নারী ও শিশু নির্যাতন : সভ্য সমাজের বর্বর বার্তা

মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান ::
দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষ করে ধর্ষণ, হত্যা ও যৌন নিপীড়নসহ পারিবারিক নির্যাতন উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। ক্ষমতাবলয়ের কাছাকাছি থাকা দুর্বৃত্তরা এ ঘটনা বেশি ঘটাচ্ছে। এটি এখন অনেক পরিবারের স্ত্রী, বোন ও কন্যা সন্তানদের রক্ষায় আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক মুহুর্তও চোখের আড়াল করা যাচ্ছে না, আড়াল হলেও আতংকের মধ্যে থাকতে হচ্ছে যে কখন তারা নিরাপদে ঘরে ফিরবেন।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে বলেছে-এ সময়কালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৮৯ জন নারী, যার মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৯২ জন এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৯২ জন। এদের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪১ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন নারী। এসবের মধ্যে মাত্র ১২১টি ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে।
সংস্থার হিসাব অনুযায়ী জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে গৃহ নির্যাতন হয়েছেন ৩৯৭ জন নারী যার ৩৪ জন শিশু। এর মধ্যে হত্যা করা হয় ২৫৩ জনকে। এ সময়ে ২৯ জন গৃহকর্মী বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। ১০৭ জন নারীকে যৌতকের জন্য নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে ৫৫ জনকে হত্যা করা হয়। ১৭ জন নারীকে এসিডে ঝলসে দেওয়া হয়। এ সময়ে ৯৯০ জন শিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে যার মধ্যে ৪০৮ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। সরকারি হিসেবে হয়তো কিছু কম-বেশি হতে পারে। আবার অনেক ঘটনা আমাদের লোকচক্ষুর আড়ালেও থেকে যায়।

নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধ কঠোর হাতে দমনের উদ্দেশ্যে সরকার ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করেছে। এতে বলা হয়েছে এসিড নিক্ষেপের মাধ্যমে নারী ও শিশুকে ঝলসে দেওয়ার শাস্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং এক লক্ষ টাকা জরিমানা। অন্যান্যভাবে নারী নির্যাতনের শাস্তি জরিমানসহ সাত থেকে চৌদ্দ বছরের কারাদন্ড। নারী ও শিশু পাচারের শাস্তি সাত বছর কারাদন্ড থেকে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত হতে পারে। নারী ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও অর্থদন্ড। যৌতুকের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও অর্থদন্ড।
আইনের এমন কঠোর শাস্তি বিধানের পরও দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার কমছে না কেন, এর উত্তর খোঁজা জরুরি। যথাযথ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অপরাধের মাত্রা কমে আসবে-এতে কোনো সন্দেহ নেই। একইসঙ্গে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সর্বত্র জনসচেতনতা সৃষ্টির কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। ১৯৭২ সালে নবগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে তদানীন্তন সরকার নারী উন্নয়নকে অগ্রাধিকার প্রদান করে। সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছেন। এইতো সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সাল নাগাদ কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশে উন্নীত করার অঙ্গীকারের পাশাপাশি কোভিড–১৯ মহামারির প্রেক্ষাপটে তাদের চাকুরি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নারীর সমতা, ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের অঙ্গীকার নবায়ন ও প্রচেষ্টা জোরদারেরও আহ্বান জানান। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে উচ্চ পর্যায়ের এক ভার্চুয়াল বৈঠকে তিনটি বিষয় তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ১ অক্টোবর এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ২০১১ সালে একটি প্রগতিশীল নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। সংসদ নেতা, সংসদীয় উপনেতা, বিরোধী দলীয় নেত্রী ও স্পিকার নারী। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় ৩০ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। আর জনসেবাতে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, নারীরা এখন উচ্চ আদালতের বিচারক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং আরও অনেক কিছু হয়ে উঠছেন। জেন্ডার বাজেটিং, মাইক্রো ফাইনান্স এবং অনুরূপ উদ্যোগগুলো মহিলাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীদের ক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুফল বয়ে আনছে। আজ ২ কোটি নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে নিয়োজিত রয়েছেন। ৩৫ লাখেরও বেশি নারী তৈরি পোষাক খাতে কাজ করছেন, যা আমাদের বৃহত্তম রফতানি আয়ের ক্ষেত্র।
শেখ হাসিনা বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার নারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের নারীরা বাধা ভাঙছে এবং পেশায় সফল হচ্ছেন যা আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম কখনই কল্পনা করতে পারতো না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে সাফল্যের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী অনেক প্রশংসা অর্জন করেছে।

এ থেকে অনুধাবন করা যায় শুধু রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নারীর অধিকার ও উন্নয়ন আন্দোলনের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও কনভেনশনে অংশগ্রহণ করেছে এবং সমর্থন প্রদান করেছে। এ প্রেক্ষাপটে দেশে নারী ও শিশুদের নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হওয়ার বিষয়টি মেনে নেয়া যায় না। বস্তুত নারী নির্যাতন রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। নারীকে মা, বোন, স্ত্রী-এই দুষ্টিভঙ্গীতে দেখতে হবে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে আরও কার্যকর প্রতিরোধ কাঠামো গড়ে উঠবে-এমনটাই প্রত্যাশা।
পিআইডি ফিচার
লেখকঃ উপপ্রধান তথ্য অফিসার
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, পিআইডি, চট্টগ্রাম

শেয়ার করুন

Leave a Reply