ফজর আলীর ঈদ

মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী :
হজর ভাই, অনেক দিন পরে আপনাকে দেখলাম। কেমন আছেন?
– আস সালামু আলাইকুম, মিয়া। গরীবের একটা থাওন। আমাগো জীবনই কি মরনই কি? সবই এক সমান। এখনো মরি নাই । আল্লায় বাচাই রাকছে। আই বালা-ই আছি। যাক্, আন্নে কেমন আছেন, আন্নেরে ভারী সোন্দর লাগছে।
এক নিঃশ্বাসে আমাদের ছোট কালের গল্পবাজ হজর আলী ভাই তার মনের গহীন কোণে লুকিয়ে রাখা কষ্টের কথা বলে ফেললো। আসলে স্বল্প কথায় তার দৈহিক ও আর্থিক দৈন্যতার বিবরণ ফুটে উঠেছে। ছোট কালে তাকে দেখতাম কী তাগড়া যুবক! বয়স হবে আঠারো-বিশ। হাডুডু, গোল্লাছুট,দাড়িয়াবান্ধা, ঠাংগুলি, সাতার কোথায় তার জুড়ি নাই। কী তার নামডাক! উজ্জ্বল-শ্যামলা, ঘাড়-উঁচু, দীর্ঘাঙ্গী চেহারা। কবি জসীমউদ্দিনের নকশী কাথার মাঠের নায়ক রুপাই-এর মতো একহারা চেহারা। একনজরে সবার মন কাড়ে। হাডুডু খেলায় তাকে আটকানো কার সাধ্য। তিন-চারজনকে বাতাসের মতো উড়িয়ে নিয়ে আসতো। সে কি হাততালি, থামার উপায় নাই। হারু পার্টির সমর্থকরাও তাকে করতালিতে মুখরিত করতো। সাতারে মনে হয় এক ডুবে দরিয়া পার। কতো যে তার দম। কোথায় পেতো সে এতো শক্তি কে জানে?
বাপ-মা অশিক্ষিত। জায়গা-জমিও খুব একটা নাই। তিন ভাই তিন বোনের সংসার। হজর আলীর বাবার সহজ-সরল হিসাব। -লেখা-পড়া ধনী লোকের। আল্লায় আমাগো গরীব বানাইছে, গরীবই থাকতে অইবো। এইডাই আমাগো কপাল। ভাগ্য হরিবর্তন করতে হারতাম না। বড় সংসার। আই কি একা একা এত বড় সংসারের ঘানি টাইনতে হারবো? তোরাও একটু কাজ-কর্ম কর। সংসারডারে ধর। আরে বাঁচা।
বাপ-মার কথাতো ফেলে দেয়া যায় না। তাই অগত্যা বাপ-দাদার পেশায় নীরবেই যোগ দিল হজর আলী। সেই যে অল্প বয়সেই পরের জমিতে কাজ করার হাতেখড়ি তা চলছে অবিরত। বাবা এবং বড় দুই ভাইয়ের মতো সকাল- সন্ধ্যা অন্যের জমিতে কাজ করতে করতেই দিন কাবার।
একুশ কি বাইশ বছরেই তার বাবা হজর আলীকে বিয়ে করিয়ে দেয় উত্তর পাড়ার অছিমুদ্দীনের সুন্দরী কন্যা আলেয়ার সঙ্গে। অন্ধকার রাতের আলেয়ার মতোই তার রূপ। পুর্ণিমার চাঁদও হার মানায়। দু’জনেরই কি মিল। মনে হয় মণিকাঞ্চন যোগ। দেখতে দেখতে তাদের সংসার আলো করে এক-দুই-তিন-চারটি সন্তান এসেছে। বৃদ্ধ মা-বাবাও একদিন অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে বিণা চিকিৎসায় ইহধাম ত্যাগ করেছে। অন্য ভাইদের সংসারও বড় হয়েছে। নিজের অভাব-অনটনের সংসার। নিজ হালেই পানি পায় না। ভাই-বোনদের সংসারের ঘানিটানা আদৌও সম্ভব না। ফলে অন্য দশটা ঘরের মতো হজর আলীও আলাদা।
শাহেদ শাহরিয়ার। বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র। বয়স কম থাকায় মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। এটা তার জীবনের সবচেয়ে অপূর্ণাঙ্গতা , বড় আফসোসের বিষয়। স্বাধীনচেতা শাহেদ প্রথম থেকেই জাতির পিতার আদর্শের সৈনিক এবং প্রগতিশীল ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দুই বছর আগে মহান স্বাধীনতার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক খুনী খন্দকার মোশতাক চক্র এবং সেনাবাহিনীর কিছু পাষন্ড, পিশাচ সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। কুলাঙ্গার, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া সকল রাজনীতি,বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ করে দিয়েছে। এজন্য তার মন এমনি বিষিয়ে আছে। তবে, শাহেদের প্রিয় স্যার ক্লাসে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় পড়ানোর সময় অবৈধ সরকারের অবৈধ কার্যক্রমের তুলনা করার সময় ঠিকই কঠোর সমালোচনা করতে কুন্ঠাবোধ করতেন না। অন্তত এদিকটি শাহেদদের খুব পছন্দের। সামরিক শাসকরা প্রথমে চমকপ্রদ দুই একটা লোকদেখানো ব্যাপার দেখায়। তবে, এটা যে নিকৃষ্টতম ব্যবস্হা তা তারা বুঝতে তার কষ্ট হয় না । সেই বিক্ষুদ্ধ মন নিয়েই রোজার বন্ধে শাহেদ বাড়িতে।
গত দুই দিন অবিশ্রান্ত বর্ষণ । নদী-নালা, খাল-বিল, মাঠ-ক্ষেত সবই অথৈ পানিতে থৈথৈ করছে। ধান খেত পানিতে তলিয়ে গেছে, পাটগাছগুলো একটু-আধটু মাথা উঁচু করে কেন রকমে দাঁড়িয়ে আছে। এমনি হজর আলীর হাতে কাজ নেই। বাচ্চারা অভুক্ত। তাই বলে কি পেটের ক্ষুধা বন্ধ থাকে। এদিক সেদিক দুই চারটি নৌকা পাল তলে ছুটে চলছে। আর মাঝি মনের সুখে ভাটিয়ালি গান গেয়ে চলছে -মাঝি বাইয়া যাও রে… । এক সময় হজর আলীও পল্লীগীতির সমঝদার গায়ক ছিল। কিন্তু অভাবের জ্বালায় সেই মন কোথায় যে পালিয়ে গেছে। তাই তার মনে হচ্ছে “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় / পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি “।
ভাদ্র মাসের অঝোর বৃষ্টি একটু থেমেছে। হজর আলী ঘর হতে কাজের সন্ধানে বের হয়েছে। অবুঝ বাচ্চাগুলোকে কোন বুঝই দিতে পারছে না। বাড়ির পাশেই একটু উঁচু ঢিবি। আনমনে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। এমন সময়ই হাটতে হাটতে সেখানে উপস্থিত শাহেদ। ছোটকালে কতো কথা হতো তাদের -সুখ-দুঃখ, পাওয়া, না-পাওয়া। মেঘবৃষ্টির জন্যতো ঘর হতে বের হওয়ার উপায় নাই। হৃদয়বান এবং ভালো অবস্হাসম্পন্ন গৃহস্থের সন্তান শাহেদ । তাকে দেখে কলিজায় একটু পানি এসেছে। তার থেকে যদি কোন আশার বাণী শোনা যায়।
শাহেদ হজর আলীর সালামের জবাব দিয়ে তার দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলো। হায় আপসোস! একি দশা। কোথায় সেই তাগড়া যুবক? চোখ দু’টি কোটরাগত, মাথার চুল অনেকটুকুই উঠে গেছে। হাত-পা দেখেই বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার আর্থিক দৈন্যতার করুন চিত্র। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে হজর আলীর কাঁধে হাত রাখে শাহেদ। মনে হয় কতো আপনজন এভাবে তাকে সান্ত¡না দিচ্ছে । একটু আদুরে স্পর্শ দিল অভাগার কংকালসার দেহে। হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় ছোট কালের কথা। অভাবী সংসার। তাতে কী। কতো আদর যতœ করতো অভাগী মা। ঝরঝর করে অঝোর ধারায় অশ্রæ বর্ষিত হলো। মা-বাবা জীবিত থাকলে অন্তত সান্ত¡নার বাণী শুনাতো। সেই কপালও আল্লাহ রাখে নাই। ভাই-বোন, শ্বশুর বাড়ি সবই হতভাগার দলে। কথায় বলে -অভাগা যে দিকে তাকায়,সাগর শুকিয়ে যায়।
যেই চেহারা, কিভাবে বলি -শাহেদের মনে প্রশ্ন। তবুও রোজার দিন। বিশেষ করে গরীব লোকেরা অধিকতর ধর্মপরায়ন। তারপর আমতা আমতা করে প্রশ্ন শাহেদের।
-হজর ভাই, রোজা আছেন?
