাবেই মান্যবর জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজের মধ্য দিয়েই কাটছিলো করোনা মোকাবিলার দিনগুলো। স্বপ্নেও কল্পনা করিনি আমার করোনা পজিটিভ হবে। আমার সকল ট্যাগ অফিসার, ইউপি চেয়ারম্যান, সচিব, পরিষদের অন্যান্য কর্মচারী, গ্রাম পুলিশ দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। ভাবলাম, সকলের জন্য সুরক্ষা পোশাক দরকার। যাতে যারা কাজ করছে তারা যেন নিজেদের সুরক্ষিত মনে করে আত্মবিশ্বাসের সাথে কাজ করতে পারে। ২৮ তারিখ রাতে সুরক্ষা পোশাক পৌছাল।
(বি.দ্র. ২৯তারিখে আমি সুস্থ বোধ করছিলাম)
২৯এপ্রিল। সকলকে সুরক্ষা পোশাক দেয়া হল। হঠাৎ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফোন করলেন, পৌরসভা এলাকায় ১ জন করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। পৌরসভার মেয়র মহোদয়, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ওয়ার্ড কাউন্সিলর বারবার ফোন দিচ্ছেন। লকডাউন করার জন্য ঐস্থানে গেলাম। সকলের সহযোগিতায় লকডাউন করলাম। এরপর অফিসে উঠলাম বাকি কাজ শেষ করার জন্য। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) স্যার ফোন দিয়ে বললেন- বৈশাখী, তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় যাও, তোমার পজিটিভ এসেছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কিভাবে সম্ভব? কখন হলো? পা চলছিলো না। অনেক কষ্টে হেটে অফিস থেকে বাসায় ফিরলাম। পিছন থেকে কানে ভেসে আসছে, “স্যার, অনেকগুলো সাইন বাকি”, “স্যার, ফাইল ছিলো”, “স্যার, একটা সিদ্ধান্ত দরকার”, “স্যার, গাড়িতে উঠবেন না?” কিচ্ছু শুনতে পেলাম না। আমার সিএ নাসির এসে আমার বাসায় একটি রুম খালি করে দিতে বলল। সাথে সাথে ঐ রুমে ঢুকে গেলাম। বাচ্চাটা অসম্ভব কান্নাকাটি করছিলো, মা কেন তাকে না দেখে রুমে ঢুকে গেল। ঐ মুহূর্তে আমার ১টাই চিন্তা আমার বাচ্চাটা ঠিক আছে তো??
প্রায় কয়েক ঘন্টা মাথা কাজ করেনি। সিনিয়র স্যারগণ,জেলা প্রশাসক স্যার, সহকর্মীরা ফোন করে সাহস দিচ্ছিলেন। চিন্তা করলাম, জীবনে হারতে শিখিনি, হারিনি কোনদিন, এখনও হারব না। সকলের সাহসে মনোবল বাড়ালাম, একা থাকা শুরু করলাম ঐ মূহুর্ত থেকে। সকালে খালিপেটে রসুন, কালিজিরা খেয়ে লেবু, মধু পানি, দিনে ৬বার গরম পানির ভাপ, গার্গল, আদা, লেবু, লং দিয়ে গরম পানি খাওয়া, গরম পানি দিয়ে গোসল, ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার খাওয়া, ডাক্তারের দেয়া ঔষধ খাওয়া, সর্বসময় সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ। এভাবেই কাটছে দিনগুলো। প্রিয়জনদের দূরে রেখে আবদ্ধ জীবন যে কতটা কষ্টকর হতে পারে তা বুঝেছি এই সময়ে।
এখন আমার ২টি রিপোর্টে করোনা নেগেটিভ এসেছে। সিভিল সার্জন, চাঁদপুর ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার পরামর্শ এবং WHO র গাইডলাইন অনুযায়ী আগামী ১১মে পর্যন্ত আইসোলেশনে থাকতে হবে, আরো পরবর্তী ৭ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
এই পুরো সময়ে মাননীয় সংসদ সদস্য মেজর(অবঃ) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম স্যার, স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ স্যার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ কামাল স্যার, জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন স্যার, BEZAর নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী স্যার,মহামান্য রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব সম্পদ বড়ুয়া স্যার,মান্যবর বিভাগীয় কমিশনার জনাব এবিএম আজাদ স্যার, মাননীয় জেলা প্রশাসক জনাব মাজেদুর রহমান খান স্যার, সাবেক শ্রদ্ধেয় জেলা প্রশাসক জনাব আব্দুস সবুর মন্ডল স্যার, এডিসি স্যারগণ, নিজের বোনতুল্য কানিজ ফাতেমা স্যার, আরো অনেক পরম শ্রদ্ধেয় সিনিয়র স্যারগণ, সহকর্মীগণ,ব্যাচমেটগণ, আত্মীয়-স্বজন,
বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ও সিনিয়র জুনিয়র ভাই-বোনেরা, উপজেলার সকল সহকর্মীবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি,রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আরো অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, হাজীগঞ্জের সকল স্তরের মানুষ আমাকে যেভাবে সাহস যুগিয়েছেন এবং ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা সত্যিই আমার চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে।
সকলে আমাকে প্রতিনিয়ত বুঝতে বাধ্য করিয়েছেন, আমি একা নই, তারা সকলে আমার পাশে আছেন।
এই ভালোবাসা, দোয়া, আশীর্বাদ এবং সাহস আমাকে চলার পথে শক্তি যোগাবে, কর্মে উদ্যম যোগাবে এবং ভবিষ্যতের প্রেরণা যোগাবে।
সকলের প্রতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
একদিন করোনামুক্ত হবে এই পৃথিবী, আমরা আবার খোলা বাতাসে বুকভরে নিঃশ্বাস নিবো, বাতাবিলেবুর গন্ধ নিবো..

শেয়ার করুন

Leave a Reply