বিজ্ঞান চর্চা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ড্রাইভার একদিন আইনস্টাইনকে বললেন, ‘স্যার আপনি প্রতিটি মিটিংয়ে যে বক্তৃতা দেন সেগুলো শুনে শুনে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।’ এই কথা শুনে আইনস্টাইন বললেন, ‘বেশ তাহলে এর পরের মিটিংয়ে তুমি আমার হয়ে বক্তৃতা দিও, আর আমি গাড়ীতে ড্রাইভার সিটে বসে থাকবো’। একদিন এক সভায় ড্রাইভার হুবহু আইনস্টাইন-এর বক্তৃতা গড় গড় করে বলে গেলেন। উপস্থিত বিজ্ঞজনেরা তুমুল করতালি দিলেন। এরপর তাঁরা ড্রাইভারকে আইনস্টাইন বিবেচনায় নিয়ে গাড়িতে পৌঁছে দিতে এলেন। সেই সময়ে একজন অধ্যাপক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, আপনার বক্তৃতায় যে আপেক্ষিক সূত্রটি তুলে ধরলেন, আর একবার বিষয়টি সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলে ভালো হতো।’ আসল আইনস্টাইন দেখলেন এবার তো ড্রাইভার ধরা পড়ে যাবে! এসময়ে আসল আইনস্টাইন ড্রাইভারের উত্তর শুনে তাজ্জব বনে গেলেন। ড্রাইভার উত্তর দিল, ‘এই সহজ বিষয়টা আপনার মাথায় ঢোকেনি কেন বুঝলাম না! আমার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করুন সে তা বুঝিয়ে দেবে।’ তারপর আইনস্টাইন…
বিজ্ঞানী হই বা না হই তবুও আমরা বিজ্ঞান নিয়ে ভাবি। আমাদের জীবন এমনভাবে বিজ্ঞান-মুখাপেক্ষী হয়ে উঠছে যেন আমরা সচেতন অথবা অবচেতন মনে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার গভীর সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি, অথচ কিছুই টের পাচ্ছি না। নোবেলজয়ী বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এক্ষেত্রে একটু এগিয়ে ছিলেন। কথিত আছে একবার তিনি ট্রেনে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। টিকেট চেকার এসে টিকেট চাইলেন। কিন্তু আইনস্টাইন কিছুতেই টিকেট খুঁজে পাচ্ছিলেন না। চেকার বললেন, ‘স্যার, আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি নিশ্চয়ই টিকেট কেটেই উঠেছেন। আপনাকে টিকেট দেখাতে হবে না।’ আইনস্টাইন চিন্তিত মুখে বললেন, ‘না না! ওটা তো খুঁজে পেতেই হবে! না পেলে কী করে জানব, আমি কোথায় যাচ্ছিলাম!’ আমার বিজ্ঞান নিয়ে ভাবনার বিষয়টি অনেকটা সেরকমই।
বিজ্ঞানের প্রধান দুটি শাখার মধ্যে তাত্তি¡ক বিজ্ঞান তত্ত¡ বা সূত্র আবিষ্কার করে। আর সে সূত্রগুলো ব্যবহার করে ফলিত বিজ্ঞান মানবসমাজকে উপহার দিচ্ছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি। কালের পরিক্রমায় এই প্রযুক্তি ক্রমাগতভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তিকে লুফে নিয়ে, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে মানুষের জীবনযাত্রাকে সুন্দর, সহজ ও সহায়ক করে তুলছে। নানা প্রযুক্তিজাত উপকরণ বা উপাদানের বিস্তৃতির মাঝে যেমন নিহিত আছে মানবকল্যাণ, তেমনি আছে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশা। এ দুটোর মধ্যে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে নিয়ে বিতর্কে যেতে চাই না।
বর্তমান বিশ্বে প্রায় সকল বিষয়েরই অগ্রগতি নিয়ন্ত্রিত হয় বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। তাই বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। বিজ্ঞানের ক্ষেত্র প্রধানত প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান। জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নসহ এ ধরনের সকল বিজ্ঞান প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে মানুষের আচার-ব্যবহার এবং সমাজ নিয়ে যে বিজ্ঞান চর্চা হয় তা সমাজ-বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাকর্ষ তরঙ্গের ওপর ভর করেই চলছে মহাবিশ্ব। পৃথিবীর ঘূর্ণন, গ্রহ-নক্ষত্রের গতি সব কিছুই ঘটছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কারণে। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্তে¡ই তরঙ্গ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সম্পর্কিত আইনস্টাইনের তত্ত¡ নির্ভুল।
