১৯৭১ সালের ১২ মার্চ : কুর্মিটোলা মার্শাল ল’ অফিস ছাড়া কোথাও পাকিস্তানী পতাকা ওড়ে নাই

মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান ::

১৯৭১ সালের ১২ মার্চের পত্রিকায় অনেকগুলো সংবাদের মধ্যে দুটি সংবাদ গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো- এয়ার মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) আজগর খানের মন্তব্য, ‘কুর্মিটোলা মার্শাল ল’ অফিস ছাড়া কোথাও পাকিস্তানী পতাকা দেখি নাই’; দ্বিতীয়টি হলো- ন্যাপ নেতা মওলানা ভাসানীর মন্তব্য, ‘সাত কোটি বাঙ্গালীর নেতা শেখ মুজিবের নির্দেশ পালন করুন’। বাংলাদেশের বাস্তব রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে চলে এসেছেÑ এটা তার প্রমাণ। এছাড়া দেশের আপামর জনসাধারণ যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গতিপথ যে রুদ্ধ করা শুরু করেছে এবং এর ফলে তাদের নতুন সামরিক আদেশ জারি করতে হয়েছে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সিগনাল। এ সময়ে জনাব ভূট্টোর গোঁয়ার্তুমি কমতে শুরু করেছে বলেও প্রতীয়মান হয়।
কুর্মিটোলা মার্শাল ল’ অফিস ছাড়া কোথাও পাকিস্তানী পতাকা দেখি নাই-আজগর খান
এয়ার মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) আজগর খান দেশবাসীকে সতর্ক করিয়া দিয়া বলেন যে, অত্যন্ত দ্রুত সময়ের পট পরিবর্তন হইতেছে এবং এই সময় দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত হইতে বাঁচাইতে হইলে যথাসম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে।
তিনি বলেন যে, কেবল কুর্মিটোলা মার্শাল ল’ দফতরসমূহে ছাড়া অন্য কোথাও পাকিস্তানের পতাকা তাঁহার দৃশিৎষ্টগোচর হয় নাই। আজগর খান শেখ মুজিবকে কার্যত: সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করিয়া বলেন, অথচ সকল সরকারী কর্মচারী ও সেক্রেটারী শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ পালন করিতেছে। তিনি বলেন, সরকারের এখন উচিত শেখ সাহেবের পূর্ব শর্তসমূহ মানিয়া লইয়া ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কারণ গত তেইশ বৎসর যাবত অপমানিত ও নিস্পেষিত হওয়ার যে ধারণা বাঙালীদের মনে বাসা বাঁধিয়াছে, তাহার ফলে ইহার বিন্দুমাত্র রদবদলে তাহাদের সন্তষ্ট করা যাইবে না।
‘সাত কোটি বাঙ্গালীর নেতা শেখ মুজিবের নির্দেশ পালন করুন’Ñমওলানা ভাসানী
ন্যাপ নেতা মওলানা ভাসানী গতকাল টাঙ্গাইলে বলেন, পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কোন রকম বিভেদ থাকা উচিত নয়। তিনি সর্বস্তরের জনগণকে একত্রিত হইয়া লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পরিচালনা করার আহ্বান জানান। বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ভঅষণ দানকালে মওলানা ভাসানী বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণ এখন তাহাদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হইয়াছে। বাঙালীর স্বার্থের প্রশ্নে আপোষ করার দিন চলিয়া গিয়াছে। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সমর্থন দান করিয়া মওলানা ভাসানী সকলকে সাত কোটি বাঙালীর নেতার নির্দেশ পালনের আহ্বান জানান।
আওয়ামী লীগের নির্দেশÑ চুড়ান্ত বিজয়ের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কঠোর শৃংখলা রক্ষা করিতে হইবে, হরতালের ক্ষেত্রে ‘অব্যাহতির’ আওতা সম্প্রসারিত
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজুদ্দীন আহমদ গতকাল (বৃহস্পতিবার) সংবাদপত্রে প্রেরিত এক বিবৃতিতে বলেন : জনগণের আন্দোলন নজীরবিহীন তীব্রতা লাভ করিয়াছে। বাংলা দেশের জনগণের নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেসব নির্দেশ দিয়াছেন, প্রতিটি লোক আপন আপন স্থানে থাকিয়া পবিত্র দায়িত্বজ্ঞানে তাহার সবগুলি কার্যকর করিয়া তুলিতেছেন বলিয়াই এরূপ সম্ভব হইয়াছে। জীবনের প্রতিটি স্তরের লোকজনের দায়িত্ববোধ সকলের জন্যই অনুপ্রেরণার উৎস। এই সংগ্রাম অব্যাহত রাখার সাথে সাথে সর্বোচ্চ হারে উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং আমাদের অর্থনীতিকে পরিপূর্ণভাবে চালু রাখার জন্যও আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করিতে হইবে।
শেখ মুজিব সকাশে খুরশিদ
