মে দিবস এবং শ্রমিকদের মর্যাদা

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন ::
প্রতি বছরের ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়। এটি শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায় ও স্বীকৃতি লাভের মহান দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ সুসংগঠিত হয়ে মিছিল ও শোভাযাত্রায় অংশ গ্রহনের মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৮০টির ও বেশী দেশে ১লা মে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক আন্দোলন ও আত্মাহুতিকে এ দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। এই মহান দিবসটি পালনের তাৎপর্য আমারা কজনই বা জানি !
ক্রমবিকশিত আধুনিক সভ্যতার প্রতিটি ইট, বালু, পাথরে শ্রমিকদের ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জড়িয়ে আছে। কিন্তু কখনোই শ্রমিকরা সভ্যতার আশীর্বাদে ধনী শ্রেণী হতে পারছিল না। আজকের এই দিবসে ১৮৮৬ সালের শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক আন্দোলন নিয়েই লিখব বলে ঠিক করেছি। ঊনিশ শতকের শুরুর দিকের কথা। শ্রমিকরা তখনো শোষিত, সপ্তাহে ৬ দিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘন্টা অমানবিক পরিশ্রম করতো কিন্তু তার বিপরীতে মিলত সামান্য মজুরী। অনিরাপদ পরিবেশে রোগ-ব্যাধি, আঘাত, মৃত্যুই ছিল তাদের নির্মম সঙ্গী। তখন তাঁদের পক্ষ হয়ে বলার মত কেউই ছিল না। ১৮৬০ সালে শ্রমিকেরা দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম নির্ধারনের দাবি জানায়। কিন্তু কোন শ্রমিক সংগঠন ছিল না বলে এই দাবী জোরালো হয়ে উঠে নাই। এই সময় সমাজতন্ত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। শ্রমিকরা বুঝতে পারে বণিক ও মালিক শ্রেণীর এই রক্ত শোষণ নীতির বিরুদ্ধে তাঁদের সংগঠিত হতে হবে। ১৮৮০-৮১ সালের দিকে শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠা করে Federation of Organized Trades and Labour Unions of the United States and Canada অবশ্য পরে ১৮৮৬ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় American Federation of Labour। এই সংঘের মাধ্যমে শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে শক্তি অর্জন করতে থাকে। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করে এবং তাঁেদর এ দাবী কার্যকর করার জন্য ১৮৮৬ সালের ১লা মে শেষ সময় বেঁধে দেয় । তারা এই সময়ের মধ্যে সংঘের আওতাধীন সকল শ্রমিক সংগঠনকে এ প্রস্তাব বাস্তবায়নে পুনঃ পুনঃ আহ্বান জানায়। প্রথম দিকে অনেকেই এ দাবিকে অবাস্তব অভিলাষ, অতি সংস্কারের উচ্চাকাঙক্ষা বলে আশংকা প্রকাশ করে। কিন্তু বণিক-মালিক শ্রেণীর কোন ধরনের সাড়া না পেয়ে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। শ্রমিক সংগঠনদের সাথে বিভিন্ন সমাজতন্ত্রপন্থী দলও একাত্মতা প্রকাশ করে। আর আমেরিকার শিকাগো শহর হয়ে উঠে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল।
বুড়ো শ্রমিক, যুবা শ্রমিক, মধ্যম বয়সি শ্রমিক, শিশু শ্রমিক Ñ যেই শ্রমিকই হোক না কেন, সবার জন্যই বছরের এ দিনটি একটি ‘বিশেষ দিন’ হিসেবে উদযাপিত হয়ে থাকে, যার নাম মে দিবস। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবেও এই দিনটি পালিত হয়ে থাকে। পূর্বে শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রম করতে হতো, শ্রমিকরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করত, ক্ষেত্রবিশেষে তা দাসবৃত্তির পর্যায়ে বিবেচিত হতো। কিন্তু কারখানা মালিকগণ এ দাবী মেনে নেননি। ১লা মে এগিয়ে আসতে লাগল। মালিক-বণিক শ্রেণী অবধারিতভাবে ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। ১৮৭৭ সালে শ্রমিকরা একবার রেলপথ অবরোধ করলে পুলিশ ও ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি তাঁদের উপর বর্বরোচিত আক্রমন চালালো। ১লা মে দিনটিকে মোকাবেলা করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি চলতে থাকে, পুলিশসহ ও জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা শিকাগো সরকারকে অস্ত্র সংগ্রহে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে। ধর্মঘট আহবানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য শিকাগো বানিজ্যিক ক্লাব ইলিনয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ২০০০ ডলারের মেশিনগান কিনে দেয়। ১লা মে – সমগ্র যুক্ত্ররাষ্ট্রে প্রায় ৩,০০,০০০ শ্রমিক তাঁদের কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসে, ধর্মঘটে যোগ দেয় এবং শ্রমিকরা কাজ ফেলে শহরের কেন্দ্রস্থলে সমবেত হয়। অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা, মিছিল, মিটিং, ধর্মঘট, বিপ্লবী আন্দোলনের হুমকি সবকিছু মিলিয়ে ১লা মে উত্তাল হয়ে উঠে। পার্সন্স, জোয়ান মোস্ট, অগাস্ট স্পীজ, লুইস লিংসহ আরো অনেকেই শ্রমিকদের মাঝে পথিকৃত হয়ে উঠেন। ধীরে ধীর আরো শ্রমিক কাজ ফেলে আন্দোলনে যোগ দিতে থাকে। আন্দোলনকারি শ্রমিকদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে ও আন্দোলন চলতে থাকে। ৩ মে (কারো কারো মতে ৪ ঠা মে) ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। এক পর্যায়ে যখন জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বর্ক্তৃতা করছিলেন অগাস্ট স্পীজ তখন হঠাৎই দূরে দাড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরন ঘটে, এতে এক পুলিশ নিহত হন এবং পুলিশবাহিনীও শ্রমিকদের উপর অতর্কিত হামলা শুরু করে। ৮ ঘণ্টা শ্রমদান প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলনরত শ্রমিকের ওপর গুলি চালানো হলে সেদিন ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন।