প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে পৌনঃপুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও উদ্ভাবনের যৌক্তিকতা ও কার্যকারিতা গৃহীত হয়ে থাকে। জলবায়ুর পরিবর্তন পৃথিবী ও জীববৈচিত্র্যের ভবিষ্যৎকে কোন পথে নিয়ে যাবে তাও ভাবনার বিষয়। আমাদের এই বিশ^ব্রহ্মাÐে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র যা কিছু আছে তার সবই সীমিত সংখ্যক মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত। কোনো পদার্থকে যদি আমরা ক্রমাগতভাবে ভাঙতে থাকি তাহলে ভাঙতে ভাঙতে তা অণু-পরমাণু পর্যায়ে চলে যাবে। পরমাণুর ভেতরে আছে প্রোটন, নিউট্রন এবং ইলেকট্রন, যাদেরকে খালি চোখে দেখা যায় না, এমনকি সবচেয়ে অতিআণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও না। তবে গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কেবল অনুভব করা যায় যে, বস্তু তার আপন বৈশিষ্ট্য ও অস্তিত্ব হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে এক জাতীয় তরঙ্গ-ফাংশন বা আলোককণায়। অথাৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বস্তুর মূলে গেলে তাকে আর বস্তু হিসেবে খুজে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় প্রচÐ এনার্জি বা শক্তি হিসেবে।
বিজ্ঞানীদের চমকপ্রদ সব আবিষ্কার, চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া সব প্রযুক্তি, আমাদের বদ্ধমূল ধারণাকে ওলটপালট করে দেয়। ভোক্তা হিসেবে আমরা আমাদের চাহিদা মেটানোর জন্য সেগুলো গ্রহন করি, উপভোগ করি, উপকার পাই। একটা বিকল হওয়ার আগেই ছুড়ে ফেলে দিই, তারই উন্নত সংস্করণের আরেকটা সংগ্রহ করি। এভাবে দিনে দিনে আমাদের জীবন বৈচিত্র্যে, আনন্দে আর উত্তেজনায় ভরপুর হয়ে উঠছে। আজকাল প্রযুক্তির ওপর আমরা এমনভাবে নির্ভরশীল পড়েছি যেন নিজেদের অন্নটা পর্যন্ত নিজ হাতে উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করে খাবার টেবিলে হাজির করতে চাই না। পরনের কাপড়সেও তো প্রযুক্তিরই ফসল। চিকিৎসাসেবা ও ঔষধপত্রের একই হাল। ছেলেমেয়েদের পাঠদান ও পাঠগ্রহণ প্রযুক্তির কোমল স্পর্শ ছাড়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে বিজ্ঞান ও যান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থা আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করছে কিনা জানি না, তবে আমি মনে করি, প্রযুক্তির কারণে আমাদের জীবনযাপন হয়েছে অনেক সহজ, সুন্দর ও আরামদায়ক। এই মনে করাটা কতটা নির্ভুল ও যৌক্তিক তাও যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়।
বিজ্ঞানীরা জলে, স্থলে ও মহাশূন্যে বিরামহীনভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার করে মনুষ্যসমাজকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন! জীববিজ্ঞান এমন সব গবেষণা ও আবিষ্কার করে চলেছে যে, মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ তৈরি ও প্রতিস্থাপন করে জীবকে সচল করে দিচ্ছে। অনেকে এখন মনে করতে শুরু করেছেন, বিজ্ঞানের গতি অপ্রতিরোধ্য, শক্তি ও ক্ষমতা অসীম! তাঁরা বলে থাকেন, ‘সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন বিজ্ঞান মানুষকে অমর প্রাণীতে পরিণত করে দেবে। মানুষ গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়াবে। পৃথিবী নামক এই সবুজ গ্রহের বাইরে গিয়ে বসতবাড়ি গড়বে ইত্যাদি ইত্যাদি। স্টিফেন হকিং মনে করতেন, মানুষের এখন পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার কথা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা উচিত। নরওয়ের একটি বিজ্ঞান ও শিল্পোৎসবে তিনি বলেন, অন্যান্য গ্রহে ছড়িয়ে পড়লে হয়তো মানুষ নিজেদের হাত থেকে বাঁচতে পারবে। আমি মনে করি মানুষের এখন পৃথিবী ছাড়াই উচিত। এলিয়েন