চাঁদপুরে ব্যস্ততম সড়কে অবৈধ বাজার

ঘটছে দুর্ঘটনা : ক্ষতির মুখে শতবর্ষী মূল বাজার
: আশিক বিন রহিম :
চাঁদপুর জেলার প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা শহরের পুরাণবাজার। ব্রিটিশ আমল থেকে গড়ে ওঠা এ বাজারে রয়েছে কয়েকশ’ পাইকারি মালামালের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। চাঁদপুরের বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও দেশের পার্শ্ববর্তী অন্যান্য জেলা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার ব্যবসায়ী এখানে থেকে মালামাল ক্রয়-বিক্রয় করে থাকেন। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ এবং ওই এলাকা বসবাসকারীদের জন্য সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পুরাণবাজারে গড়ে উঠেছে একটি মাছের বাজার। জেলার অন্যতম এবং প্রাচীন এই বৃহৎ বাজারটিতে রয়েছে মাছের বাজার, কাঁচা তরকারি বাজার, মাংসের বাজার, মুদি বাজারসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিভিন্ন বাজার।
এদিকে গত কয়েক বছর ধরে এই বাজারের পূর্ব পাশে নতুন রাস্তায় একটি অবৈধ বাজার তুলেছে কিছু ব্যবসায়ী। পুরাণবাজারের ব্যবসায়ীদের মালামাল পরিবহনে যানবাহন চলাচলের জন্য বাদিয়াবাড়ি খালের উপর চাঁদপুর পৌরসভা কর্তৃক যে রাস্তাটি করা হয়েছে সেই রাস্তার উপরে এ অবৈধ বাজারটি গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে প্রতিদিন পুরাণবাজারের বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার নারী ক্রেতার সমাগম ঘটে। স্থানীয়ভাবে এটি নতুন রাস্তার বউ-বাজার নামে পরিচিত।
মূলত এই অবৈধ বাজারটির জন্যই পুরানবাজার মাছ বাজারের ঐতিহ্য এবং জৌলুস হারাতে বসেছে। ক্রেতা না থাকায় বাজারের মাছ বিক্রেতা, তরকারি বিক্রেতা ও মুদিদোকানীদের অনেকেই এখন ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। কেউ কেউ জীবিকার প্রয়োজনে খুঁজে নিয়েছে অন্য মাধ্যম। কেউ আবা বাপ-দাদার এই ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সরেজমিনে পুরাবাজার মাছবাজার গিয়ে দেখা যায়, নিকট অতীতের ব্যস্ততম এই মাছের বাজারটিতে এখন সুনসান নীরবতা। এক সময় যে বাজারটি মাছ বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত থাকত, সেখানে এখন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। হাতে গোনা দুই একজন মাছ ব্যবসায়ী মাছের পসরা সাজিয়ে বসে থাকলেও ক্রেতাদের দেখা মিলছে না।
একই চিত্র দেখা যায় মাছ বাজারের পশ্চিম পাশে কাঁচা তরকারি গলিতে। একসময় যেখানে শত শত তরকারির দোকান ছিল সেখানে এখন হাতেগোনা তিন-চারটি দোকানদার বিভিন্ন কাঁচামালের পসরা সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। অর্ধশত মুদি দোকানের গলিতে গিয়ে দেখা যায় মাত্র দুটি মুদি দোকান খোলা থাকলেও বাকি দোকাগুলোতে তালা জুলছে। স্থানীয়রা জানায় বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মুদির দোকান গুলো পুরানবাজার ব্যবসায়ীদের সুতার গোডাউনে পরিণত হয়েছে।
মাছ বাজারের ব্যবসায়ী সিডু বেপারি জানান, প্রায় ৪৫ বছর ধরে আমি এখানে মাছের ব্যবসা করছি। আমার পিতা মরহুম মান্নান বেপারী এই বাজারে ৫০ বছর ধরে মাছ বিক্রি করতেন। কয়েক বছর আগেও এই বাজারে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার ক্রেতা আসতো। বর্তমানে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫০ জন ক্রেতার উপস্থিতি হয়। পাশে নতুন রাস্তার উপর গড়ে ওঠা অবৈধ বউ-বাজারের জন্যই আজকের এই করুণ দশা বলে জানান তিনি।
হোটেল ব্যবসায়ী মোঃ দেলোয়ার হোসেন জানান, স্বাধীনতার পর থেকে আমি এই বাজারে চায়ের দোকান দারি করে আসছি। তখনকার সময়ে ৩০ পয়সা দরে যে পুরি-সিঙ্গারা বিক্রি করতাম, এখন তা ৬ টাকা দরে বিক্রি করেও চালান উঠাতে কষ্ট হয়।
