নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে ইতিবাচক হোন

অ্যাড. জেসমিন সুলতানা ::
স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সূর্যকে ছিনিয়ে এনে আলোকিত সোনার বাংলা গড়তে ত্রিশ লক্ষ প্রান বিসর্জিন দিতে হয়েছে, সম্ভ্রম হারিয়েছে দুই লক্ষ নারী লিখিত ভাবে, অলিখিত ভাবে আরো যে কতো , সে নীরব কান্না কখনো শুনেছো কি তুমি ?
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন না করেও কত কতো যে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে,ভাতা নিয়েছে তার হিসেব নেই। স্বাধীনতার পন্চাশ বছরপরও তাই নতুন করে মুক্তি যোদ্ধাদের তালিকা করতে হচ্ছে।রাজাকার,আলবদর,আলশামস বাহিনীর সদস্যরা তাদের বংশধররা রাষ্ট্রীয় কতো মর্যাদা পূর্ন জায়গায় বসে মনে মনে পাকি ধ্যান ধারনাকে লালন, পালন, অনুসরন,অনুকরন করছে তাদের খবর কে রাখে? সান শওকতে থাকে বাংলাদেশে, কল্পনায় তাদের অবস্হান ভিন্ন গ্রহে ভিন্ন স্হানে।তারা অনেকেই নারী বিদ্বেষী, নারী বিধ্বংসী, নারী নির্যাতনকারী, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়, তারা চায় নারী ঘরে বসে থাকুক, তারা ধর্মভীরু নয় ধর্মান্ধ।।
সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে অনুযায়ী নারী শারীরিক ভাবে, গঠনগত ভাবে পুরুষের মত নয়।নারী ও পুরুষের অঙ্গ প্রতঙ্গ,বয়ঃসন্ধি,ঋতু কালীন সময় সব কিছুই আল্লাহ দিয়েছেন,এ যেন সৃষ্টির আরেক রমনীয় ব্যবস্হা মোহনীয় রূপ।।একটি মেয়ে ঋতুবতী হবে,সন্তান ধারন করবে, সন্তান প্রসব করবে তা কি তার আজন্ম পাপ? জীবন যাপনের অন্তরায়?
ঋতুবতী না হলে, নারী সন্তান ধারন করতে পারবেনা তখন তাকে বন্ধ্যা অজুহাতে বের করে দিতে বা তালাক দিতে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবেনা।
সংবিধান নাকি আমাদের অনেক অধিকার দিয়েছে তাহলে দেখি আমার পবিত্র সংবিধানে আমার কথা কিংবা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নারী অধিকার রক্ষায় গৃহিত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদে(সিডও) কি আছে?
আইনানুযায়ীই রাষ্ট্রের সকল কর্মকান্ডে নারীর ক্ষমতায়ন এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন ও সংবিধানের মাধ্যমে প্রয়োজন সেই অধিকারকে রক্ষা করা।
সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নারী-পুরুষে বৈষম্য করার কোনও সুযোগ নেই।
– সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আছে, ‘ সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’।
– সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না’।
– সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে আছে, ‘ রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’।
– সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, ‘নারী ও শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না’।
– সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের সমতা থাকবে’।
– সংবিধানের ২৯ (৩) অনুচ্ছেদে আছে, ‘ কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারীপুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মের নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।-
এ ছাড়া মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহ, দেনমোহর, তালাক, অভিভাবকত্ব ক্ষেত্রে মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১, মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রীকরণ) আইন, ১৯৭৪ (১৯৭৪ সনের ৫২নং আইন) যেখানে বিয়ে পড়ানোর পর ৩০ দিন সময়ের মধ্য রেজিষ্ট্রশনের কথা আছে, মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ আইনে নারীর বিভিন্ন অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।