পৃথিবীতে এলে ঘটনাটি কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতো ঘটনা হবে। বিজ্ঞানের এমন সাফল্য মানুষের চিন্তাজগৎকে প্রতিনিয়ত নতুনভাবে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। ইদানীং বিজ্ঞানমনষ্করা আরও ভাবতে শুরু করেছেন যে, বিজ্ঞান পারে না, এ জগতে এমন কিছু নেই। আজ হোক, কাল হোক, বিজ্ঞান মানুষের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে দেবে। মহাসৃষ্টির সকল অজানা রহস্যের দুয়ার খুলে দেবে। এই হলো আগামী দিনে বিজ্ঞানকে নিয়ে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার কথা।
বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক অর্জন হলো জিন এডিটিং করার মাধ্যমে প্রাণীর ডিএনএতে সংযোজন বিয়োজন করে নিজের মতো করে প্রাণী তৈরি করা। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে মানুষের জিন এডিটিংকে সীমা লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয় এবং এ ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্টিফেন হকিং মনে করতেন, একদিন এ পদ্ধতিতে সুপার-হিউম্যান তৈরি করা হবে। স¤প্রতি প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ-সংকলন ‘ব্রিফ অ্যান্সার টু দ্য বিগ কোয়েশ্চেনস’ বইতে তাঁর এ ধারণা ব্যক্ত হয়েছে। তাঁর মতে এ সুপার-হিউম্যানরা ক্রমোন্নতি করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রতিযোগিতা এক ধরনের কৃত্রিম জীবনের জন্ম দেবে, যারা মানুষের সকল বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যাবে।
প্রাণিজগৎসহ মহাবিশে^র সবখানেই ক্রমাগত একটা পরিবর্তনের আলামত লক্ষ করা যায়। ক্রমাগত পরিবর্তনের এই ধারাবাহিকতাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বিবর্তন বলে। ব্রিটিশ প্রকৃতি-বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের একটি বিশেষ দার্শনিক মতবাদ হলো ‘বিবর্তনবাদ’, যা ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ মতবাদে সুষ্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। এ মতবাদের একটি গভীর অন্তর্নিহিত দিক রয়েছে, যা হলো, মানুষ নি¤œশ্রেণির প্রাণী থেকে আবর্তিত হয়েছে এমন এক প্রক্রিয়ায়, যে প্রক্রিয়ায় বানর, বেবুন, শিম্পাঞ্জি, ওরাং-ওটাং ইত্যাদির উদ্ভব হয়েছে তাদের পূর্ব-প্রজাতি থেকে। পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষের সাথে কথিত প্রজাতিগুলোর এত এত মিল খুঁজে পাওয়া যায় যে, যে কেউ মনে করতেই পারেন, ‘মানুষ এবং ঐ প্রাইমেটগুলোর উৎপত্তির উৎস এক ও অভিন্ন। অষ্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী গ্রেগন জোহান মেন্ডেলের বংশগতির সূত্র আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত ও সর্বজনীন বলে গৃহীত। তাঁর সূত্র প্রয়োগ করে জীব-প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটছে।
মানুষের মাঝে যেমন পশুর বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, তেমনি কিছু কিছু পশুর মধেও কাক্সিক্ষত ও পরোপকারী গুণাবলি লক্ষ করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ, মানুষ পশুর মতো খাওয়া-দাওয়া করে, ঘুমায়, বংশ বিস্তার করে, আবার অন্যান্য প্রাণিকুলে মানবের মতো বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন- পিঁপড়া, মৌমাছি ও বানরসহ অসংখ্য প্রাণীদের বুদ্ধি আছে এবং তারা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। ঘোড়া, গাধা, কুকুরের মাঝে আছে প্রগাঢ় প্রভুভক্তি ও আনুগত্যবোধ। বাঘ, সিংহ, চিতা, হাতিসহ অনেক প্রাণীই মানুষের অনেক কাজ করে দেয়। প্রায় সকল প্রাণীই মানুষের মতো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়। প্রজন্মের প্রতি তাদের মায়ামমতারও কমতি নেই। পশুরও রাগ আছে, ক্ষোভ আছে, আবেগ আছে, আছে উচ্ছ¡াস। পশু হিং¯্র হয়, মানুষ হিং¯্রতায় পশুকে অহরহ হার মানায়। অতএব, প্রকৃতি-বিজ্ঞানের মতে, মানুষ পশুরই এক উন্নত সংস্করণ। ‘বিবর্তনবাদ’ যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে সামনে এমন একদিন আসবে যখন মানুষ আর মানুষ থাকবে না, ‘অতিমানুষ’, ‘মহামানুষ’, ‘অধঃপতিত মানুষ’ কিংবা ‘অভিনব মানুষ’ নামে অন্য কোনো প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। এভাবে ক্রমাগত তার ক্রমবির্বতন চলতেই থাকবে।
