মতলবে বাড়ছে বাল্য বিবাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক :
মতলব দক্ষিণে বাল্য বিবাহ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব বাল্য বিবাহ পারিবারিকভাবেও হচ্ছে আবার ছেলে-মেয়ের উভয়ের পছন্দে গোপনীয়ভাবেও হচ্ছে। তবে এসব বাল্য বিবাহের রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্ম নিবন্ধন প্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে দেখানো হয়। যদিও বাস্তবে ছেলে-মেয়ে উভয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক, কিন্তু সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা কার্যালয় থেকে এদের প্রাপ্ত বয়স হয়েছে এমন জন্ম নিবন্ধন তৈরি করে আনা হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌর কর্তৃপক্ষ কোনো নিয়ম-কানুন মানছে না। বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ঘটনার অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে।

পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, ছেলে ও মেয়ের জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট, তা না থাকলে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয় এবং তাও না থাকলে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের প্রত্যয়নপত্রের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর ভবিষ্যতে নির্বাচনে ভোট পাওয়ার আশায় প্রত্যয়নপত্র দিয়ে দেয়। প্রত্যয়নপত্র পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কিছুই করার থাকে না। এছাড়াও পূর্বের জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেটে বয়স পরিবর্তন করেও বাল্য বিবাহে বৈধতা দেয়া হয়।

বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী একজন মেয়ের সর্বনিম্ন ১৮ বছর ও একজন ছেলের সর্বনিম্ন ২১ বছর পূর্ণ হলে ওই ছেলে-মেয়ে প্রাপ্ত বয়স্কের মধ্যে পড়ে। এর কম হলে তারা অপ্রাপ্ত বয়স্ক বলে বিবেচিত হবে। বিবাহের ক্ষেত্রেও এই বিধান বলবৎ আছে। অর্থাৎ ১৮ ও ২১ বছরের কম বয়সী কোনো মেয়ে ও ছেলের বিবাহ হলে সেটা বাল্য বিবাহের আওতায় পড়বে। আর বাল্য বিবাহ আইনতঃ দন্ডনীয় অপরাধ। সরকার বর্তমানে বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে কঠোর আইন করেছে। এরপরও বাল্য বিবাহ বন্ধ নেই।

গত কয়েক মাসে মতলবে থেকে ২০ থেকে ২৫টি বাল্য বিবাহের ঘটনা ঘটেছে। তাও যেগুলো জানাজানি হয়েছে এবং মিডিয়ায় এসেছে সেগুলো এই সংখ্যার মধ্যে হবে। এর বাইরে গোপনীয়ভাবে যে সব বাল্য বিবাহ হয়েছে তার হিসাব আরো বেশি। জানা গেছে, পারিবারিকভাবে বেশ কিছু বাল্য বিবাহ অনুষ্ঠিত হলেও প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছেন। এমনকি বাল্য বিবাহ দেয়ার অপরাধে কনের অভিভাবক মা ও বাবাকে জেল ও জরিমানা করা হয়েছে। তারপরও বাল্য বিবাহ বন্ধ হয়নি। আগে বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে ম্যারিজ রেজিস্ট্রার ও কাজীদের দোষারোপ করা হলেও এখন আর এটি বাস্তব সম্মত নয়। কারণ, অধিকাংশ কাজীই এখন এ ব্যাপারে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করেন। তবে এখন বিবাহ নিবন্ধন করতে গিয়ে কাজীরা বেশ জটিলতার মধ্যে পড়েন। সেটি হচ্ছে- ছেলে-মেয়ে অপ্রাপ্ত বয়স, কিন্তু সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত বয়স দেখিয়ে জন্ম তারিখ উল্লেখ করে জন্ম নিবন্ধন সনদ কাজীর কাছে উপস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে একজন কাজীর পক্ষে তো জন্ম নিবন্ধন সনদ পাওয়ার পর ছেলে-মেয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক কি-না তা পরখ করে দেখা সম্ভব নয়। ছেলের বেলা সম্ভব হলেও মেয়ের বেলায় কীভাবে সম্ভব? আর যেখানে অভিভাবকরাই অপ্রাপ্ত বয়স্ককে বলছে প্রাপ্ত বয়স্ক, এমনকি কিছু কিছু এ ধরনের বিবাহ অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট এলাকার মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, মেম্বার উপস্থিত থাকেন, সে ক্ষেত্রে কাজী জন্ম নিবন্ধন সনদ পাওয়ার পরও এই বিবাহ নিবন্ধন করা থেকে কীভাবে বিরত থাকবেন? আর এক্ষেত্রে পরবর্তীতে কাজীকেই অহেতুক এবং অন্যায়ভাবে ঝামেলায় জড়ানো হয়। ছেলে-মেয়ের পছন্দের বিবাহের বেলায়ও তাই হয়। তারা অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলেও প্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়ে আসে। দেখা গেছে অভিভাবকরাও গিয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েছে এমন মিথ্যা জন্ম তারিখ বসিয়ে জন্ম সনদ নিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তর কোনো যাচাই-বাছাই করছে না। জন্ম সনদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এমন সহজলভ্যতার কারণেই বলতে গেলে বাল্য বিবাহ রোধ করা যাচ্ছে না।

একাধিক পৌর ও ইউনিয়নবাসী জানায়, বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে জনগনকে সচেতন করা না গেলে বাল্য বিবাহ রোধ করা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বাল্য বিবাহ ভেঙ্গে দিলেও অভিভাবকগণ পরবর্তীতে অন্য স্থানে গিয়ে বাল্য বিবাহ দিচ্ছে। একমাত্র অভিভাবকরা সচেতন এবং অভিভাবকদের শাস্তির আওতায় আনা হলেই বাল্য বিবাহ রোধ করা সম্ভব।

নায়েরগাঁও গ্রামের এক মেয়ের অভিভাবক সোলেমান মিয়া জানান, আমাদের সমাজে বাল্য বিবাহ দিয়ে মেয়েদের জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে। সামাজিকভাবে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। করোনার মধ্য দিয়েও উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বাল্য বিবাহ হচ্ছে।

মতলব দক্ষিণ উপজেলা কাজী সমিতির সেক্রেটারী মোঃ সোহেল কাজী জানান, বর্তমানে কাজীদের না জানিয়ে এবং প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়েই বাল্য বিবাহ হচ্ছে। নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে কোর্ট এফিডেবিট বন্ধ করা না গেলে বাল্য বিবাহ রোধ করা সম্ভব নয়। এছাড়াও বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে অভিভাবকদের অবগত করতে হবে।

উপাদী দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ গোলাম মোস্তফা প্রধান জানান, বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষনা করা হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তাহলেই আমাদের সমাজ থেকে বাল্য বিবাহ নামক অভিশাপ দূর করা সম্ভব।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা হক জানান, বাল্য বিবাহ একটি সামাজিক অপরাধ। বাল্য বিবাহকে না বলুন। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক ও শিক্ষকদেরকে নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে। আমাদের সমাজ থেকে বাল্য বিবাহ দূর করতে হবে। বাল্য বিবাহ হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বাল্য বিবাহের খবর শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

শেয়ার করুন

Leave a Reply