চিকিৎসা সেবার সাথে জড়িতরা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন : হাবীবুল করিম

প্রেস বিজ্ঞপ্তি :
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), চাঁদপুরের আয়োজনে জেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সাথে “করোনাকালীন সংকট মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে কার্যক্রমঃ চ্যালেঞ্জ ও করনীয়” শীর্ষক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা গতকাল ২৮ জুন ২০২১ অনুষ্ঠিত হয়। সনাক সভাপতি শাহানারা বেগমের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ হাবীবুল করিম। মূখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সাখাওয়াত উল্যাহ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাঃ মোঃ হাবীবুল করিম বলেন, চিকিৎসা সেবার সাথে জড়িত সকলে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেও চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবসময় বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন আমরা সেই মোতাবেক কাজ করছি। তিনি আরও জানান, ডিজিটাল এক্সরে মেশিন ২০১৭ সালে স্থাপন করা হলেও আমি যোগদান করার পর দেখি মেশিনটি নষ্ট অবস্থায় আছে। আমি মেশিনটি মেরামতের জন্য অধিদপ্তরে চিঠি দেই এবং টেকনিশিয়ান দেখাই। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার কারণে এখন পর্যন্ত মেশিনটি সচল করা সম্ভব হয়নি। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে আমরা আইসিইউ’র জন্য ৩টা ব্যাড পেয়েছি। কিন্তু দক্ষ জনবল না থাকার কারণে সেটিও এখন পর্যন্ত চালু করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, করোনা মোকাবেলা করার জন্য আমরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। তিনি করোনা মোকাবেলায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি এমন একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য সনাক-টিআইবিকে ধন্যবাদ জানান।
মূখ্য আলোচকের বক্তব্যে চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, করোনা বিষয়টি সম্পূর্ণ নতুন। প্রথম প্রথম করোনা সেবা দিতে কিছুটা সমস্যা হলেও এখন অনেকটা উত্তোরণ হয়েছে। তিনি জানান, প্রতিটি উপজেলায় একজন করে টেকনিশিয়ান রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় তারাও আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু সীমান্তবর্তী এলাকায় নয় করোনা সংক্রমণ এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। চাঁদপুরে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়ও কিছুটা দুর্বলতা ছিলো। তিনি বলেন, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর বদাণ্যতায় আমরা পিসিআর ল্যাব ও অক্সিজেন প্লান্ট পেয়েছি। তিনি বলেন, করোনা ঘন ঘন রুপ বদলাচ্ছে। করোনার এতো এতো রেডিয়েন্ট আসছে যা কল্পনার বাহির। এই ভাইরাসগুলো খুবই দ্রুত ছড়ায়। যা মোকাবেলা করা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। জনগণকে আরও বেশি স্বাস্থবিধি মেনে সঠিক নিয়মে মাস্ক পরতে হবে। জনগণকে মাস্ক ব্যবহার, স্বাস্থবিধি মানা, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার জন্য সচেতনতামূলক বহু কার্যক্রম পরিচালনা করছি। চাঁদপুরে সংক্রমণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। এজন্য আমরা চাঁদপুর নিয়ে অনেক চিস্তিত। তিনি জনগণকে আরও বেশি সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি এমন একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য সনাক-টিআইবিকে ধন্যবাদ জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেল বলেন, চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে জনবল সংকট হলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিগত ১৫ বছর ধরে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কোন জনবল নিয়োগ হচ্ছে না। আউট সোর্সিং থেকে জনবল এনে কাজ করাতে হয়। চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়েও অনেক চ্যালেঞ্জ পেতে হচ্ছে। কারণ রোগীরা অনেক সময় চিকিৎসকের কাছে রোগের কথা গোপন রাখে। তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে ৩টি আইসিইউ ব্যাড এসেছে। কিন্তুপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোন জনবল না থাকার কারনে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। করোনা ওয়ার্ডে স্যাম্পল সংগ্রহ করার জন্য একজন মাত্র টেকনিশিয়ান রয়েছে। করোনায় আক্রান্ত রোগীরাও স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। তিনি জানান, গত আড়াই বছর যাবত হাসপাতালে কোন রেডিওলজিস্ট নেই। তিনি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও মাস্ক পরিধান করার কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন। তিনি এধরণের আলোচনা সভা আয়োজন করার জন্য সনাক-টিআইবিকে ধন্যবাদ জানান।
সম্মানীয় অতিথির বক্তব্যে টিআইবি’র সিভিক এনগেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক ফারহানা ফেরদৌস বলেন, অত্যন্ত একটি ফলপ্রসূ আলোচনা চলছে। যা খুবই সময়োপযোগী। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ যতই চিকিৎসা দিক না কেন জনগণ সচেতন না হলে তা কোন কাজে আসবে না। আপনারা জানেন ইতিমধ্যে বিশ্বের ৮৫টি দেশে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কারো একার দায়িত্ব হতে পারে না। এটি মোকাবেলায় সকলকে সচেতন হতে হবে এবং সকলের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। তিনি বলেন, জনবলের সংকট, অসচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি না মানা, সমন্বয়হীনতা এবিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। আমরা দেখেছি সম্পদের ঘাটতির চেয়েও সঠিক বন্টনের ঘাটতি রয়েছে প্রচুর। তিনি আরও বলেন, লকডাউন ব্যবস্থা কার্যকর করা না গেলে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আনা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির এই ১৬ মাসে টিআইবি ইতিমধ্যে ৩টি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তিনি গবেষণা কার্যক্রমের তথ্যগুলো তুলে ধরেন। আলোচনা সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
করোনাকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ ও করণীয় বিষয়ক আলোচনায় চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটওয়ারী বলেন, চাঁদপুর সদর হাসপাতালের ডিজিটাল এক্সরে মেশিন ও এনেস্থিসিয়া মেশিনটি কার্যকর নয়। তিনি বলেন, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সদর হাসপাতালকে আরও তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমার সচেতনতা আমার কাছে। চাঁদপুরে আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তাই আমাদের সবাইকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। তিনি এ ধরনের একটা ভার্চুয়াল সভা আয়োজন করার জন্য সনাক-টিআইবিকে ধন্যবাদ জানান।
স্বাগত বক্তব্যে সনাকের সাবেক সভাপতি ও সদস্য কাজী শাহাদাত বলেন, এই সভাটি সময়োপযোগী একটি ভার্চুয়াল সভা। তিনি বলেন, আমরা সনাক-টিআইবি যেকোন প্রতিষ্ঠানের বাস্তব চিত্র নিয়ে আলোচনা করতে পারি কিন্তু কারো উপর খবরদারি করতে পারি না। স্বাস্থ্যসেবা খাতে যেমন সফলতা আছে তেমনি অব্যবস্থাপনাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। হাসপাতালের জনবল সংকটের কারনে সেবা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। চিকিৎসকরা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তিনি সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থবিধি মানার আহ্বান জানান। আলোচনা সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
করোনাকালীন স্বাস্থ্যখাতে সুশাসন নিশ্চিতকরণে করণীয় শীর্ষক বক্তব্য রাখেন টিআইবি’র সিভিক এনগেজমেন্ট বিভাগের কো-অর্ডিনেটর কাজী শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। সমগ্র বিশ্ব এখন করোনার কালো মেঘে ঢেকে গেছে। করোনার কারনে আর্থিক, স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক বিপর্যয় বেশি দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, মানুষের মাঝে সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবনতা দেখা দিলে মৃত্যুর হার দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। এ সংকটটি সরকারের একার পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সকলের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের প্রয়োজন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা ও অব্যবস্থাপনা রোধ করা খুবই জরুরি। তা না হলে স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তিনি বলেন, চাঁদপুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করা, অব্যবস্থাপনা রোধ করা ও করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এই প্রত্যাশা করছি। তিনি আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
করোনাকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ ও করণীয় বিষয়ক আলোচনায় চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সাজেদা পলিন বলেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সকলের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে রোগীদের চাপ সামলানো একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ব্যানার, পোষ্টার ও মাইকিং করা যেতে পারে। তিনি বলেন, প্রতিটি মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর তা বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি এ ধরনের একটা ভার্চুয়াল সভা আয়োজন করার জন্য সনাক-টিআইবিকে ধন্যবাদ জানান।
সনাক সদস্য ও স্বাস্থ্য বিষয়ক উপকমিটির আহ্বায়ক ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার সঞ্চালনায় করোনাকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ ও করণীয় বিষয়ক মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, চাঁদপুর ডায়াবেটিস হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ও সনাক সদস্য ডাঃ ছাবেরা ইসলাম, দৈনিক চাঁদপুর খবর পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক সোহেল রুশদী, চাঁদপুর সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আব্দুর রশিদ, চাঁদপুর পৌরসভার সচিব মোঃ আবুল কালাম, চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি ও দৈনিক চাঁদপুর কন্ঠের বার্তা সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্যাহ, সনাকের সাবেক সভাপতি ও সদস্য অধ্যক্ষ মোঃ মোশারেফ হোসেন, জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ মহিউদ্দিন রাসেল ও ২৫০ বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার প্রতিভা মজুমদার প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে সনাক সভাপতি শাহানারা বেগম বলেন, সনাক-টিআইবি মূলত সচেতনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। করোনা মোকাবেলায় সাধারণ জনগণকে সাথে নিয়ে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। করোনা নিয়ে এখন আর অবহেলা করার সুযোগ নেই। মাস্ক পড়ার গুরুত্ব বাড়ানোর আহ্বান জানান। আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
টিআইবি’র এরিয়া কো-অর্ডিনেটর মোঃ মাসুদ রানার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন, সাংবাদিকবৃন্দ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীবৃন্দ, সুশীল সমাজের নের্তৃবৃন্দ, সনাক-স্বজন-ইয়েস-ইয়েস ফ্রেন্ডস গ্রুপের সদস্যবৃন্দ ও টিআইবি কর্মীবৃন্দ।

শেয়ার করুন

Leave a Reply