সত্য কথা মানতে কঠিন

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন ::
আমাদের সংস্কৃতিতে একটা কথা বেশ প্রচলিত ‘সত্য কথা শুনতে কর্কশ’। এটা হতে পারে নবী করিম (সঃ) এর হাদিস, হতে পারে হজরত আলী (রাঃ)এর অমর বাণী, হতে পারে তারও আগে থেকে প্রচলিত আরবীয় বচন। এ ব্যাপারে আমি ষোল আনা নিশ্চিৎ নই। রবি ঠাকুর এটা জানতেন কিনা তা আমি জানি না, তবে তিনি তাঁর একটা বিখ্যাত কবিতায় এই বিষয়টার কিছুটা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘সত্য যে কঠিন/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম/ সে কখনো করে না বঞ্চনা—–।’ কবির কবিতাখানার এ চরণটার অর্থ নিশ্চয়ই ব্যাপক ও গভীর। অনেকে এর অনেক ধরণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও করেছেন। আমি সাদামাটাভাবে যা বুঝি, তাতে শব্দগতভাবে এখানে দু’টো বিষয় ধরা পড়ে। প্রথমতঃ ‘সত্য কঠিন।’ দ্বিতীয়তঃ ‘কঠিন কাউকে বঞ্চনা করে না।’ এ দু’টোর যোগসূত্র থেকে যৌক্তিকভাবে একটা উপসংহারও টানা যায় এই বলে যে, সত্য যেহেতু কঠিন, তাই সত্য কাউকেও ঠকায় না। কথাটা ঠিক। যা সত্য, তাহাই খাঁটি; যাহা সত্য, তাহাই নির্মল।

সত্যের মধ্যে কোনো ভেজাল নেই, ছলচাতুরী নেই, নেই কোন ভÐামি। সে সব জায়গায় সব সময়ই সত্য। তার মাঝে কোনো লুকোচুরি নেই, নেই প্রতারণার লেশমাত্র। সত্য সব সময় সত্য হিসেবেই আমাদের মাঝে এসে ধরা দেয়। কিন্তু অনেক সময় আমরা আমাদের অপারগতা ও কুপ্রবৃত্তির কারণে সত্যকে সত্য হিসেবে বোঝতে চাই না, বুঝি না, গ্রহণ করতে চাই না বা গ্রহন করি না। এক কবির কবিতায় পড়েছিলাম, ‘সত্য! সে তো দুর্বল, তাকে আদালতে প্রমাণ করতে হয়!’ ওই কবি অত্যন্ত হতাশার সুরে বলতে চেয়েছেন। ‘সত্য, সে তো চিরকালীন সত্য, সর্বদা দিনের আলোর মত উদ্ভাসিত হয়ে থাকবে। তাকে কেন সাক্ষীসাবুদ দিয়ে আদালতের সামনে প্রমাণ করতে হবে? তিনি আরো বলেছিলেন, উপযুক্ত তথ্য ও উপাত্ত, যুক্তির জোর এবং সাক্ষীপ্রমাণ না থাকলে সত্য চাপা পড়ে থাকে আড়ালে আবডালে, হারিয়ে যায় মিথ্যার মরীচিকায়। আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সত্য কেন নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারে না? সে এত দুর্বল কেন? কবির এতসব আফসোসের উত্তরে আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই, ‘সত্য সর্বদাই আলোয় উদ্ভাসিত। আমাদের চোখের কৃত্রিম আবরণের জন্য আমরা তাকে দেখতে পাই না, মগজের স্বপ্লতার জন্য বুঝতে পারি না, এবং কল্বের কালিমার জন্য মেনে নিতে পারি না। সত্যকে অনেক সময় দেখেও দেখি না, বুঝেও না বোঝার ভান করি। আর এসব ঘটে আমাদের তথ্য উপাত্তের ভেজালের কারণে, যুক্তির দূর্বলতায় এবং শয়তানের কুমন্ত্রণায়। ফিরে আসি রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃিততে। এ ব্যাপারে আজ আমি আপনাদের নজরে আনতে চাই তৃতীয় আরেকটি বিষয়। তা হলো মানুষের ভালোবাসার ধরণ, চরিত্র ও তার বৈশিষ্ট্য। কবি বলছেন, মানুষ কঠিনকে ভালোবাসে, কারণ কঠিন বঞ্চনা করে না। তার মানে কি এরকম যে যা কঠিন নয় তা বঞ্চনা করতে পারে ?

