১৫ আগস্ট-হত্যাকাণ্ড স্বাধীনতা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন ::
‘তোমার নেতা, আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’। ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’। ‘জেলের তালা ভাঙতে হবে, শেখ মুজিবকে আনতে হবে’। ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। এ ধরনের অসংখ্য শ্লোগান নিয়ে, পাটখড়ির মাথায় কাগজ দিয়ে বানানো বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে গ্রামের পথে-প্রান্তরে সহপাঠীদের নিয়ে কত যে মিছিল করেছি, সেসব কথা মনে হলে আজও মনটা আনন্দে ভরে উঠে। আমরা তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করতে ব্যস্ত, ক্লাসের আগে-পরে সুযোগ পেলেই মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। হয়তোবা রাজনীতি, অর্থনীতি, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি বুঝতাম না, তবে এটা বুঝতাম দেশের স্বার্থে কথা বলায় বঙ্গবন্ধুকে বার বার বন্দি করে জেলে রাখা হচ্ছে। তখন দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রায় সকলেই শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোবেসে তাঁর পক্ষেই কাজ করছে, সবাই তাঁকে আত্মার সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতম করে হৃদয়ে ধারণ করে নিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের অন্তরের গভীরে পৌঁছেছিল সেই মরণজয়ী ডাক–‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…’। হঠাৎ করেই ডাক এবং এরপর মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তঝরা সংগ্রাম এবং তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করেছি বিজয় এবং বাংলার মানুষের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা।
সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশটি এগুচ্ছিল ভালভাবেই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ সম্প্রসারণ, নানা বিষয়ে সমঝোতা ও সমম্বয় সাধন, আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহে অন্তর্ভুক্তি, সংহতি ইত্যাদি কার্যক্রম চলছিল দ্রুততার সঙ্গে। কিন্তু হঠাৎ করেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালবেলায় বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যায় এক নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার শত্রুদের হাতে সপরিবারে নিহত হন ভোর ৫.৪০ মিনিটে ধানমন্ডিতে তাঁর নিজ বাসভবনে। এই ঘটনায় সমগ্র বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে পড়ে, পুরো বাঙালি জাতি হয়ে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অনেক বঙ্গবন্ধুপ্রেমী আত্মহত্যা করে। কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে আমার মতো ছোট ছেলেটিও বেশ কিছুদিন ভালভাবে কোনো খাবার-দাবার গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। সারাদেশে কারফিউ দেয়া হলো, কিছুক্ষণ পর পর রেডিওতে ঘোষণা দেয়া হলো, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোনো কথা বলা যাবে না, লোকজনকে জড়ো হতে দেখলে গুলি করা হবে ইত্যাদি। আতঙ্কিত বাংলার মানুষ তাদের প্রিয় নেতার লাশটি পর্যন্ত দেখতে পারেনি! গুটিকয়েক সেনা কর্মকর্তা সেই মরদেহ কঠোর পাহারায় হেলিকাপ্টার দিয়ে তাঁর জম্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে দাফন সম্পন্ন করে আসে। সেইদিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলের সকল অর্জন ম্লান করে দিয়ে দেশকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করে। শুরু করে মিথ্যা প্রচারনা ও ষড়যন্ত্র। আমরা জানি আগস্ট মাসটি শোকের মাস এবং ১৫ আগস্ট পিতৃহত্যা দিবস। এ মাসের প্রতিটি দিনই অনেক কষ্টের, কারণ এই মাসে আমরা হারিয়েছি জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যিনি ৪০-এর দশক থেকে ৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য বহু ত্যাগ স্বীকার করেছেন। যৌবনের বেশিরভাগ সময় বাংলার মানুষের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার জন্য জেল খেটেছেন। আমার মতে তিনি বেচেঁ থাকলে বাংলাদেশ অনেক পূর্বেই জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হতো-কারণ তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও দূরদর্শিতা আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেত অনেক অনেক দূর।

এই প্রজন্মের কাছে অবশ্য-প্রাসঙ্গিক কৌতূহল। বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা হলেন কী করে? তিনি ছিলেন রাজনৈতিক দলের একনিষ্ঠ আপসহীন কর্মী, একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন-তৈরি ও কর্মকাণ্ডের দক্ষতায়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিসারী দুঃসাহসিক পরিচালনায় দক্ষ। তারপর কখন যে মানুষটি নিজেকে ছাড়িয়ে, দলীয় সংগঠনকে ছাড়িয়ে সমগ্র জাতির কোটি মানুষের পিতা হয়ে গেলেন— কদাপি এমনটা হয় না। তাহলে অবশ্যই পেছনে রয়েছে বাংলার আপামর মানুষের দীর্ঘ বঞ্চনা-শোষণ-দাসত্বের চরম দুঃখভরা জীবন। জোরটা সেইখানেই, আমাদের আবহমান বাংলায় আমরাই করেছি ভাষা আন্দোলন আর বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন এই বঙ্গেই। ১৯৪৮-১৯৫২ কালখণ্ডে ভাষা আন্দোলন এবং সেই কর্মকাণ্ড থেকে বাঙালিত্বের আত্ম-অধিকার অভিযান, অতঃপর ’৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান থেকে ইতিহাস স্পষ্টই ধেয়ে গেল নিশ্চিত ‘বাংলাদেশ’ অভিমুখে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, এই বিশাল কর্মকাণ্ড সেই আমাদের অস্তিÍত্বের জন্যেই অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছিল।

‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা। বাংলার মাটি আমার জম্মস্থান।’ এই উক্তিটি ছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা, স্থপতি, রূপকার ও বাস্তবায়ক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, বাঙালির রাখাল-রাজা, জুলিওকুরি পদক বিজয়ী মহান নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বিবিসি সাংবাদিক একবার বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার সবল দিক কোনটি উত্তরে তিনি বলেছিলেন ̒ আই লাভ মাই পিউপল’ দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার দুর্বল দিক কোনটি উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ’আই লাভ মাই পিউপল টু মাচ’–যিনি গোপালগঞ্জ জেলার মধুমতী নদীর তীরবর্তী নিভৃত পল্লির ছায়াঢাকা গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, মঙ্গলবার রাত ৮ টায় জন্মগ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার বিখ্যাত শেখ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শেখ জহির উদ্দিনের সপ্তম উত্তর-পুরুষ শেখ লুৎফর রহমান এর তৃতীয় সন্তান। সাত কোটি বাঙালির কিংবদন্তিতুল্য নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব-কৈশোর এবং যৌবন কেটেছে গোপালগঞ্জের গ্রামীণ পরিমণ্ডলে! অথাৎ কৃষি আর নদীবিধৌত বাংলায় ভিত তৈরি হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯২৭ সালে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারী হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলিকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়লেন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে। তাঁর জন্যে সেইটাই যেন স্বাভাবিক বা অনিবার্য ছিল। কলকাতার রাজপথে-ময়দানে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন। সারা দেশ জুড়ে তখন গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল তরঙ্গ ‘ইংরাজ হটাও’ আন্দোলন তুঙ্গে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর ক্রান্তিকালে পরাশক্তির অধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে তখন দ্রুত পালাবদলের প্রক্রিয়া। কে জানত তখন মুসলিম লীগের পাকিস্তানিত্বের কোটর থেকে কোন অলক্ষ্যে জন্ম নিচ্ছে একজন এবং তিনি হয়ে উঠবেন বাঙালিত্ব স্থাপনার মহানায়ক।
বঙ্গবন্ধু কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আই.এ এবং ১৯৪৭ সালে বি.এ পাশ করে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এই সময়মধ্যে প্রায়শই কারাভ্যন্তরে কখনো প্রতিবাদ অনশনে, কখনো রাজপথে দুঃশাসনের সরকার বিরোধী মিছিলের নেতৃত্বে, পুলিশের লাঠিচার্জ–এই সবই তাঁর অঙ্গসত্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসই নির্মাণ করে কোনো ব্যক্তিকে, যাঁরা সত্যিকারের ইতিহাসের সন্তান। বর্তমান শতকের এশিয়া ভূখণ্ড থেকেই উদাহরণ টেনে বলা হয়—আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আর্তাতুক, ভারতের বাপুজি মহাত্মা গান্ধী, ভিয়েৎনামের আঙ্কল হো’, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ, মালয়েশিয়ার টিংকু আব্দুর রহমান, নামিবিয়ার স্যাম নুজুমা এবং তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়ারের ন্যায় এই তালিকায় সংযোজন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের সৌভাগ্য যে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্রায়তন একটি দেশে আমরা তাঁকে পেয়েছিলাম।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ৫৫ বছরের জীবনকালের অধিকাংশ সময়ই বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অতিবাহিত করেছেন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গ্রেফতার হয়েছেন, কারাগারে দিনের পর দিন অনশন করেছেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করলে পাকিস্তানি জালেমরা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে মাত্র ৫৬ দিনের ব্যবধানে আবার ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন। কুখ্যাত আইয়ুব খান সামরিক শক্তির ছত্রছায়ায় ক্ষমতায় আসীন হয়েই বাঙালিদের উপর ব্যাপকভাবে নির্যাতন শুরু করেন। বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ বাঙালির মুক্তির সনদ ‘ছয় দফা কর্মসূচী’ ঘোষণা করেন। ছয় দফার প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু বলেন – ‘আমরা চাই তথাকথিত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অবসান ঘটুক এবং রাজনীতি মানুষের অধিকারে আসুক। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ঘোষণা এবং ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ। বঙ্গবন্ধু কোন মিলিটারি বিশেষজ্ঞ বা যুদ্ধ গবেষক ছিলেন না, তবুও ১৮ মিনিটের একটি ভাষণে তখনকার পরিস্থিতিতে কি কি করণীয় তার সবই বলে দিলেন একজন গেরিলা কমান্ডারের মতো। কিভাবে সরকার গঠন করতে হবে, কিভাবে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে, তার রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সামরিক দিকগুলো বলে দিলেন।

