শিক্ষার্থীর জীবনে মূল্যবোধ

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন ::
মূল্যবোধ হলো মানুষের আচরণ পরিচালনাকারী নীতি ও মানদণ্ড। মূল্যবোধ অর্জন ও প্রতিপালনের মাধ্যমেই সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি, প্রথা, আদর্শ ইত্যাদির বিকাশ ঘটে। একটি সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষতার অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জীবনে মূল্যবোধ থাকলেই আমরা প্রকৃত মানুষ বা মহৎ প্রাণী, মূল্যবোধ ছাড়া মানুষ পশু সমতুল্য। সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেককেই এ দুনিয়াতে মানব সেবা বা সভ্যতার উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য প্রেরণ করেছেন। সুতরাং মানব জন্ম বৃথাও নয়, অলীকও নয়, বরং অর্থবহ, তাৎপর্যপূর্ণ এবং সৃষ্টির সেবার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। আমাদের পবিত্র দায়িত্ব হলো কীভাবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অবদান রেখে সবাইকে নিয়ে ভালভাবে বাচঁতে পারি। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়-
বল না কাতর স্বরে
বৃথা জন্ম এ সংসারে
এ জীবন নিশার স্বপন।
মূল্যবোধ শিক্ষা মানসিক বিকাশ ও সুশাসনের পথকে সুগম করে এবং সামাজিক অবক্ষয়ের অবসান ঘটায়। তাই মূল্যবোধ মানব জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূল্যবোধ গঠনের অন্যতম মাধ্যম হলো পরিবার, বিদ্যালয়, সম্প্রদায়, ধমীর্য় অনুশাসন, খেলার সাথী, সমাজ ও প্রথা। শিক্ষার্থীদেরকে তাদের কর্তব্য ও দায়িত্বজ্ঞান সম্বন্ধে সচেতন করার মাঝেই মূল্যবোধ নিহিত, শিক্ষা জীবনে তাদের মধ্যে মূল্যবোধের বীজ বপন করতে পারলেই তারা হয়ে উঠবে তৎপর, সচেষ্ট, এতে তাদের জীবন হবে উর্বর ও সফল, না হলে তাদের জীবন হবে শুন্য মরুময়। শিক্ষার্থীদের জীবনে মূল্যবোধ জাগ্রত করার দায়িত্ব মূলত: সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী, অভিভাবকদের এবং সর্বসাধারণের জীবনে মূল্যবোধ জাগ্রত করার দায়িত্ব হলো সমাজপতি এবং রাষ্ট্রের শাসকদের উপর। মানুষ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন শ্রেষ্ঠ জীব বিধায় অন্যান্য নির্বাক জীবজন্তু ও প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব খাটিয়ে তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটাচ্ছে। তাই মানুষের জীবনে মূল্যবোধ থাকা বিধেয়।
গণতান্ত্রিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, পেশাগত, নৈতিক, বুদ্ধিভিত্তিক, ব্যক্তিগত, শারীরিক ও বিনোদনমূলক মুল্যবোধ একটি রাষ্ট্র বা সমাজকে স্থিতিশীল উন্নয়নে সহায়তা করে। যদিও স্থান কাল পাত্রভেদে মূল্যবোধের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। আবার একই সমাজে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধ দেখা যায়। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজের ও সমাজের জীবনমানের উন্ন্য়ন নিশ্চিত করা যায়। পিতামাতার আদেশ ও নির্দেশ পালন, পোষাক-পরিচ্ছেদ, শৃঙ্খলাবোধ, শিষ্টাচার, সৌন্দর্যবোধ, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, অন্য ধর্ম পালনে বাধা না দেয়া, নিজ ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ না ভাবা, বড়দের সম্মান করা, সহনশীলতা, দানশীলতা, আতিথেয়তা, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত বিচারবোধ, সততা, সরলতা, আনুগত্য, নিজের ব্রত রক্ষা ও লেখাপড়া করা, স্রস্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, জাতীয় ইস্যুতে সাড়া দেওয়া, দেশপ্রেম, মানবসেবা যথা-আর্তির দু:খ মোচন, পথের কন্টক অপসারণ, মানুষের দু:খ কষ্টে সামিল হওয়া, কোন স্থানে আগুন লাগলে তা নির্বাপনে এগিয়ে যাওয়া, রোগীর আরোগ্যলাভে সহায়তা করা এবং কোন কাজের দায়িত্ব নিলে তা অকপটে ও সুচারুরূপে সম্পাদন করা-এসবই মূল্যবোধের অংশ। ছাত্র জীবনই মূল্যবোধ বিষয়ক ধারণা অর্জন ও প্রদর্শনের উৎকৃষ্ট সময়। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক, শাসকগোষ্ঠী সকলের সম্বিলিত উদ্যোগই সমাজের প্রতিটি মানুষের জীবনে মূল্যবোধ নিশ্চিত করতে পারে। ব্যক্তির মূল্যবোধের উপরই নির্ভর করে জাতীয় মূল্যবোধ, জাতীয় শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা। অমূল্য জীবনে মূল্যবোধ নিশ্চিত করতে হলে নিম্মবর্ণিত পংক্তিটি অনুসরণ করা যায়-
মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন,
হয়েছেন প্রাতঃ স্মরণীয়,
সেপথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধবজা ধরে
আমরা হবো হে বরণীয়।
লেখক: অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক, নায়েম, ঢাকা।

শেয়ার করুন

Leave a Reply