এ ছাড়া নারী নির্যাতন প্রতিরোধে রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ সংশোধিত ২০০৩, রয়েছে যৌতুক নিরোধ আইন। কিন্তু সামাজিকভাবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সংবিধান এবং আইনে থাকলেও নারীর প্রতি বৈষম্য বিরাজ করছে সমাজের সর্বত্র।
জাতিসংঘে নারীর প্রতি সকল বৈষম্য বিলোপ সনদ, Convention on the Elimination of all Forms of Discrimination Against Women, 1979 (CEDAW 1979), একে International Bill of Rights of Women ও বলা হয়ে থাকে তারই আলোকে সরকারের নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।
এক সময় মনে করা হতো কঠিন শ্রম, ঝুঁকিপূর্ন পেশায় নারীকে নিয়োগ দেয়া যাবেনা । ১৯৭৪ সনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান প্রথম সরকার গঠনের পরপরই ৮ জন নারীকে পুলিশ কনস্টেবল পদে নারীদের ঝুকিপূর্ণ পেশাটিতে নিয়োগ দিয়েছেন বর্তমানে সংখ্যা অনেক।। ঝড় , বৃষ্টি,বন্যা,সাইক্লোনপ্রাকৃতিক দূর্যোগ জয় করে ঋতুবতী,গর্ভবতী হওয়ার পরও অর্পিত দায়িত্ব পালন করে আসছে নারী।২০০০ সেনাবাহিনী ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করে বি,এম,এ থেকে ঝড় ঝন্জা অতিক্রম করে ঋতুবতী নারী পাহাড়,নদী,সমুদ্রে ট্রেনিং সফলতার সাথে শেষ করে আজ মেজর জেনারেল পদে পদায়িত হচ্ছে। জেলা প্রশাসক,পুলিশ সুপার ,সিভিলসার্জন সরকারের সচিব পদে কাজ করছেন বাংলাদেশের নারী।
আমার দেখা মতলব উত্তরে টি,এন,ও শারমিন আক্তারকেও দেখেছি রাত বিরাতে পুলিশ ফোর্স নিয়ে ঝড়ের মধ্যে গিয়েছেন প্রমত্তা মেঘনায়, দূধর্ষ ইলিশ চোরদের ধরতে,অবৈধ বালু উত্তোলন কারীদের ধরতে, বাজার সমূহের ঘুরে ঘুরে ফরমালিন মিশাতে চেষ্টারত ব্যবসায়ীদের ধরে ধরে শাস্তি দিতে।
শারীরিক, অর্গানিক প্রক্রিয়ায় গঠিত মাসের তিনটি বা চারটি দিন ঋতুবতী থাকার কারনে সতের কোটি ৫৪ লক্ষ মানুষের অর্ধেক নারীর যেকোন নিয়োগ প্রক্রিয়ার কোন প্রতিবন্ধকতা হতে পারেনা।।
মুসলিম নারীরা ঋতু কালীন সময় মসজিদে প্রবেশ করেনা,পবিত্র ধর্মগ্রন্হ স্পর্শ করেনা, সবাই তা মেনে চলে।। আমাদের দেশে নারী মসজিদে নামাজ পড়বে তা কল্পনাতীতছিলো,মসজিদুল হারামে যখন নারী পুরুষ পাশাপাশি বসে নামাজ আদায় করছিলাম তখন মনে হয়েছিল আল্লাহ পাক কাবা ঘরের সামনে নারী পরুষ পাশাপাশি আমাদের নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়েছেন বলেই পড়তে পারছি।।
এখন বাংলাদেশের অনেক মসজিদেই নারীদের তারাবিহর সহ নামাজ পড়ার ব্যবস্হা করে দিয়েছেন।।
বি,সি,এস পরীক্ষায়, বিচারক নিয়োগে, সেনাবাহিনী,নৌবাহিনী,বিমানবাহিনী, পুলিশ বাহিনী,গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনী,ব্যংকার্স রিক্রুটমেন্ট,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, কাজী নিয়োগ, ঝড়তুফান উপেক্ষা করে সাংবাদিক হিসেবে সংবাদ সংগ্রহে,পাইলট হিসাবে বিমান চালনা,রেলগাড়ী চালানো, উকিল হিসেবে মামলা পরিচালনা কোন দিকে নারী অনগ্রসর? নারীস্বাধীন পেশায়, সে শারীরিক ভাবে সক্ষম বলেই নিয়োগদাতা আবেদন পত্রে নারী পুরুষের একই আবেদন ফরমদিয়েছে কোন প্রকার বৈষম্য নেই, যা পূরন করে নারী প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ লাভ করে।নিয়োগ দাতা ঋতুবতী থাকাকে যদি প্রতিবন্ধকতা মনে না করে,শর্ত জুড়ে না দিয়ে চাকুরী অংশগ্রহনের সুযোগ দেন তাহলে নারী রজন্য অপমানকর , লজ্জাজনক বক্তব্য দিয়ে তাকে বন্চিতকরা সংবিধান লংঘনের সামিল।
নারী তার সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায় কারো দয়া দক্ষিন্যে নয়।নারী এখন অবলা শক্তিহীন নয়। নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে ইতিবাচক হোন,মূল্যায়ন করুন তার প্রজ্ঞা,মেধা,বুদ্ধি, মননও মনকে সর্বোপরি মানুষ হিসেবে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট।

শেয়ার করুন

Leave a Reply