কথাটা অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, জীবন জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিদিন কত মানুষের সাথেই তো আমরা মেলামেশা করে থাকি। তার মধ্যে কেউ না কেউ আমাদেরকে ঠকাতে পারে, আমাদের সাথে প্রতারণা করতেই পারে। অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার খাতিরে এটাকে আমরা অনেকটা মেনেও নেই, কিন্তু যাকে আমরা ভালোবাসি, যে আমাদের নিখাদ ভালোবাসার পাত্র, যে আমাদের নিজের, একান্তই আপন, তার কাছ থেকে আমরা কোনো ধরণের প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা আশা করি না। অন্যেরটা পারলেও প্রিয়জনের প্রবঞ্চনা আমরা মেনে নিতে পারি না, সহ্য করি না। এ বিষয়টির গভীর দার্শনিক এবং মনস্তাত্তি¡ক তাৎপর্য থাকতে পারে, কিন্তু এটাও আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য নয়। আজ আমি যা নিয়ে লিখতে চাই তার সঙ্গে ‘ সত্যের কঠিন’ একটা ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে, কিন্তু সেটা একটু অন্য রকমের। তাই আমি বলতে চাই, আমাদের জীবন চলার পথে সত্য প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে আমাদের দরজায় এসে কড়া নাড়ে। কখনো সজোওে, কখনো নীরবে। কোনো সময় আমরা সত্যের উপস্থিতি অনুভব করি আবার কোনো সময় করি না। স্বাভাবিক জীবনের স্বাভাবিক ব্যস্ততার মধ্যে সত্য আমাদের সামনে প্রতিদিনই হাজির হয়ে তার অস্তিত্বের জানান দেয়। সত্য দুয়ারে এসে বলতে থাকে, ‘আমি কঠিন, আমি সুখ, আমি দুঃখ, আমি বাস্তব, আমি সত্য, আমি হাজির, আমি আছি তোমাদেরই আশেপাশে, আমাকে দেখ, আমাকে বোঝার চেষ্টা কর, আমাকে স্মরণে রাখ, আমাকে ভুলে যেও না’। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এ জানান দেওয়ার একটাই অর্থ হতে পারে। আর তা হল, আমাদের জীবনকে সহজ, সরল, সঠিক পথের ওপর নিরন্তর ধরে রাখা।

আমার পারিবারিক জীবনের একটা বাস্তব উদাহরণ দিলেই বিষয়টা আপনাদের সামনে খোলাসা হয়ে যাবে। আমার দাদা-দাদী, নানা-নানী সকলেই আমাকে অনেক ¯েœহ ও আদর করতেন। কারণ আমি তাঁদের বড় নাতি। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র হঠাৎ বাড়ী থেকে খবর পেলাম দাদাভাই আমাকে দেখতে চায়। দ্রæত বাড়িতে আসলাম, তিন দিন কথা বন্ধ থাকা দাদা ভাই শোয়া অবস্থা থেকে জেগে উঠলেন এবং আমাকে জড়িয়ে ধরলেন! ডাক্তার বললেন এই এই ঔষধ লাগবে। ঔষধ কিনতে বাজারে গেলাম, ফিরে এসে তাঁকে জীবিত দেখতে পাই নাই। নানাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য হাসপাতালে নেয়ার পথে আমার কোলেই মৃত্যুবরন করতে দেখেছি। দাদী ও নানীকে বাড়ীতে গিয়ে জীবিত দেখি নাই, তবে জানাজায় শরিক হয়েছি। যারা এত শ্রম দিয়ে কোলে পিঠে করে নিজে না খেয়ে আমাকে খাইয়েছেন, মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা দিয়েছেন। তাঁদের জন্য কতটুকুই বা করেছি ? ব্যস্ততা আমাদেরকে আষ্টে-পিষ্ঠে বেধেঁ রেখেছে। মিথ্যা মায়াজালে কতইনা সত্যের বিরোধিতা করি, মিথ্যার জয় দেখিয়ে কখনো কখনো লাভবান হই। কিন্ত কিছুই স্থায়ী নয়। ”আজ যা আছে, যা নিয়ে আমি বড়াই করি, কালতো তা অন্যের হাতেই চলে যাবে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম”। তাহলে কেনই এতা অবিচার, এতো হতাশা, এতো অহংকার, ইত্যাদি। যাদের নিয়ে এতা ভাবি একদিন তারাও সত্যের কাছে হার মানবে। এক সময় দেখেছি ও উপলব্ধি করেছি আমার বাবা-মা অপেক্ষা করতেন কবে তাঁদের ছেলে বাড়ী আসবে। এখন যদি আমার বাবুদেরকে গ্রামের বাড়ি যেতে বলি তারা বলে কেহতো আর এখন আমাদের আদর করে কোলে তুলে নেবার নাই সুতরাং ———-। None of our parents would remain alive! Nothing around us is perpetual, except the presence of Allah – the Almighty!
লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়

শেয়ার করুন

Leave a Reply