মানুষের সঙ্গে পশুর হাজারো মিল থাকতে পারে। কিন্তু কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য আছে। প্রথমত, পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যার চাহিদা সীমাহীন। পশু-পাখির চাহিদা তাদের পেট ভরাবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু মানুষের চাহিদার কোনো সীমারেখা নেই। একটি বিশেষ চাহিদা পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো হাজারো চাহিদার দুয়ার খুলে যায়। দুটো কঠিন বাস্তবতা মানুষের এই অসীম চাহিদার লাগাম টেনে ধরে রেখেছে। তার একটি বস্তুতান্ত্রিক এবং আরেকটি নৈতিক। প্রথমত, মানুষ যত বিত্তশালীই হোক না কেন, দিনের শেষে তার সম্পদ সীমিত। চাহিদার মাঝেই তাঁর জন্ম এবং অপূর্ণ চাহিদা নিয়েই সে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। দ্বিতীয়ত, মানুষ তার নিজের জন্য বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। তৃতীয়ত, মানুষের মর্যাদা পশুর চেয়ে অনেক অনেক উপরে, কারণ মানুষ বিচার-বিবেচনাসম্পন্ন প্রাণী।
বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাছে আমরা ঋণী। আগুন, চাকা, বিদ্যুৎ, গাড়ি, উড়োজাহাজ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন, পেনিসিলিন, অ্যানেস্থেশিয়া, এমআরআই, মহাশূন্য যান, উপগ্রহ প্রযুক্তি ইত্যাদি সবই বিজ্ঞানের অবদান। এগুলো আমাদের জীবন, জীবনযাত্রা ও চিন্তাচেতনার দরজা খুলে দিয়েছে। বৈজ্ঞানিক উপকরণ ছাড়া আজকাল আমরা এক মুহূর্তের কথাও ভাবতে পারি না। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জীবনের জন্য যত কিছু তৈরি করেছে তার কোনোটিই নির্ভেজাল নয়। তাই বলে একথা বলা ঠিক হবে না যে, আজই আমি গাড়ি চড়া, ইন্টারনেট ব্যবহার কিংবা ডাক্তারের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দেব। আমি বলতে চাই, একদিকে বিজ্ঞানের সম্ভাবনা যেমন অপরিসীম, অন্য দিকে তেমনি আবার প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সীমাবদ্ধতাও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি, এক দিকে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের উপকারিতার শেষ নেই, অন্যদিকে এ প্রযুক্তির কিছু নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। চিকিৎসা-বিজ্ঞানের কথা যদি বলি, ক্যান্সারের ওষুধের যেমন রয়েছে মারাত্মক নেতিবাচক পাশর্^প্রতিক্রিয়া, তেমনি পাশর্^প্রতিক্রিয়া রয়েছে মাথা-ব্যথার একটি ট্যাবলয়েটেও।
বিজ্ঞানের মতে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে ‘বিগ ব্যাঙ্গ’ নামক বিষ্ফোরণের ফলে। মহাবিশে^র যাবতীয় বস্তু ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বা সীমাহীন ক্ষুদ্র একটি বিন্দুতে জমাট বাঁধা ছিল। ওই বিন্দুর ঘনত্ব ছিল অসীম, বক্রতাও ছিল অসীম এবং তার আকার ছিল এতই ছোট যেন শূন্যেরই নামান্তর। দশ থেকে বিশ বিলিয়ন বছর আগে, ওই জমাট বাঁধা বিন্দুতে বিষ্ফোরণ ঘটে, যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় স্পেস ও তার নিরন্তর সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া, টাইম এবং তার নিরন্তর পথ চলা। বিজ্ঞানীরা অনেক জটিল ও কঠিন তত্ত¡ ও সূত্র আবিষ্কার করেছেন যা দিয়ে মহাবিশে^র যে কোনো সময়ের অবস্থা পর্যালোচনা করে আগামীতে কী হতে পারে সেই মর্মে ভবিষ্যৎবাণী করছেন । তাই সৃষ্টি রহস্যের মূল প্রশ্ন, জমাট বাঁধা বিন্দুটি কেন বিষ্ফোরিত হলো? মহাবিজ্ঞানীরা এখানে অনাথ শিশুর মতোই অসহায়!
একসময় পৃথিবীতে মানুষ ছিল বড়ই অসহায়। পরণে বস্ত্র ছিল না, খাবার বানিয়ে খেতে পারতো না, বন জঙ্গলের পশুদের শিকার করে কাচা মাংস খেতে হতো ইত্যাদি। আজকে মানুষেরা নিজেদের একটি সুন্দর অবস্থানে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্যই এই পর্যায়ে এসেছে সহযোগিতা দিয়েছে বিজ্ঞান। কথিত আছে আইনস্টাইন কথা বলতে শুরু করেন চার বছর বয়সে। তখন তাঁর মা-বাবা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। একদিন হঠাৎ খাবার টেবিলে মূক আইনস্টাইন বলে উঠলেন, ‘স্যুপটা খুবই গরম’! তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, এতদিন কেন কথা বলোনি? আইনস্টাইন তাঁর জীবনের দ্বিতীয় বাক্যটি বললেন ”এতদিন তো সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল”। প্রয়োজনেই মানুষ আবিষ্কার করেছে নতুন নতুন প্রযুক্তিনির্ভর উপকরণ। আমরা নিজেরা কোনো খাবারই তৈরী করতে পারি না নির্ভর করতে হয় সবুজ উদ্ভিদের উপর। আমরা সহজেই গাছ থেকে খাবার পাই কিন্তু কয়জন জানে যে এক পাউন্ড খাবার তৈরি করতে একটি গাছ প্রায় ১০০ পাউন্ড পানি মৃত্তিকা থেকে শোষণ করে লয়।
সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই মানবজীবনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে বিজ্ঞান। এ সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের যেতে হবে আগুন আবিষ্কার বা চাকা আবিষ্কারের সময়ে। এই দীর্ঘ পথচলায় বিজ্ঞান যেমন মানুষের জীবনে বয়ে এনেছে অসামান্য মঙ্গল। বিজ্ঞান ছাড়া আজকের পৃথিবী অচল। নিত্যদিন আমরা কত কষ্ট করে গবেষণা করে কত কিছুই শিখছি, তথাপি কিছু অতি সাধারণ বিষয় সম্পর্কে রয়ে যাই অন্ধকারে। যেমন, আমরা সকলেই জানি বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য যা তৈরি করে বৃক্ষরাজি। কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের অর্ধেকের বেশি অক্সিজেন উৎপন্ন করে ফাইটোপ্লাংটন নামে এককোষী সামুদ্রিক উদ্ভিদরা । ফাইটোপ্লাংটনের এই নিরব ভূমিকা সম্পর্কে আমরা কজনেই বা জানি।
ব্যাকটেরিয়া, ক্ষুদ্র একপ্রকার অণুজীব, যাদেরকে খালি চোখে দেখা সম্ভব না, আর এরাই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী জীব! নিজের দেহের ওজনের চেয়ে ১ লক্ষ গুণ বেশি ওজন এরা বহন করতে সক্ষম! যেমন- গণকক্কাস ব্যাকটেরিয়া। আমাদের দেহের প্রতিটি জিনে ৫০০ থেকে ২৫ লাখ পর্যন্ত নিউক্লিওটাইডের জোড় থাকে। এসব ডিএনএ এর গড় দৈর্ঘ্য ৫ সেন্টিমিটার। ফলে একটি কোষের সবগুলো ডিএনএ এর কন্ডুলী খুলে জোড়া লাগালে সেগুলোর দৈর্ঘ্য হবে অভাবনীয়। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়- একজন মানুষের দেহে মোট কোষের সংখ্যা ৩৭ ট্রিলিয়ন বা ৩৭ লক্ষ কোটি! এই ৩৭ লক্ষ কোটি কোষের সবগুলোতে থাকা ডিএনএগুলোর কুন্ডলী খুলে জোড়া লাগালে দৈর্ঘ্য হবে ২ী১০১৪ মিটার। এই অতিবৃহৎ ডিএনএ সুতা দ্বারা সূর্য থেকে এর সবচেয়ে দূরবর্তী গ্রহ প্লুটো পর্যন্ত ১৭ বার নিয়ে নেয়া যাবে এবং ফিরিয়ে আনা যাবে! এক চামচ পানিতে অণুর সংখ্যা ২ী১০২৩ টি। প্রতিটি অণুতে আবার রয়েছে তিনটি করে পরমাণু, একটি অক্সিজেন এবং দুটি হাইড্রোজেন। এই এক চামচ পানির সবগুলো পরমাণুকে যদি পাশাপাশি রাখা হয় তাহলে এর দৈর্ঘ্য হবে ৫০ বিলিয়ন কিলোমিটার, যা আমাদের