তরকারি ব্যবসায়ী খোকন মাঝি ও মমতাজ শেখসহ বেশ কয়েকজন জানান, অল্প কয়েক বছর আগেও এই বাজারে পঞ্চাশটির মতো স্থায়ী তরকারি দোকান ছিল। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী চরাঞ্চল থেকে প্রতিদিন কয়েকশ ভ্রাম্যমান তরকারি বিক্রেতা বাজারের উত্তর পাশের গলিতে রাস্তার উপর বসে তরকারী বিক্রি করতো।
খোকন মাঝি আরো জানান, বর্তমানে কাস্টমার না থাকায় তার দোকানটি একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছেন। বাড়িতে বেকার সময় কাটে না বলে বাজারে বসে বসে গল্প করে সময় পার করছেন।
আনোয়ার হোসেন লিটন শেখ নামের এক মাছ বিক্রেতা জানান, আগের তুলনায় ১০০ ভাগের এক ভাগও বেচাবিক্রি নাই। এখন সারাদিন মাছ বিক্রি করে দুই তিনশ টাকা রোজগার করতে কষ্ট হয়। আমরা আমাদের বউ-বাচ্চা নিয়ে খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছি।
উপরোক্ত ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, চাঁদপুর পৌরসভা থেকে বাজার ব্যবসায়ীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে এখানে একটি স্থায়ী স্থাপনা করে দিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। অথচ আমাদের বাজারের পশ্চিম পাশে নতুন রাস্তায় অবৈধ বাজারের জন্য আমাদের এই শতবর্ষি মাছের বাজারটি বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। আমরা মাননীয় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্স এবং মাননীয় পৌর মেয়রের প্রতি অনুরোধ করবো, পুরানবাজারের শান্তি-শৃঙ্খলা এবং ঐতিহ্য রক্ষা ও বাজার ব্যবসায়ীদের জীবন-জীবিকার কথা বিবেচনা করে অবৈধ বাজারটি বন্ধ করার দাবি করছি। প্রয়োজনে ওই বাজারের বিক্রেতারা পৌরসভার এই বাজারে ব্যবসা করুক।
অবৈধ বাজার গড়ে ওঠা রাস্তার পাশ্ববর্তি বসবাসকারীরা জানায়, ব্যাবসায়ীদের মালামাল আমদানি রফতানি করার জন্যে পৌরসভা কর্তৃক এই নতুন রাস্তাটি করে দেয়া হয়। অথচ এই রাস্তার উপর অবৈধ একটি বাজার গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন এই বাজারে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুর সমাগম ঘটে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষদের পাশ কাটিয়েই ব্যবসায়ীদের ডিস্ট্রিক ট্রাক-লরি সহ বড় বড় যানবাহনগুলো মালামাল নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আসা যাওয়া করে। স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তির সহযোগিতায় পুরানবাজারের ঐতিহ্য (পৌরসভা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত) বিশাল মূল বাজারটি ধ্বংস করে দিয়ে এখানে একটি অবৈধ বাজার গড়ে তোলার কারণেই রোববার গাড়ির চাপায় নিরব নামে এক শিশু নিহত হয়েছা। এর আগেও এমন দুর্ঘটনায় বহু মানুষ আহত হয়েছে।
চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সদস্য ও বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, আমাদের ব্যবসায়ীদের মালামালগুলো মূলত নদী এবং সড়কপথে চাঁদপুর সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আমদানি রপ্তানি করা হয়। ব্যবসায়ীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে চাঁদপুর পৌরসভা কর্তৃপক্ষ বাদিয়াবাড়ি খালটি ভরাট করে এই নতুন রাস্তাটি গড়ে তোলেন। অথচ যানচলাচলের এই রাস্তার উপরেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে একটি অবৈধ বাজার গড়ে তোলা হয়েছে। এই অবৈধ বাজারটি বন্ধ না হলে এখানকার মালামালগুলো পরিবহনকারী যানবাহনের চাপায় এই অপ্রত্যাশিক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা বন্ধ হবে না। তাই চাঁদপুরের জেলা প্রশাসন এবং পৌরসভার নতুন নগর পিতার প্রতি আমাদের আহŸান থাকবে অবিলম্বে এই অবৈধ বাজারটি বন্ধ করে দেওয়া হোক।

শেয়ার করুন

Leave a Reply