মডেল মসজিদের মাধ্যমে ইসলামের মর্মবাণী সবাই উপলব্ধি করতে পারবে : প্রধানমন্ত্রী

মানিক ভৌমিক :
দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় নির্মাণাধীণ ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মধ্যে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার (১০ জুন) প্রথম পর্যায়ের ৫০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভার্চুয়ালি শুভ উদ্বোধন করেছেন প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা। তন্মধ্যে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার মসজিদটিও রয়েছে।
ভার্চুয়াল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ইসলাম ধর্ম হচ্ছে সবচেয়ে সহনশীল ধর্ম। যে ধর্ম মানুষের অধিকার দেয়, মানুষকে মানুষ হিসেবে তৈরি করার শিক্ষা দেয়। সেই শিক্ষাটা যেন সবাই পায় সেটা আমরা চাই। আমি আশা করি আমাদের মডেল মসজিদের মাধ্যমে ইসলামের বাণী প্রচার হবে, ইসলামের সংস্কৃতি প্রচার হবে, ইসলামের মর্মবাণী সবাই, সব ধর্মের মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে। সেদিকে খেয়াল রেখে এটা আমাদের করা।
তিনি বলেন, আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের অনেক খেদমত করে গেছেন। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবং তিনিই ইসলামিক ফাউন্ডেশনটা তৈরি করে গিয়েছিলেন। ইসলামের প্রচার-প্রসারে বাংলাদেশও যেন ভবিষ্যতে অবদান রাখতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে প্রথম পর্যায়ে নির্মিত ৫০টি মসজিদের উদ্বোধন করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমরা লেবাসসর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে।
তিনি বলেন, আমরা মুসলিম অধ্যুষিত দেশ, এই ইসলামের চর্চা এবং মূল্যবোধের চর্চা যেন ভালোভাবে হয়, ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ যেন হয়, ইসলামের মর্মবাণীটা যেন মানুষ ভালোভাবে বুঝতে পারে সেটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। আমরা দেখেছি ধর্মের নাম দিয়ে কীভাবে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী দেখিছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্মের নামে মানুষ খুন করা, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করা এবং মানুষকে খুন করলে নাকি বেহেশতে চলে যাবে; আমার প্রশ্ন যারা এ পর্যন্ত খুন-খারাপি করেছে তারা কে কে বেহেশতে গেছে সেটা কি কেউ বলতে পারবে? কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু সব থেকে সর্বনাশ করেছে পবিত্র ইসলাম ধর্মের, যে ধর্ম শান্তির ধর্ম, যে ধর্ম মানুষকে অধিকার দিয়েছে। আমি মনে করি সারাবিশ্বে সব থেকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম হচ্ছে ইসলাম ধর্ম। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো এই মুষ্টিমেয় লোক জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে, মানুষ হত্যা করে, বোমা মেরে, খুন-খারাপি করে আমাদের এই পবিত্র ধর্মের নামে বদনাম সৃষ্টি করছে। এটা আমাদের ধর্মের পবিত্রতা শুধু নষ্ট করছে না, ইমেজও নষ্ট হচ্ছে সারাবিশ্বে।
তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের সঙ্গে যারা জড়িত ওলামা, অভিভাবক, শিক্ষক সবাইকে অনুরোধ জানাব- এ পথ সর্বনাশা পথ, এটি হতে সবাই যেন দূরে থাকে সে জন্য সবাইকে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ধর্মের চর্চা করতে হলে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, মানুষের কল্যাণ করতে হবে, মানুষের সেবা করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের অকল্যাণ করে, মানুষ হত্যা করে, একটা পরিবারকে ধ্বংস করে বেহেশতে যেতে পারবে না। এটা ভুল কথা। মডেল মসজিদ, এই মসজিদের মাধ্যমে আমাদের ইসলাম, আমাদের সংস্কৃতি, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দাওয়াতি কার্যক্রম সেগুলো যেন সঠিকভাবে প্রচার-প্রসার, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, এগুলো থেকে মানুষ যেন দূরে থাকে।
তিনি বলেন, মানুষ যেন আমাদের ধর্মের যে মূলকথা সেটা সঠিকভাবে শিখতে পারে, জানতে পারে। ধর্মের চর্চা করার সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষ যেন জানতে পারে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে সবদিকে আমাদের ব্যাপ্তি সারাবিশ্বে। সবকিছুতেই তো মুসলমানরা আগে এগিয়ে এসেছে। সবসময় মুসলমানরাই সামনে ছিল। সভ্যতার দিক থেকে মুসলমানরা সবসময় আগে ছিল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থেকে শুরু করে মুসলমানরা সবসময় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসাশাস্ত্রে, জোত্যির্বিদ্যা- সবকিছুতেই মুসলমানরা এগিয়ে ছিল। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে- বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে। আজ কেন মুসলমানরা পিছিয়ে থাকবে। সেটিই আমার প্রশ্ন।
