চাঁদপুরে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি বাস্তবায়নে গুরুত্বারোপ

চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা, হাইড্রোলিক হর্ণের বিরুদ্ধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে, প্রচারণায় সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহার, ধর্মীয় প্রচারণায় মাইকের ব্যবহার সীমিত করা, উৎসব উদযাপনে শব্দযন্ত্র ব্যবহারের সংস্কৃতি বন্ধ করা, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা বাস্তবায়নে প্রত্যেকটি সংস্থাকে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা ও বাস্তবায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
গতকাল ২৮ এপ্রিল বুধবার চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের আয়োজনে আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সভায় সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয়ে আলোচনা করেন। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ।
চাঁদপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। এর মধ্যে নিম্নের বিষয়গুলোর উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে-
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিকরা ও গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো। হাইড্রোলিক হর্ণের বিরুদ্ধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে, প্রচারণায় সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহার, ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলে মাইকের ব্যবহার সীমিত করা এবং উৎসব উদযাপনে শব্দ যন্ত্র ব্যবহারের সংস্কৃতি বন্ধ করা। নীরব এলাকায় হর্ণ না বাজানো ও অন্যান্য এলাকায় অপ্রয়োজনে হর্ণ না বাজানোর জন্য মোটরযান ড্রাইভারদের উদ্বুদ্ধ করা। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা বাস্তবায়নে প্রত্যেকটি সংস্থাকে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা ও বাস্তবায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। লাউডস্পীকারের ব্যবহারে সচেতন হওয়া। সামাজিক, পারিবারিক, বিনোদন অনুষ্ঠান, দোকানসহ বিভিন্ন স্থানে উচ্চ শব্দে গান বাজানো নিয়ন্ত্রণ করা। জনগণসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সরকারী বিধিবিধান মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করা। উচ্চ শব্দের হর্ণ যুক্ত যানবাহনকে জরিমানা ও শাস্তির আওতায় আনা। শব্দ দূষণ রোধে সংস্কৃতিগত পরিবর্তন সাধন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিআরটিএ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়মিত অভিযান পরিচালনা। ব্যাক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, সরকারি গাড়িতে ব্যবহৃত নিষিদ্ধ হর্ন বন্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ।
এছাড়া সভায় পরিবেশ অধিদপ্তর, চাঁদপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নাজিম হোসেন শেখ মূল প্রবন্ধে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি আলোকপাত করেনঃ
বর্তমানে শব্দ দূষণ একটি মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা হিসেবে পরি গণিত হয়েছে। বিভাগীয় জেলা, উপজেলা শহরে সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি শব্দ দূষণ হচ্ছে। শব্দ দূষণের ফলে নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া বিঘ্নিত হওয়াসহ শিশু, গর্ভবতী এবং হৃদরোগীদের জন্য মারাত্নক স্বাস্থ্যগত জটিলতা সৃষ্টি করে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আওতায় শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ বলবৎ রয়েছে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তারপরও শব্দ দূষণের মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতি থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন আশু পদক্ষেপ গ্রহণের। মানুষকে সচেতন করার সাথে সাথে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনের কঠোর প্রয়োগও করতে হবে।
আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনা দিবস হচ্ছে একটি বিশ্বব্যাপী প্রচারণা, যা জনগণের কল্যাণ ও স্বাস্থ্যের উপর শব্দ সচেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমেরিকান ‘সেন্টার ফর হিয়ারিং এন্ড কমিউনিকেশন’ বা লীগ ফর দ্যা হার্ড অব হেয়ারিং ১৯৯৬ সাল থেকে এপ্রিল মাসের শেষ বুধবার দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে ২০০৩ সাল থেকে বেসরকারিভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্ব ব্যাংকের একাধিক গবেষণায় সারা বিশ্বের মানুষের ৩০টি কঠিন রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে শব্দ দূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। শব্দ দূষণের কারণে আগামী প্রজন্ম মানসিক ও শারীরিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ উপলব্ধি থেকে সকলের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বর্তমানে সরকারিভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