পাঞ্জাব প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সভাপতি এম. খুরশিদ গতকাল সকালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেক মুজিবুর রহমানের সহিত তাঁহার ধানমন্ডীস্থ বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। সাবেক স্বরাষ্ট্র সেক্রেটারী ও পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ প্রধানের সহিত দেশের রাজিৈনতক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেন বলিয়া জানা গেছে।
গম ভর্তি জাহাজের গতি পরিবর্তন করিয়া করাচী যাত্রা
পূর্ব পাকিস্তানের জন্য গমবাহী জাহাজ ভিনটেজ হরিজন (৩২০০০ টন) আগামীকাল চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছানোর কথা ছিল। কিন্তু এক্ষণে উক্ত জাহাজের গতিপথ করাচী অভিমুখে পরিবর্তিত করা হইয়াছে বলিয়া একানে স্থানীয় লিটারেজ কন্টাক্টরগণ কর্তৃক প্রাপ্ত এক তারবার্তায় জানা গিয়াছে।
১১৪ নং সামরিক আদেশ
গত বুধবার রাতে ঢাকার সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের এক ঘোষণায় বলা হয় যে, সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের স্বাভাবিক সরবরাহের ক্ষেত্রে মারমুখী জনতার বার বার বাধা সৃষ্টি সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর লোকেরা চরম ধৈর্যের পরিচয় দান করিতেছেন। পরিস্থিতি যাতে অবাঞ্চিত মোড় না নেয়, সেজন্য সেনাবাহিনীর লোকদের উস্কানীর মুখে সংযত থাকার নির্দেশ প্রদত্ত হইয়াছে।
ঘোষণায় বলা হয় যে, সরবরাহের ক্ষেত্রে যদি প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত থাকে, তবে উহা কঠোরভাবে দমন করা হইবে। আজ সিলেটে রেশন সংগ্রহে গমনকারী একটি কনভয়কে বাধা প্রদান করা হইলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। সৈন্যরা সাধ্যমত সংযমের পরিচয় দেন। যশোর এবং অন্যান্য এলাকা হইতেও এ ধরণের হস্তক্ষেপের খবর পাওয়া যাইতেছে।
‘খ’ এলাকার সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতর হইতে ১১৪ নং সামরিক বিধি জারি করা হইয়াছে। বিধিতে দুস্কৃতিকারীদের এই ধরণের কার্যকলাপ হইতে বিরত থাকিতে বলা হইয়াছে। নিম্নে ১১৪ নং সামরিক আইন নির্দেশের পূর্ণ বিবরণ প্রদত্ত হইল : যে কেহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারী সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করে, বা সশস্ত্র সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাহত হইতে পারে এইজন্য সেনাবাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় বা রাস্তা, রেলপথ. নৌযান ব্যবহার, বা বিদ্যুৎ বা পানি সরবরাহে বাধা প্রদান করিবে, তাহাদের কার্যকলাপ আক্রমণাত্মক কাজের সামিল হইবেÑ যাহা সংশ্লিষ্ট সামরিক আইনবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য।
কঠিন বাস্তবতাকে উপলব্ধি করুন- পঃ পাকিস্তানী নেতাদের প্রতি আতাউর রহমান খান
জাতীয় লীগ প্রধান জনাব আতাউর রহমান খান গতকাল সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী বন্ধুরা তাদের চিন্তাধারা নতুন ছাঁচে সাজাইয়া লইলেই সমস্যার সমাধান সহজ হইয়া যাইবে। বিবৃতিতে তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ও সামরিক সরকারের কর্তাব্যক্তিদের আমাদের দীর্ঘদিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তেইশ বৎসরের সম্পর্কের বহু উত্থান-পতন ও দ্বন্দ-সংঘাতের ইতিহাসের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া বলিতে চাই যে, জোর করিয়া কৃত্রিম সম্প্রতি রক্ষার প্রচেষ্টা হইতে বিরত থাকুন। রক্তপাত, হানাহানীর পথ পরিত্যাগ করুন।…..
ভূট্টোর প্রাণ কাঁদিতেছে তবু-
বাংলার শোক সন্তপ্ত পরিবারবর্গের জন্য জনাব ভূট্টোর “প্রাণ কাঁদিলেও’ শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট প্রেরিত তারবার্তায় অবস্থার কিন্তু কোন পরিবর্তন হয় নাই। ‘যে ভয়াবহ বিপর্যয় সমগ্র দেশকে গ্রাস করতে বসিয়াছে, তাহা হইতে দেশকে রক্ষা করিতে হইলে তাহাদের উভয়ের উপর এক বিরাট দায়িত্ব বর্তাইয়াছে। এবং সেই হেতু মানুষের পক্ষে যাহা কিছু করা সম্ভব আমাদিগকে করিতে হইবে’ বলিয়া শেখ সাহেবের নিকট প্রেরিত তারবার্তায় উল্লেখ করা হইলেও শেখ সাহেব জাতীয় পরিষদে যোগদানের প্রশ্নে যে চার-দফা সুস্পষ্ট দাবী জানাইয়াছেন, সে সম্পর্কে জনাব ভূট্টো নীরবতা পালন করিয়াছেন।…..
লেখকঃ পরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

শেয়ার করুন

Leave a Reply