সৌরজগতের প্রস্থের প্রায় ১০গুণ! আমরা কজন জানি, মানুষের একটি বৃক্ক গঠিত হয় ১০-১২ লক্ষ নেফ্রোন দ্বারা এবং প্রতিটি ৩-৫ সেন্টিমিটার লম্বা। এই হিসেবে প্রতি বৃক্কে নেফ্রোনের নালিকাগুলি ৩৬ কিলোমিটার লম্বা। এই বৃক্কের মাধ্যমে প্রতি মিনিটে ১২৫ ঘন সেন্টিমিটার তরল পদার্থ পরিশ্রæত হয় এবং ৯৯% পানিই আবার রক্তে ফিরে যায়। অথাৎ প্রতি মিনিটে মাত্র ১ সেন্টিমিটার মুত্র তৈরী করে শরীরের সুস্থতা নিশ্চিত করে। আমাদের দুটি ফুসফুসে সাত কোটি অ্যাভিওলাই থাকে যা ১১,৮০০ বর্গ সেন্টিমিটার শ্বসনতল সৃষ্টি করে বায়ুমন্ডলের অক্সিজেন রক্তে এবং রক্তথেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুমন্ডলে বের করে দিয়ে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।
একটি অদৃশ্য ভাইরাস ‘করোনা কোভিট-১৯’, যার ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে এ বছরের জানুয়ারি মাসে। ধারণা করা হচ্ছে, খুব শীঘ্রই এই ভাইরাসের কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। পূর্বেও বিজ্ঞানীরা গুটিবসন্ত, কলেরা, ফøু, প্লেগ, টাইফয়েড বা ইবোলা ভাইরাস প্রভৃতির ভ্যাকসিন তৈরি করে বাজারে আনতে সক্ষম হয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমেই কার্যকরী ওষুধ বাজারে আনা সম্ভব। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জন্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে বিশ্বের সকল সংস্থার মধ্যে সমন্বয় দরকার। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায় বিজ্ঞানই এই অবস্থার সমাধান দিবে।
ল্যাবরেটরিতে পেট্রিডিশের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া কালচার করা হয়। তবে যা বিস্ময়কর তা হচ্ছে আমরা নিজেরা এক একজন একটা জীবন্ত পেট্রিডিশ! আমাদের দেহে যে পরিমাণ কোষ আছে, তার ১০ গুণ আছে ব্যাকটেরিয়া! চলতে ফিরতে প্রতিটি মানুষ এক একটি ব্যাকটেরিয়ার অভয়ারণ্য! যতই সাবান, স্প্রে, হ্যান্ডওয়াশ বা এন্টি জার্মওয়াশ ব্যবহার করি না কেন, ব্যাকটেরিয়া থেকে আমাদের রেহাই নেই। এরা ধ্রুব সঙ্গী। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব ব্যাকটেরিয়ার প্রায় সম্পূর্ণটাই আমাদের দেহের জন্য উপকারী। শুধু উপকারী বললেই চলে না, অপরিহার্যও বটে। এদের ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা যেমন অসম্ভব তেমনি মরে গেলেও দেহকে মাটিতে মিশিয়ে দিতেও এদের ভূমিকা অত্যাবশ্যকীয়।
বিজ্ঞানীরা দাবি করেন যে, তারা এখনো পর্যন্ত মহাবিশ্বের মাত্র শতকরা চার ভাগ জানতে পেরেছেন। এই চার ভাগেই রয়েছে আনুমানিক ৫ হাজার কোটি গ্যালাক্সি! এরকম এক একটি গ্যালাক্সিতে রয়েছে ১ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ কোটি তারকা বা নক্ষত্র, যাদের ঘিরে রয়েছে কত সৌরজগৎ তার ইয়ত্তা নেই। শুধুমাত্র আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়েতেই পৃথিবীর মতো ১ লক্ষ কোটি গ্রহ থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা! এরপরও কিভাবে বলি যে, মহাবিশ্বে পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব নেই? আশা করি ভবিষ্যতে বিজ্ঞান এ ভাবনার সমাধান দিবে।
লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়

শেয়ার করুন

Leave a Reply