– গরীবের আর রোজা। সারাবছরই রোজা রাখি। কচু-গেচু, হাবি-যাবি খাইয়া কোন রকমে বাইচ্চা আছি। কোন দিন এক বেলা, কোনদিন আধা বেলা। এই আর কি। এমনিই অভুক্ত থাকন লাগবো। ভাই আইজ রোজা রাখছি।
– অনেক বেলা হলো। ইফতার করবেন না?
– এডাতো আমাগো কাছে স্বপ্ন। এক মগ পানি আর দুই মুট উরুম খাইয়া রোজা বাঙ্গবো।
-ছোলা, বুট, পিয়াজু এগুলো কখনো খান?
– ভাইরে মস্করা কইরেন না। এমনি মনে অনেক জ্বালা। এ গুলি গরীবের হক না, আপনেগো জন্যে আল্লায় বানাইয়া দিছে। তবে, মসজিদে হুজুরে কইছে – গরীবের বিচার কম হইবো। আল্লাহ যদি কপালে রাখে পরকালে জান্নাতে আছুদা হুরাইয়া খাইব।
কথা প্রসঙ্গে আরও যোগ করে হজর আলী।
– সেদিন বাজারে ইস্তারের আগে দেখছি -একজন বলে কইরা চনাবুট বেচার জন্য বইসা রইছে। কয়েকটি হোড়া মরিচের লেজ উরপে দিয়া সাজাইয়া রাখছে। দেখতে কী সোন্দর! ইচ্ছা করছিল দুই আনার কিন্যা খাই। কিন্তু মনে সায় দিল না। গরীব অইতে পারি। অতো নাদান না। বউ -বাচ্চাদের কথা মনে হইড়া গেল। আর কিনতে সাহস হাই নাই। জিব্বারে কইলাম- থাক, আতে হইসা অইলে বাজারতেন বেশি কইরা কিন্না নিয়াম। হগলে মিল্লা বাড়িত একসাত খাইয়াম। গরীবের কতো কিছুই মন চায়। সাধ আছে, সাধ্য কই রে, ভাই।
বর্ষার ঘনঘটা আকাশের অবিরাম কান্না আর কতো। থামার কোন জো নাই। একদিকে জোয়ারের পর জোয়ার। অন্যদিকে আকাশ ফেটে বৃষ্টির পানি। এতো পানি আকাশে জমলো কিভাবে? কিভাবে পিলার, খিলান, ভরহীন আকাশ এতো পানি ধরে রাখে কে জানে। গ্রামের সবই কাঁচা রাস্তা। পানিতে তলিয়ে গেছে। এদিকে মনে হয় আকাশের মেঘ একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। মানুষের দিকে চোখ তুলে তাকাবে। সূর্যতো কয়দিন দেখাই যায় নাই। কি দিন কি রাত বুঝার উপায় কই। তবে, আদিকাল হতে দেহ গড়ির মাধ্যমেই গ্রামের সাধারণ মানুষ ঘড়ির কাজ করে ফেলতো। আন্দাজ করে সময় বলতো। সময় যে একবারে আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়- তা নয়। পশ্চিম আকাশের একটু লালাভ আভা ফুটে উঠেছে। এমন দৃশ্য দেখে শাহেদ পুলকিত হয়ে উঠে। হাতে কিছু সময়ও আছে। কিছু মানুষের জটলা দেখে সামনে এগুতে চায়।
শাহেদ হজর আলীকে অনুরোধ করলো। চলেন, ঐদিকে যাই। হজর আলী আমতা আমতা করে। বাচ্চাগুলা কয়দিন পেট ভরে খায় নাই। বড়লোকের শিক্ষিত ছেলে আমাদের দুঃখ বুঝবে কেমন করে? পেটের জ্বালা যে কী নিদারুণ কষ্টের সেটা গরীবেরা কেবল বুঝে। শাহেদের সামনে বউ-বাচ্চা পড়লে আরও লজ্জার ব্যাপার হবে। কিন্তু হায় কপাল! যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। নিজেকে নিজে প্রবোধ দেয়- আল্লায় বানাইচে, রাখ-ডাক করার কিছুই নাই। সন্তানদের না খাওয়াইয়া সম্পদের পাহাড় বানাইয়চি -এমনও না।