সরকারপ্রধান বলেন, আমরা এ মসজিদগুলো পেয়েছি, আমরা এটাই চাচ্ছি- প্রতিটি জেলা-উপজেলায়। আমরা চাই যে আমাদের পবিত্র ধর্ম সম্পর্কে মানুষ সচেতন হবে। এ মসজিদগুলোতে সে ব্যবস্থা রয়েছে। আপনাদের এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে যেন ধর্মীয় দৃষ্টিতে বাল্যবিয়ে, যৌতুক, নারীর প্রতি সহিংসতা, মাদক, মাদকের হাত থেকে মানুষ যেন মুক্ত হতে পারে তার জন্য সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে। এসবের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ মসজিদকে আমরা সেভাবে তৈরি করেছি।
তিনি বলেন, ইসলাম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যাতে বৃদ্ধি পায় সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা মসজিদগুলো করেছি। আজ আমি সত্যিই খুব আনন্দিত, মডেল মসজিদগুলো হতে ইসলামের সঠিক মর্মবাণী প্রচার হবে, ইসলামের সঠিক জ্ঞানচর্চা হবে, মুসলমানরা আরও সচেতন হবে, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় এগিয়ে যাবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিস, কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপায়ন দাস শুভ, কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) সুলতানা খানম, কচুয়া থানার অফিসার ইনর্চাজ মো. মহিউদ্দিন, ইসলামী ফাউন্ডেশন চাঁদপুরে উপ-পরিচালক খলিলুর রহমান, গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রকিবুর রহমান, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) একি মিত্র চাকমা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইয়ুব আলী পাটোয়ারী ও সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন চৌধুরী সোহাগ, চাঁদপুর জেলা ইমাম সমিতির সভাপতি সাইফুল্লাহ, মুয়াজ্জিম সমিতির সভাপতি আব্দুর রহমান গাজী, ইসলামীক ফাউন্ডেশন চাঁদপুরের ফিল্ড অফিসার বিপ্লব হোসেন, কচুয়ার ফিল্ড সুপারভাইজর হাসান মজুমদার সহ উপজেলার বিভিন্ন বিভাগীয় সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা ও সুশীল সমাজের লোকজন।
প্রধান মন্ত্রী ভার্চুয়ালি মসজিদ উদ্বোধনের পর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এমপি। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন- চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক ও কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
ভার্চুায়ালি উদ্বোধনী শেষে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিস মসজিদের বিভিন্ন কক্ষ পরিদর্শণ করেন।
উল্লেখ্য, উক্ত মসজিদটি প্রতিষ্ঠায় বিশিষ্ট সমাজ সেবক সুবিদপুর গ্রামের তাজুল ইসলাম ৪৩ শতক ভূমি দান করেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্র মতে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে উন্নত মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। ২০১৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে ওই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা প্রদান করেন। এরই প্রেক্ষিতে ‘প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন (প্রথম সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পটি ৮ হাজার ৭২২ কেটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের ২৬ জুন সম্পূর্ণ জিওবির অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্যে একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। জেলা পর্যায়ে চতুর্থতলা ও উপজেলার জন্যে তিনতলা এবং উপকূলীয় এলাকায় চার তলা বিশিষ্ট মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাসহ এসব মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সে নারী ও পুরুষের পৃথক ওজুও নামাজ আদায়ের সুবিধা, লাইব্রেরি গবেষণা ও দ্বীনি দাওয়াত কার্যক্রম, পবিত্র কোরআন হেফজ বিভাগ, শিশু শিক্ষা, অতিথিশালা, বিদেশি পর্যটকদের আবাসন, মৃতদেহ গোসলের ব্যবস্থা, হজ্বযাত্রীদের নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ ও ইমামদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ব্যবস্থা রয়েছে। ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসনসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যে অফিসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
চাঁদপুর গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, উদ্বোধনের জন্যে বিভিন্ন জেলার ৫০টি মসজিদ প্রস্তুত করা হয়েছে। সে তালিকায় চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার মডেল মসজিদ রয়েছে। এ মসজিদ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা। এসব মসজিদে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি জ্ঞানার্জন ও গবেষণার সুযোগ রয়েছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply