হাজীগঞ্জে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন মুক্তিযোদ্ধা গাজী আলী আহম্মদ

শাখাওয়াত হোসেন শামীম :
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী আলী আহমদ (লাল মুক্তিবার্তা নং-২০৫০৩০১১৪)। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে এবং দেশমাতৃকার টানে সেদিন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। দেশকে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাক হানাদার বাহিনীর উপর। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের অবদানে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি হলো। বিশ^ দরবারে মাথা উঁচু করে বীরের জাতী হিসেবে পরিচিতি পেলাম আমরা।
কিন্তু গাজী আলী আহমদ নিজেই পরাধীনতার মধ্যে রয়ে গেলেন। নেই তার ভিটেমাটি। থাকেন অন্যের বসতঘরে। রোগে-শোকে জর্জরিত। টাকার অভাবে নিয়মিত চিকিৎসা হচ্ছেনা। শরীরে যখন শক্তি ছিল, তখন একাই সংসারের ঘানি টেনেছেন। কিন্তু এখন আর পারছেন না। আজ বয়সের ভারে তিনি ন্যুয়ে পড়েছেন। তার চোখে ক্যান্সার, হার্টে দুইটি ব্লক এবং ফুসফুসের চিকিৎসায় বছরে প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার প্রয়োজন।
মুক্তিযোদ্ধা গাজী আলী আহমদ চিকিৎসা করাবেন কি দিয়ে..? সম্মানি ভাতা যে ১২ হাজার টাকা পান, তা দিয়েই কোন মতে খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছেন। তিনি উপজেলার হাটিলা পশ্চিম ইউনিয়নের ধড্ডা গ্রামের বাসিন্দা। তার স্ত্রী, ২ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। এর মধ্যে এক ছেলে ও এক মেয়ে শারিরিক প্রতিবন্ধী। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েকেও তার দেখতে হয়।
গাজী আলী আহমদের খালু মৃত ডা. ছলিম উদ্দিনের দেয়া কাঁচারি ঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতেন। কিন্তু সেই ঘরটি বসবাসের অনুপযোগি হওয়ায় বর্তমানে অন্য এক আত্মীয়র ঘরে থাকছেন। কিন্তু সেই ঘরটি তাদের প্রয়োজন হলে, মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকু তিনি হারাবেন। তাই এই বয়সে কোথায় যাবেন, কিভাবে চিকিৎসা করাবেন আর কিভাবে পেট ভরে দুই মুঠো ভাত খাবেন..? এই দু:শ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটান তিনি।
গাজী আলী আহমদের স্ত্রী ছায়েরা খাতুন রানু জানান, তাঁর স্বামীর চিকিৎসা ও ঔষুধের জন্য মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা প্রয়োজন। অথচ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি ১২ হাজার টাকার ভাতাই তাদের একমাত্র আয়। তাই টাকার অভাবে স্বামীর চিকিৎসা করাতে পারছেন না। তিনি বলেন, থাকি অন্যের ঘরে। যেখানে স্বামীর চিকিৎসা করাতেই পারছিনা, সেখানে জায়গা (ভূমি) কিনবো (ক্রয়) কি করে..?
কথা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমদের সাথে। তিনি জানান, সরকার অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর দিচ্ছে কিন্তু ভূমি না থাকায় আমি সেই ঘর পাচ্ছিনা। তিনি বলেন, আমার পৈত্রিক কোন সম্পত্তি নেই। বুঝ-জ্ঞান হওয়ার পর দেখি খালুর দেয়া একটি কাঁচারি ঘরে বাবা, মা ও ৯ বোনসহ বসবাস করছি। একে একে সব বোনের বিয়ের হয়ে যায়। এক সময় বাবা-মা মারা যান। আমি স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে সেই কাঁচারি ঘরেই বসবাস করছিলাম। কিন্তু কাঁচারি ঘরটি বসবাসের অনুপযোগি হওয়ায় এখন অন্য এক নিকট আত্মীয়ের ঘরে আছি।
তিনি আরো বলেন, জমি কেনার জন্য কিছু সঞ্চয় করেছিলাম। কিন্তু ক্যান্সার, হার্টে ব্লক এবং ফুসফুসে ইনফেকশন হওয়ার পর চিকিৎসা বাবদ সেই টাকা খরচ হয়ে যায়। কান্নাজড়িত কন্ঠে গাজী আলী আহমদ বলেন, এখন আমি নি:স্ব। থাকার জায়গা নেই। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছিনা। তাই বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসনিার সরকারের কাছে আকুল আবেদন, আমাকে একটু আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিন। অন্তত নিজ ঘরে যেন মাথা পেতে মরতে পারি।
এদিকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে (নং- ৪৮.০০.০০০০.০০৫.১৬.০০২.২০-৩৩) ‘অস্বচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন নির্মাণ’ কথা বলা হয়েছে। সেই প্রজ্ঞাপনের নির্দেশীকা ১.১.৫ নম্বরে বলা হয়েছে ‘যে সকল অস্বচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধার কোন ভিটি জমি নাই, তাঁদের অনূকুলে আবাসন নির্মাণের উপযোগি খাস জমি দখলে থাকলে, কিংবা খাস জমি বন্দোবস্ত দেয়া সম্ভব হলে জমি বন্দোবস্ত প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদানপূর্বক বাসস্থান বরাদ্দ প্রদান করা যেতে পারে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বৈশাখী বড়ুয়া বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী আলী আহমেদ ঘরের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু উনার ভিটি-জমি নেই, বিষয়টি তিনি আমাদের জানান নি। তিনি ভিটি জমির জন্য আবেদন করলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে ইউএনও বলেন, ক্যান্সার, কিডনি ও হৃদরোগসহ বেশ কয়েকটি জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য সরকার সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা করে থাকে। তিনি যদি আবেদন করেন, সে ক্ষেত্রেও আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।

শেয়ার করুন

Leave a Reply