সময় মাত্র পাঁচ বছর, এ সময়ে বাংলাদেশের জন্যে বিস্ময়কর দ্রুততায় ইতিহাসের রথচক্রের আবর্তন ঘটে। কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার সংকল্প নিয়ে যিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’। বজ্রকণ্ঠে তাঁর অজেয় আহ্বান, ‘আমার পয়সায় কিনা অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আজ আমার মানুষের বুকের উপর’। ‘তোমাদের উপর আমার নির্দেশ রইল-যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ!’ ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। …এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ দেশবাসী একান্ত চিত্তে তাই চাইছিল। দীর্ঘকালব্যপী মানুষের বঞ্চনা, ক্ষোভ, প্রতিবাদ এ সমস্ত কিছু সংগঠিত করে একটি বিশেষ স্রোতমুখে বইয়ে দেবার ব্যাপক বিশাল কর্মকাণ্ড রয়েছে। দেশের সর্বত্র অসংখ্য কর্মীকে নিয়ে প্রতিরোধের দেয়াল নির্মাণ করতে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে অন্দোলনে যারা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা জানেন বাংলাদেশের ইতিহাস কাজ করে গেছে শেখ মুজিব নামের মানুষটির ভেতর দিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর ছিল হিমালয়সম দৃঢ়তা আর বাঙালি জাতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাই তো ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণাকালে বাগেরহাটের এক জনসভায় বলেছিলেন – ‘শুধু প্রধানমন্ত্রী কেন, সারা দুনিয়ার ঐশ্বর্য আর ক্ষমতা আমার পায়ের কাছে ঢেলে দিলেও আমি দেশের, বিশেষ করে বাংলার বঞ্চিত মানুষের সাথে বেঈমানি করতে পারব না।’ ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০ আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা দেন এবং বাঙালি জাতিকে বিশ্বের কাছে বীরের জাতি হিসেবে তুলে ধরেন। অবশেষে এসে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের সেই কাল রাত ২৫শে মার্চ। শুরু হয় গণহত্যা। রাত সাড়ে বারোটায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র‘। তারপর হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে বাঙালির শ্লোগান ছিল – ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’। ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
১৯৭১-এ সর্বত্র পাকিস্তানি সৈন্যের জেনোসাইড। দেশে সাধারণ গণমানুষের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। সর্বাত্মক প্রতিরোধ সংগ্রাম উজ্জীবিত হয়েছে এবং বিজয়ী হয়েছে অনুপস্থিত নেতার প্রেরণা। কী সেই প্রেরণা যা ঐ সময়ে কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল? আমরা স্মরণ করব মরণজয়ী ঐ মন্ত্র যা আমাদেরকে অকুতোভয় ও দুঃসাহসী করে তুলেছিল। শেখ মুজিব নামের মানুষটি তখন আর রক্তমাংসের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দেহধারী মাত্র নন, আমাদের সমুদয় আকাক্সক্ষা আর স্বপ্ন নিয়ে তিনি একটি অনড়, অটুট বিশ্বাসে পরিণত। মুক্তিযুদ্ধের ঐ সময়টাতে বঙ্গবন্ধু দেড় হাজার মাইল পশ্চিমে পাকিস্তানের জিন্দানখানায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বন্দি। মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামের সেনাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দেশদ্রোহিতার।
সন্দেহাতীতভাবেই বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিলো তাঁর দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি একটা ‘সোনার বাংলা’ গড়তে চেয়েছিলেন, যে ‘সোনার বাংলা’র উপমা তিনি পেয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে, ভালোবেসে তিঁনি ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নকে তার দেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেছিলেন। বাংলাদেশ নামক মূল্যবোধ থেকে আমাদের সন্তানেরা ক্রমে সরে যাচ্ছে এক বৈরী ভুবনে। নিজ জন্মের সত্যটাকে যেন ভুলে না যাই। আসুন সকলের সম্বলিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।। এই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।।

লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক, নায়েম, ঢাকা ।

শেয়ার করুন

Leave a Reply