উদ্দেশ্যঃ
১) শব্দদূষণ, শব্দদূষণের ক্ষতিকারক দিক সমূহ, শব্দ দূষণরোধে করণীয় সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা।
২) শব্দ দূষণের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করে প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য তুলে ধরা।
৩) শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সকল স্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
শব্দ দূষণের ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়া, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, শিক্ষার্থীদের অমনযোগী আচরণ, ঘুমের ব্যাঘাতসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। উচ্চমাত্রার শব্দে মানুষের শ্রবণ শক্তি হ্রাসসহ শিক্ষার্থীদের নিবিষ্টচিত্তে বুদ্ধি দীপ্তকাজ করার ক্ষেত্রে ভয়াবহ সমস্যা দেখা দেয় ফলে মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শ্রবন-শক্তি হ্রাসের ফলে বিরক্তি, নেতিবাচকতা ও রাগ, ক্লান্তি, চাপা উত্তেজনা, মানসিকচাপ ও বিষন্নতা, একাকীত্ব, সতর্কতা হ্রাস ও ব্যক্তিগত ঝুঁকি বৃদ্ধি, স্মৃতি শক্তি ও নতুন কিছু শেখার ক্ষমতাহ্রাস, কর্মক্ষমতা ও উপার্জন শক্তি হ্রাস এবং মানসিক ও সামগ্রিক স্বাস্থ্য খর্ব হয়ে থাকে।
উচ্চ শব্দ শিশু, গর্ভবতী মা এবং হৃদরোগীদের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সংকোচন করে এবং পরিপাকে বিঘ্ন ঘটায়। হঠাৎ বিকট শব্দ মানুষের শিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রচন্ড চাপ দেয়। শব্দ দূষণের ফলে ট্রাফিক পুলিশও বধিরতাসহ মারাত্বকভাবে বিভিন্ন শারিরীক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ক্রমাগত ৮৫ ডেসিবলের উপরে শব্দে শ্রবন-শক্তির ক্ষতি হতে পারে।
শব্দ কতটা ক্ষতিকর তা ভলিউম এবং শব্দের স্থায়িত্বের উপর নির্ভর করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সাধারণত ৬০ ডেসিবল শব্দ একজন মানুষকে অস্থায়ীভাবে বধির করতে পারে এবং ১০০ ডেসিবল শব্দ সম্পূর্ণভাবে বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্বে বধিরতার হার ক্রমশই বাড়ছে। বিশ্বের ১৫ শতাংশ মানুষ কোন না কোন পর্যায়ের শ্রুতিক্ষীণতায় ভুগছেন যাদের অধিকাংশই শিশু। আর বিশ্বের ৫ শতাংশ লোক বধিরতায় ভুগছেন, যা তাদের নিত্য দিনের কার্যক্রম এবং জীবন-জীবিকার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ২০০২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শ্রুতিক্ষীণতার হার ছিল ৭.৯ শতাংশ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক, কান ও গলা বিভাগ কর্তৃক ২০১৩ সালে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এক-তৃতীয়াংশ লোক কোন না কোন শ্রুতিক্ষীণতায় ভুগছেন এবং ৯.৬ শতাংশ শ্রুতি প্রতিবন্ধী। একই সাথে দেশে ১৫ বছর বয়সের নিচের জনসংখ্যার মধ্যে শ্রুতি প্রতিবন্ধীর হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ২.৫ শতাংশ বেশী। বিশেষজ্ঞদের মতে শব্দ দূষণের বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা মহানগরীর ৫০ শতাংশ মানুষ ৩০ ডেসিবল শব্দ শুনার ক্ষমতা হারাবে, শিশুদের মধ্যে বধিরতার হার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে এবং তারা লেখাপড়ায় অমনোযোগী ও বিকার মানসিকতা সম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬:
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর অধীন ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এর আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারবেনা। নীরব এলাকা হচ্ছে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ইত্যাদি এবং এর চারপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা। নীরব এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোন প্রকার হর্ণ বাজানো এবং মোটর, নৌ বা অন্য কোন যানে অনুমোদিত শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী হর্ণ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসমূহ নিজ নিজ এলাকার মধ্যে নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকা সমূহ চিহ্নিত করে সাইন বোর্ড স্থাপন ও সংরক্ষণ করবে। এই বিধিমালার বিধান লংঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। বিধি অনুযায়ী শব্দের মানমাত্রা নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ও রাতে ৪৫ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ ডেসিবল।

শেয়ার করুন

Leave a Reply