বৃষ্টি থেমেছে বেশ আগে। খড়কুটা দিয়ে তৈরি ঘরে পানি পড়া বন্ধ হয় নাই। ঘরের পাশেই একটা গরু ঘর। কোনটা বসতঘর আর কোনটা গরুঘর তা বুঝে উঠতে শাহেদ রীতিমতো গোলকধাঁধায় পড়ে গেছে। খড়কুটার অভাবে গরুর হাড় আর হজর আলীর বউয়ের শরীর একাকার। পরনে ছেঁড়া কাপড়। পুরোবাড়ি যেন পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের ” আসমানী” কবিতার প্রতিচছবি। নিজে নিজে আওড়ায় ” বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি /একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি। … পরনে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস”। শাহেদ মনে মনে ঘৃণা প্রকাশ করে -কই সরকার, কি করে তারা? আবার নিজেই নিজেকে উত্তর দেয় – জাতির পিতার খুনীদের কাছে কি-ই চাওয়ার আছে। সারাদেশের অবিকল চিত্রই এটা।
শাহেদকে দেখে আরও কয়েকজন এগিয়ে আসে। পরষ্পর কুশল বিনিময় করে। সামনেই ঈদ। হয়তো বড়লোকের শিক্ষিত বাবুসাহেব তাদের জন্য কোন বিশেষ কিছু নিয়ে এসেছে। অবশ্য হাতে কিছু না দেখে বড়োরা হতাশ। তবুও একটু আশার বাণী শোনা। মন্দ কি। এ সময়ে ঘরের থেকে একজন জোরে হাকাইয়া উঠলো- হইজ্জা কই রে, রাইতে ডালাশিয়ার কইরাম। টেডা আর বাতি ঠিক কইরা রাখিস। রাশেদ জিজ্ঞেস করলো- কে আপনাকে ডেকেছে?
– আর আমাগো খইল্যা ভাই।
-ও আচ্ছা। মাছ-টাছ পাওয়া যায়?
গর্বের সঙ্গেই জবাব হজর আলীর। কতোদিন হেট ভইরা ভাত খাই নাই। রাইত-বিরাইতে এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি করলে বিভিন্ন রকমের মাছ ধরতে পারি। ছোট কালের ডাংগুলি আর মার্বেল খেলার হাত। একবারে নিঁখুত। তার হাত থেকে মাছ পালিয়ে যাবে সেই বিদ্যা মাছের নাই। জবাব হজর আলীর
-ভাই, দুই তিনডা আডার রুডি, কচু, হাতা-লতা, হাপলা, খেঁসারির ডাইল আর মাছ দিয়া কোন রকমে আমি আর রাজার মা সেহেরি খাই। কয়ডা মাছেই গরীবদের বাচাই রাখচে। আর উরুম দিয়া ইস্তার করি। এইভাবেই চলছে আমগো গরীবের সংসার। এই বলে অনেকটা তৃপ্তির ঢেঁকুর – আলহামদুলিল্লাহ। ভাই, মনে কিছু নিয়েন না। হজর আলী আরো যোগ দিল। আমগো গরীবের জন্যই গম- আডা। আডা বড়লোকেরা খায় না। বাজারতেন আডা কিনার সময় কিছু মানুষ চাইয়া থাহে। মুখে কিছু কয় না। কিন্তু মনে মনে ভাবে আর কইতে চায় -এরা গরীব মানুষ । আর আমরা ভাবি -চাইলের থেইক্যা আডার দাম কম, বরকতও বেশি। দুই-তিনডা রুডি খাওয়ার পর ডগডগ কইরা দুই তিন মগ হানি খাইলে হেড ভর্তি। অনেকক্ষণ থাহা যায়।
এদিকে হাটের দিন কাল। ঈদের আগে শেষ বাজার। চারিদিকে আওয়াজ। ঝটলার মধ্যে একজন বলে ফেললো, আহারে, রোজা শেষ। বালা দিন বেশি সময় থাহে না। কহন আইলো, কহন যাইতাছে বুঝতেই হারি নাই। আল্লার দিন আল্লাই নিয়া গেছে।
এমন সময় হজর আলীর ছোট ছেলেটা এসে হজর আলীর গলায় ধরে আকুতি করে বললো,- বাজান , কাইল ঈদের বাজার। আই আন্নের সঙ্গে বাজারে যাইয়াম। একটা লাল জামা আর একটা লাল হাপপেন কিন্না দিতে অইব। অই বাড়ির সবুজ লাল জামা আর লাল হাপপেন হরে। কি সুন্দর লাগে! মার থেইক্যা চার আনা নিমু। একটা বাশি আর লাল হোটকা কিনুম। সারাদিন বাজাইয়াম। কিন্না দিলে মায় একটু লাল সেমাই মিডাই দিয়া রাইন্দা দিব। খাইয়াম আর বাশি বাজাইয়াম। কী মজা কী মজা।
