‘যখন আমি থাকব না, আমায় রেখো মনে..’

(গানের পাখি তাহমিনা হারুন স্মরণে)
মইনুদ্দিন লিটন ভূঁইয়া ::
ঘুমিয়ে গেছে চাঁদপুরের গানের জগতের অনণ্য সাধারণ সম্ভাবনাময় কন্ঠ তাহমিনা হারুন। ২০ এপ্রিল ২০২১ সালের রমজান মাসের ৭ তারিখ রাত ৩ টা ১৫ মিনিটে সে চিরবিদায় নিল। আমি এর আগে হারুনের নতুন বাড়িতে যাইনি। যাবার কথা ছিল। হারুনকে বলেওছিলাম যাব। কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠেনি। হারুন বলেছিল যাবার আগে যেন ওকে জানিয়ে যাই। তাই করবো ঠিক করা ছিল। আশা ছিল তাহমিনা সুস্থ হয়ে উঠুক, তখন আমার স্ত্রীকে নিয়ে যাব। সেই তো গেলাম, যার বাড়িতে গেলাম সে যে আর নেই। ছোট বোনের মতো জেনেছি, তাহমিনাও আজীবন আমাকে বড় ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা করে গেছে। মনে পরে, যেবার আমাদের চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির কার্যকরী কমিটির নির্বাচন হল, আপনাদের ভোটেই আমি জয়লাভ করেছিলাম। ফলাফল ঘোষনার পরে প্রথম সন্ধ্যায় আমি স্বস্ত্রীক হারুনের বাসায় যাই। সময়টা সন্ধ্যা সাত কি আটটা হবে। তখন ওরা হাজী মহসিন রোডে ভাড়া বাসায়। ভেতরে ঢুকেই তাহমিনাকে বলেছিলাম, ‘তাহমিনা, আমি ইলেকশানে জিতেছি। আজ তোমার হাতের রান্না খেয়ে যাব।’ তাৎক্ষনিক মাংস ভাত আর ইলিশ মাছ ভেজে খাইয়েছিল তাহমিনা। তারও অনেক বছর আগে, তখন রিনা চক্রবর্তী আর তাহমিনার দারুন জুটি। দু’জনেই গানের শিল্পী। শিল্পকলার সব আয়োজনেই ওরা গাইতো। তখন অনুষ্ঠান করবার আগে বেশ শক্ত মহড়া হতো। হয়তো এখনো হয়। সে যাহোক, তখন রিনা আর তাহমিনার দুষ্টুমির সাথে খিলখিল হাসির বন্যায় পুরো মহড়া কক্ষ জমে থাকতো। শত ডাক-দোহাই-বকুনি দিয়েও দমানো যেত না। একসময় সংগীত নিকেতনে গান শিখতো তাহমিনা। শেখাটা শেষ করে উঠতে পারেনি। বিয়ের পরে মঞ্চে গান গাইতে শুরু করে। আমি তখন থেকেই তাহমিনাকে চিনেছি। আমি শিশুকাল থেকে সংগীতের সাথে জড়িয়ে আছি। গলাটা তৈরী করতে না পারলেও শ্রুতিটা তৈরী করেছি পরম নিষ্ঠায়। সেভাবে নিজেকে গানের মানুষ বলতেই বেশি আনন্দ অনুভব করি। আমি হলফ করে বলছি, এই চাঁদপুরে তাহমিনার মত এতো আবেদনময়ী কন্ঠ আর কারো ভাগ্যে জোটেনি। গানের জগতে যাকে বলে ঈশ্বরের দান। তা তো বটেই। শেখাটা শেষ করতে পারলো না। নিজে হারমোনিয়াম বাজাতে জানতো না। গানের জন্য এটা জানা খুব অপরিহার্য নয়। মাইক্রোফোনের সামনে তাহমিনা যখন গাইতো কোন কর্ণকুহর অতৃপ্ত থাকতে পারতো না। ‘যখন আমি থাকবো না আমায় রেখো মনে’, এই গানটা আমি বহুবার তাহমিনাকে দিয়ে গাইয়েছি। আর এটাই সত্যি, এ গান ওর মত করে আর কেউ গাইতেও পারতো না। আজও পারবে কিনা জানি না। হ্যাঁ, তাহমিনা আরো অনেক গান গাইতো। তবে আমার কাছে ওকে ট্রেজিডি গানের সেরা কন্ঠ মনে হয়েছে। সেই কন্ঠ আজ থেমে গেছে। চোখের জলে ভিজিয়ে চলে গেছে গানের পাখি তাহমিনা হারুন। তাহমিনার যেই গুনটি ওকে সবার থেকে আলাদা করেছে, অনন্য করেছে, সেটা হলো ওর শিল্পী সুলভ সহজ সরল স্বভাব। এই স্বভাবটা আমাদের থেকে একেবারেই বিলুপ্ত প্রায়। আজ আমাদের শিল্পীদের স্বার্থের দৌড় প্রতিযোগীতার সময় তাহমিনাকে খুব মনে পরে। কখনো কারো সাথে বিরোধ না করে গান করে গেছে। কখনো কোন প্রতিযোগীতায় না জড়িয়ে গান করে গেছে নিরবে। এমনিতেই আমাদের মধ্যে কতশত বিরোধ লেগেই আছে। শিল্প সংস্কৃতির কাজ নিয়ে কতো দ্বন্দ, কতো ভুলবোঝাবুঝি। এসব ক্ষেত্রে বিরোধ দ্বন্দ আমার সাথেও রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে হয়তো আমিই ঠিক, আবার কোন ক্ষেত্রে আমি ঠিক নই। কিন্তু তাহমিনার সাথে আজ অবদি কারো সাথে কোন দ্বন্দ বা দু’টি কথা কিংবা বির্তক হয়েছে, এমনটা শুনিনি। এক কথায় আমাদের চাঁদপুরের শিল্প জগতে একমাত্র তাহমিনাই নির্দোষী মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছে। লোভ, প্রাপ্তি আর ইগোর ইমেজ থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে আড়াল করে তাহমিনা একজন প্রকৃত শিল্পীমানুষ হয়ে উঠতে পেরেছে। খবরটা পেয়ে যখন ওর বাড়িতে গেলাম, দেখলাম আজও তাহমিনা কী অপার সুখের আহ্বানে নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে নিয়েছে। সারাবাড়ীময় যখন কান্নাময়, যখন দিশেহারা হারুন ছুটে এসে বিলাপ করে বলে, ভাই আমি একা হয়ে গেলাম, যখন আমার স্মৃতির পাতায় উথাল পাথাল ঝড় এসে আমাকে অস্থির করে তুলছে, তখন কী এক অপার ডাকে সাদা ওড়নায় মুখ ঢেকে নেয় তাহমিনা, কে জানে!

শেয়ার করুন

Leave a Reply