পুলিশ হত্যা মামলায় অগাস্ট স্পীজসহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন, অন্য একজনের পনের বছরের জন্য কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে অগাস্ট স্পীজ বলেছিলেন, “আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে”। ২৬শে জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্ণর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশ কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন। আর অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় কখনোই প্রকাশ পায়নি। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের “দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার” দাবী রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতি পায়। আর পহেলা মে তারিখটি শ্রমিকদের দাবী আদায়ের দিন হিসেবে ‘মে দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
আমাদের দেশে আজ শ্রমিকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন হাজারো অবহেলিত ও দরিদ্র শিশু। ওদের নাম হয়ে গেছে শিশু-শ্রমিক। বিশ্বের অনেক দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। ১৮৮৬ সালের মে মাসে শ্রমিকদের আত্মাহুতিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিল্পবের শতবার্র্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভীনে। ১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিক সম্মেলণের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এর পরপরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ সালে আমর্স্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রবাদীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবী আদায়ের জন্য বিশ্বজুড়ে পহেলা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনের সকল সমাজতন্ত্রবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘ বা ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে “শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না থাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে’র ১ তারিখে “বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার” সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন পালনের দাবী জানায় এবং অনেক দেশেই তা পালন করে থাকে। দীর্ঘদিন ধরেই সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের কিছু কট্টর সংগঠন তাদের দাবী জানানোর জন্য মে দিবসকে মুখ্য দিন হিসাবে বেছে নেয়। কোন কোন স্থানে শিকাগোর হে মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে আগুনও জ্বালানো হয়। পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্র, চীন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সেসব দেশে এ উপলক্ষে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজনও করা হয়। বাংলাদেশ এবং ভারতেও এই দিনটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে। ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ সালে। সেখানকার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমের নাইট এই দিনটি পালনের উদ্যোক্তা। হে মার্কেটের হত্যাকান্ডের পর আমেরিকার তৎকালিন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন পহেলা মে তারিখে যে কোন আয়োজন হলে হানাহানি হতে পারে। সে জন্য ১৮৮৭ সালেই তিনি নাইটের সমর্থিত শ্রমিক দিবস পালন চালু করেন।
১৮৯০ সালে আর্জেন্টিনায় প্রথম সরকারিভাবে শ্রমিক দিবস পালন করা হয়, শহরগুলোতে রাস্তায় শ্রমিক শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভার আয়োজন করে, একই সময়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন প্রথমবারের মতো উদযাপন করে। বলিভিয়ায় ১ লা মে কে শ্রমিক দিবস এবং সাধারণ ছুটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রায় সকল শ্রমিক এই দিনটিকে সম্মান করে। ব্রাজিলে শ্রমিক দিবসটি সাধারণ ছুটি হিসাবে পালিত হয়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো দিনব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এইদিন ঐতিহ্যগতভাবে অধিকাংশ পেশাদার বিভাগের ন্যূনতম বেতন কাঠামো পুনঃনির্ধারণ করা হয়। ১৮৯৪ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জন স্পার ও ডেভিড থমসন সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করার ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রেও একই দিনে শ্রমিক দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশ সরকার এই দিনটি মে দিবস হিসেবে পালন করে থাকে এবং দিনটি সরকারি ছুটির দিন। আজকের এই দিনে সকল শ্রমিক ভাইদের জন্য রইল অকৃত্তিম ভালবাসা ও শদ্ধা যাঁদের ঘাম ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে আধুনিক সভ্যতা। শ্রমিকদের শ্রমের যথাযথ মর্যাদা দানের মাধ্যমে সুখী ও সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ই হোক আমাদের আজকের অঙ্গীকার ।
লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

 

 

পূর্ববর্তী লেখা :

করোনাকালীন ছুটিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর করণীয়

শেয়ার করুন

Leave a Reply