হজর আলীর চোখের কোণে দুই ফোটা অশ্রæ। আহারে! এই অবুঝ শিশুর চাওয়া কি অনেক বেশি। আবদার কি পাহাড়তুল্য? কিউবা দোষ তার। মনে মনে ঘৃণা হয়- গরীবের পিতা হয়ে জন্ম হওয়া কি অপরাধ? মানুষের কি কোন সাধ-আহ্লাদ থাকতে পারে না? হায়রে কপাল! গরীবের ঈদই কি চাঁদ বা কি। কেবল দীর্ঘ শ্বাস ছাড়া আর কিছুই নাই। নিষ্পাপ শিশুটি গলা ছাড়ে না। অগত্যা মিথ্যা আশ্বাস দেয় – হয় বাবা, কিন্না দিমু। ছেলেও নাছোড়বান্দা। গতবারও কইছিলা। কিন্তু কিন্না দেও নাই। মারে কইছিলাম। মায় কোন উত্তর দেয় নাই। কেল কাঁদে। একটাই হারে- কাঁন্দা আর কাঁন্দা। মার কাঁন্দা দেইখ্যা আরও কাঁন্দা আসে। বাজান মায় কিল্লায় কান্দে? সবাই লা জবাব। এই অবুঝ শিশুটি কি নিষ্ঠুরতম সত্যই অবলীলায় প্রকাশ করলো। কে দিবে এর জবাব?
হজর আলী মনে মনে ভাবে- পোলাও,কোরমা, গোশতো, সেমাই, চিনি এগুলি স্বপ্নেও কখনো খাইতে দেহি নাই। কতো জন কতো স্বপ্ন দেহে। স্বপ্নেও যদি এমন খাবার খাইতে হাইত্তাম, তবুও জীবনডা সার্থক হইতো। একটু পাতলা তারি খাইলেই অমৃত লাগে, পরানডা জুড়াইয়া যায়। সেডাও ভাগ্যে নাই। সেখানে ধনীর দামী খাওন। থাক, দরকার নাই।
হজর আলীর মুখটা ঘোর অন্ধকার হয়ে গেছে। শাহেদ বুদ্ধিমান। বুঝতে অসুবিধা হয়নি। আর মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য সাজেশন দিল।
-হজর আলী ভাই, নতুন জামা কাপড় আসলে অনেকেই কিনতে পারে না। এক কাজ করেন -নিক্সন মার্কেট হতে কিছু পুরান কাপড়-ছোপড় কিনে দিতে পারেন। দামও কম। আর টিকে অনেক দিন।
– সাহেব এডা ছাড়া আমাদের আর কি পথ আছে? আমরা পুরান কাপড় পুইরাই বাইচ্চা আছি। এই মার্কেট হগলেই চিনে। এই যে গতর ডাইক্কা রাখছি, এডাও ঐ নিক্সন মার্কেটের।
এ বিষয়ে শাহেদও অভিজ্ঞতা কম নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল হতে ছাত্ররা দলেবলে গুলিস্তানের নিক্সন মার্কেটে যায়। আর পছন্দসই শার্ট-প্যান্ট কিনে। প্রয়োজনে অল্টার করে নেয়। সারাদেশের যে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা। এর থেকে ভালো কিইবা হতে পারে। শাহেদ আরও যোগ দেয়। দেশের বাজেটই ঘোষণা করা হয়ে থাকে বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতার উপর। অথচ কতো বড় স্বপ্ন নিয়ে জাতির পিতা দেশটি স্বাধীন করে দিলেন। কোথায় সেই স্বপ্ন, কোথায় বাস্তবতা, কোনদিকে যাচ্ছে দেশ। সঠিক কোন লক্ষ্য পর্যন্ত নাই।
হঠাৎ শাহেদ প্রসঙ্গ অন্যদিকে টেনে নিল। আচ্ছা ভাই, আপনার আসল নাম কি, আপনার ভাই আপনাকে হউজ্জা নামে ডাকলো কেন? হজর আলী নিরক্ষর হতে পারে। কিন্তু নির্বোধ নহে। জবাব দিল।
– মায় কইচে ভোরে ফজরের নামাজের সময় আর জন্ম হইছে। এই জন্য আর নাম রাকচে ফজর আলী। গরীব মানুষ। খাইতেই হাই না। শুদ্ধ কইরা নাম ডাকলেতো আরো লজ্জা লাগবো। এই জন্য গরীবের নাম একটু উল্টাপাল্টা কইরা সবাই ডাহে। এতেই খুশি। আরও একটু বললো।
– আর বউ কার কাছে রাজা নাম শুইনা আছে। তার নাকি খুউব বাল লাগছে। আরে কইলো। ছোড বাচ্চাডার নাম রাখবো রাজা। আরে যাদু বাতেই বাইচত না, নাম আবার রাজা। হাসির খোরাক আর কি।
ঠিক কথাই বলছেন হজর আলী। প্রকৃত নাম ফজর আলী, নামটি অনেক সুন্দর। তাচ্ছিল্য করে আবার ডাকে হইজ্জা। অথচ শিক্ষিত হলে, এমনকি শিক্ষিত না হলেও টাকা-পয়সাওয়ালা হলে এই হজর আলী হয়ে যেতেন জনাব ফজর আলী সাহেব । সামনে পিছনে আরও কতো বিশেষন। কেবল স্থান-কাল-পাত্রভেদে একই মানুষের সামাজিক অবস্থা আর অবস্থানের কতো পার্থক্য। অবশ্য এই নিয়ে সাধারন মানুষের কোন ভাবনা নাই, সময়ও নাই । তেমনি ভাবনা অর্থনীতির ছাত্র শাহেদের। অবাধ, মুক্ত এবং পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্হায় আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের রূপ একই।
ইফতারের সময় সমাগত। দূর হতে বাড়িতে যাওয়ার ডাক পড়েছে শাহেদের। যাবেই তো। ধনীর দুলাল, আদুরে ছেলের জন্য তার মা কতো রকমের ইফতার তৈরি করে রেখেছেন। সাজিয়ে রেখেছেন। নিজের হাতে ছেলেকে খাওয়াইবেন। তাকেতো কাছে পাওয়া যায় না। শাহেদ এটা-ওটা পছন্দ করে, মজা করে খাবে। আর মা তৃপ্তি সহকারে দেখবেন, প্রাণভরে তাকাবেন। সেই খাওয়ানো আর তাকানোতে কতোই না আনন্দ। মায়ের মন ভরে যায়।
শাহেদ পকেটে হাত দিল। একশো টাকার একটা টাকার নোট আছে । সামনে আবার অনেক মানুষ। কৌশলে এবং চুপেচাপে নোটটি হজর আলীর হাতে গুজিয়ে দিয়ে কাদামাখা রাস্তা দিয়ে সোজা বাড়ির দিকে। আর যতদূর দৃষ্টি যায় হজর আলীর দুই চোখ তাকিয়ে রয় হৃদয়বান বড়লোক শাহেদ সাবের দিকে। কতো বড় ভাগ্য এই সাবদের। যা ইচ্ছা করে মন ভরে খেতে, পরতে পায়। সেদিকে হজর আলীর আফসোস নাই। তবে, মন থেকেই দোয়া করেন শাহেদের জন্য। কে কাকে দেয়। এবার অন্তত ছোট ছেলেটার জন্য কিছু কিনে দিতে পারবে। খুশিতে তার মনটা ভরে গেছে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আস্তে আস্তে অন্ধকার গ্রামকে গ্রাস করে ফেলেছে। গাছের ফাঁকে কয়েকটি দোয়েল পাখি সন্ধ্যার আগমন বার্তা জানিয়ে দিল। বর্ষার থৈথৈ পানির মধ্যে দূরে কোথাও হয়তো নাক গজানোর উঁচু জায়গা আছে। সেখান থেকে শিয়ালের হুয়াক্কা হুয়া ডাক ফজরের কানে ভেসে আসলো।
সবাই ঘরে ফিরে। সে মনে মনে ভাবে ঘরে গিয়ে কি আর হবে। না গিয়েই উপায় কি। বড়লোকদের ইফতার আর গরীবের ইস্তার। তাও তার কপালে জোটবে না। এটাই তার নিয়তি, এটাই ভাগ্য। চারিদিকে শুধু অভাব আর অভাব। ঈদ-চাঁদ, সারাবছর সবই সমান।

 

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply