চাঁদপুরে চা শ্রমিকদের স্মরণে ভাস্কর্য বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হবে : শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি
নিজস্ব প্রতিবেদক :
২০ মে ঐতিহাসিক ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন এবং চাঁদপুরে চা শ্রমিক গণহত্যার শতবর্ষ উপলক্ষে সাহিত্য মঞ্চ এবং বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদের যৌথ আয়োজনে অনলাইনে ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০ মে বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি।
তরুণ লেখক ও সাহিত্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আশিক বিন রহিমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান, চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. জিল্লুর রহমান জুয়েল, চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ ড. সরকার আব্দুল মান্নান, লেখক ও অনুবাদক মাইনুল ইসলাম মানিক, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের উপদেষ্টা মোহন রবিদাস।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি বলেন, আজ ইতিহাসের একটি কালো দিন। এই দিনে মল্লুক চলো আন্দোলনের ডাক দিয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে অসংখ্য চা শ্রমিক চাঁদপুর স্টিমারঘাটে এসেছিলো। এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এই স্থানটিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও মুক্তিযোদ্ধাদেরর হত্যা করে একই কায়দায় লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হতো। আজকের এই দিনে আমি সকল নিহত চা শ্রমিকদের শ্রদ্ধা জানাই।
তিনি বলেন, চাঁদপুরের যে স্থানে মুল্লুকে চলো আন্দোলনে চা শ্রমিকদের হত্যা করা হয়েছিল যেখানে স্থানীয় প্রশাসন ও পৌরসভাকে সাথে নিয়ে একটি ভাস্কর্য/স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কর হবে। এ বিষয়ে দ্রুতই চাঁদপুরের গুণিজন, বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাসেম খান, মুনিরুল ইসলামসহ দেশের প্রথিতযশা ভাস্কর্য শিল্পীদের সাথে পরামর্শ করে এর নকশা করা হবে। এতো বড় একটি ঘটনা নিয়ে চাঁদপুরে বিগত একশ বছরে তেমন কোন কাজ না হওয়ায় তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেন এবং অনুষ্ঠান চালাকালীন সময়েই চা শ্রমিকদের আন্দোলনের এই বিষয়টি নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য প্রখ্যাত গবেষককে ড. সরকার আব্দুল মান্নানকে অনুরোধ জানান। পাশাপাশি করোনাকাল কেটে গেলে বড় একটি আয়োজন করে ঐতিহাসিক এউ দিনটির একশো বছরকে ঘিরে বড় আয়োজন করার কথা জানান।
শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ইংরেজ শাসনামল থেকেই এদেশে চা শ্রমিকরা তাদের ন্যার্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একসময় চা-বোর্ডের দায়িত্বে ছিলেন। চা শ্রমিকদের যতটুকু অধিকার এসেছে তা কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই এসেছে। সেই ধারাবাহিকতায় জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সবসময় চা শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। বতর্মানে বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা আগের তুলনায় কিছুটা ভালো আছেন। চা শ্রমিকদের নিজস্ব ভূমি এবং শিক্ষাক্ষেত্রকে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। আমি এ বিষয়ে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলবো। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের অসহায় দরিদ্র মানুষের কথা সবসময় চিন্তা করেন। তিনি এদেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কথা সমানভাবে ভাবেন। আমি বিশ্বাস করি তিনি অন্যান্য শ্রেনী পেশার মানুষদের মতোই চা শ্রমিকদের জন্যে অনেক কিছু করেছেন এবং সামনে যা কিছু করার দরকার তিনি তা করবেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান তার বক্তব্যে বলেন, চাঁদপুরে এতোবড় একটি গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছে, অথচ এ বিষয়ে এখানে তেমন কোন কাজ হয়নি। এমনকি আমি চাঁদপুরে দায়িত্ব পালনের ৩ বছরেও কোন আয়োজন দেখিনি। এই একশ বছরে চাঁদপুর থেকো প্রকাশিত চাঁদপুর পরিক্রমা, জেলা ব্র্যান্ডিং বইসহ চাঁদপুরের ইতিহাস নিয়ে গ্রন্থিত কোন বইতেও এ সংক্রান্ত কথা উল্লেখ করা হয়নি। যা সত্যিই দুঃখজনক। এর দায় আমাদের সকলের।
তিনি আরো বলেন, চাঁদপুর বড় স্টেশন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতি স্মরণে একটি রক্তধারা ভাস্কর্য রয়েছে। আমি আশা করবো এখানে চা শ্রমিকদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করার বিষয়ে আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। এ বিষয়ে আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে কথা বলব। আশা করছি আমাদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল প্রকার সহযোগিতা করা হবে। সাহিত্য মঞ্চ একটি ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে নতুন করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। আমি এই আয়োজনের জন্যে সাহিত্য মঞ্চ সহ সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বরেণ্য গবেষক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ ড. সরকার আব্দুল মান্নান তার বক্তব্যে বলেন, ব্রিটিশরা ভারতের বিভিন্ন দরিদ্র এলাকা থেকে অসহায় জনগোষ্ঠীকে দালালের মাধ্যমে এদেশে এনে সামন্য পারিশ্রমিক দিয়ে চায়ের চাষ শুরু করে। তারা তাদের সকল মৌলিক অধিকার বঞ্চিত ছিলো। তাই এ দুর্দশা আর মালিকপক্ষের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে আন্দোলনের ডাক দেয়। ২০ মে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে চাঁদপুর আসে, যাতে করে এখান থেকে তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু সেদিন এই অসহায় চা শ্রমিকদের ব্রিটিশদের গোর্খা বাহিনীর নির্মম ভাবে হত্যা করে।
তিনি আরো বলেন, চা শ্রমিকরা এখনও তাদের দুর্দশার জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তারা এখনো খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের খুবই যৎসামান্য পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। আমি ইতিহাসের এই নির্মমতম ঘটনাকে তুলে ধরার জন্যে চাঁদপুরের সাহিত্য মঞ্চ এবং আশিক বিন রহিম ও মাইনুল ইসলাম মানিককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তারা এত বছর পরেও এই দিনটিকে নিয়ে একটি আয়োজন করেছেন।
চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী তার বক্তব্যে বলেন, চাঁদপুরে এত বড় একটি ঘটনা ঘটেছে কিন্তু এ বিষয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। শুধু তাই নয়, চাঁদপুর থেকো প্রকাশিত চাঁদপুর পরিক্রমা, জেলা ব্র্যান্ডিং বইসহ অন্যন্য বইতেও এ বিষয়ে লেখালেখি করা হয়নি। আমি মনে করি আমরা কেউ এ দায় এড়াতে পারি না। এ দায় থেকে আমি নিজেও মুক্ত নই। এই ঘটনা নিয়ে আরো বেশি লেখালেখি এবং আয়োজন হওয়ার প্রয়োজন ছিল।
তিনি প্রধান অতিথি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কল্যানে চাঁদপুরে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আপনার মাধ্যমে চাঁদপুরে চা শ্রমিকদের স্মৃতি নিয়ে একটি ভাস্কর্য কিংবা ম্যুরাল করা হলে এটি ইতিহাস হয়ে থাকবে।
উল্লেখ্য অনুষ্ঠানটি ফেইসবুকে সরাসরি লাইভ হয়।