চাঁদপুরে সুলতানি আমলের সেই মসজিদ ধসে পড়ার অপেক্ষায়, কাজে অনিয়ম

ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী :
অনিয়ম, অবহেলা এবং করোনার প্রভাব- এই তিনের যাঁতাকলে পড়ে চাঁদপুরে জঙ্গল সাফ করে পাওয়া সুলতানি আমলের সেই মসজিদটি এখন যে কোন দিন ধসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আবার সেখানে জঙ্গল তৈরি হচ্ছে। মসজিদের গম্ভুজটি ফাঁক হয়ে আছে। খোদ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের চট্রগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পরিচালক ড. আতাউর রহমানই এই মন্তব্য করে অধিদপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছেন। যিনি শুরু থেকেই মসজিদটি তদারকি করে আসছিলেন। শুধু তাই নয়, এটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে ৮ লাখ টাকা সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তার অধিদপ্তরের মাধ্যমে বরাদ্দ দিয়েছিলো, তার ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা অধিদপ্তরের আদেশবলে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাদবাকি টাকা একরকম জলে ফেলা হয়েছে, সেটা বললেও ভুল হবে না। কারণ, করোনা মহামারি প্রাদুর্ভাবের ১ মাস আগে তথা ২৮ ফেব্রুয়ারি অধিদপ্তরের ডিজি অতিরিক্ত সচিব মোঃ হান্নান মিয়া মসজিদটির সংস্কার কাজ দেখে চরম ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং কাজটি বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করেন। অধিদপ্তরের যে প্রকৌশলী এবং তার শ্রমিকরা মসজিদটির কাজ করছিলো, তারা সম্পূর্ণ নকশা বহির্ভূত কাজ করছিলো। মসজিদের ৪শ’ বছরের পুরনো ইট যা তার ঐতিহাসিক নিদর্শনকে জানান দেবে- সেসব লাল সরু শত শত ইটগুলো কুড়াল হাতুড়ির আঘাতে ফেলে দেয়। এছাড়া ওই কেটে ফেলা ইটগুলোরস্থলে দেশীয় ইটভাটার সাধারণ মানের ইট বসাচ্ছিলো। এই পরিস্থিতি দেখে ডিজি কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন এবং যারা এ ধরনের অপকাজ করেছেন তাদের জবাদিহিতা করতে হবে বলে পরিদর্শন করে চলে যান। সেসময় তার সাথে ঢাকা এবং চট্রগ্রামের ক’জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। ডিজির যাওয়ার ৫ মাস পর গত ৭ জুলাই ঢাকা থেকে উপপরিচালক মাহবুবুর রহমান সহকারি পরিচালক মহিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পরিচালক ড. আতাউর রহমান মসজিদটি পরিদর্শনে আসেন।


কবে নাগাদ মসজিদটির কাজ শুরু করা হবে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের ডিজি মো: হান্নান মিয়া তার মুঠোফোনে এ প্রতিনিধিকে জানান, তাদের কাজটিই ভুল হয়েছে। যে প্রকোশলী কাজটি করেছেন এবং এর ঠিকাদার তারা কোনভাবেই কাজটি ঠিক করেননি। যা হওয়ার তা তো হলোই। কিন্তু এখন আটকে গেলো করোনার জন্য। তিনি বলেন, তাদের এটির এখনকার অবস্থা দেখার জন্য তদন্ত টিমটি পাঠানো হয়েছে। কবে নাগাদ এটির কাজ শরু হবে তা তিনি স্পষ্ট করেননি। তদন্ত টিমের সাথে থাকা পরিচালক, বলেন, ঢাকা থেকে আসা দু’ জন কর্মকর্তার সাথে আমিও এলাম। দেখলাম। তিনি বলেন, আমাকে জুন মাসের আগে এর বাদবাকি টাকা ফেরত দেয়ার জন্য বলা হয়েছে, আমি তা ফেরত দিয়েছি।


প্রায় ৪ লাখ টাকা দিয়ে কি কাজ হলো- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তার ভাউচার দেয়া হয়েছে।
এদিকে রামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আল মামুন পাটওয়ারী বলেন, গত দু’ বছর যাবৎ কর্মকর্তাদের আসা যাওয়ার শেষ নাই। ক’মাস পরপরই তারা আসা যাওয়ায়। কাজটি ধরাও হলো। কিন্তু সম্পূর্ণ অনিয়মের মাধ্যমে। ছোট্ট একটা ঐতিহাসিক মসজিদ রক্ষা হচ্ছে না এতোদিনেও, বিষয়টি দুঃখজনক। নিজ পরিষদ থেকে মাত্র ২শ’ গজ দূরে এই পুরাকীর্তি তথা সুলতানি আমলের মসজিদটি আমাদের সামনে ধসে পড়বে, তাও আমাদের দেখতে হবে? এলাকার মানুষ এ নিয়ে বলাবলিও শুরু করে দিয়েছে।
দু’ বছর আগে গভীর জঙ্গল সাফ আর সুবিশাল জির গাছ কেটে মসজিদটি বের করা হয়। সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের তালুকদার বাড়ির দু’টি দিঘীর মধ্যবর্তীস্থানে এই এক গম্বুজ মসজিদটির সন্ধান দাতা ছিলেন ওই ইউনিয়নেরই সন্তান শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি এমপি। তারই নির্দেশনায় ২০১৮ সালে ৪/৫ দিন ভর শ্রমিক লাগিয়ে মসজিদটি বের করে আনা হয়। পরে মসজিদটি পরিদর্শন করে যান এলাকার মেয়ে সন্ধানদাতা, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি সেসময় প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন, এই মসজিদকে ঘিরে ওই জায়গাটিতে পর্যটন অঞ্চল গড়ে তুলবেন। পরে তাঁর তড়িৎ হস্তক্ষেপেই এটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেশের ঐতিহাসিক নিদর্শন তথা পুরাকীর্তি ঘোষণা দেয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। কিন্তু গত দু’ বছরেও মসজিদটি তার হারানো গৌরবের ন্যুনতমও ফিরে পায়নি। বরং যেটুকু আছে তাতে ধস নামার শতভাগ আশংকা অধিদপ্তরের চট্রগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের পরিচালকেরই। এলাকাবাসী জানান, গত দু ‘ বছরে এমপি মহোদয় ছাড়াও ডিজি, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকগণ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সংস্কৃতি অধিদপ্তরের পরিচালক, উপপরিচালক, ইঞ্জিনিয়ার, প্রত্নতত্ত্ববিদসহ বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা মসজিদটি দেখে গেছেন। নির্দেশনা দিয়েছেন, কাজ ধরা হলো। কিন্তু কি লাভ হলো? এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটা ছোট মসজিদ শুধু সংস্কার কাজটি করবে, তা ও পারা গেলো না ২ বছরে?
প্রসংগত: ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে মসজিদটি জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে আনা হয়। সে সময় এই মসজিদ নিয়ে সারা দেশের মিডিয়াগুলোতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ মসজিদটি দেখতে ছুটে আসে। দেশে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া এমনকি বিদেশেও এটি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়।

শেয়ার করুন

Leave a Reply