বালুখেকো চেয়ারম্যান সেলিম খান কারাগারে থেকেও স্বপদে বহাল!
আইনীভাবে পদ থাকে না, জেলা প্রশাসনের এমন চিঠি মন্ত্রণালয়ে প্রেরন
চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় কারাগারে থাকা চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০নং লক্ষ্মীপুর ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন। কারাগারে থেকেই ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব পালন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন পরিষদ আইন অনুযায়ী তিনি আরও আগেই বরখাস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সেলিম খান এখনো চেয়ারম্যান পদে বহাল থাকায় বিস্মিত স্থানীয় লোকজন। তারা মনে করছেন, প্রভাবশালী চক্র নানামুখী তদ্বিরের মাধ্যমে সেলিম খানকে এখনো চেয়ারম্যানের পদে বহাল রেখেছেন।
এদিকে সেলিম খান স্বপদে থেকে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা প্রয়োগকে পরিষদের স্বার্থের পরিপন্থি এবং প্রশাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে সমীচীন নয় বিধায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে করে স্থানীয় প্রশাসন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রেরন করেছে। জেলা প্রশাসক সাক্ষরিত ঐ চিঠি পাঠানো হয়েছে ১৫ দিন আগে।
সেলিম খানকে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি জানিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে গত ১৬ অক্টোবর চিঠি দেয় জেলা প্রশাসন। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় গত ১২ অক্টোবর লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খানকে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান।
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘সেলিম খানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অপরাধে দুদক কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হওয়ায় এবং অপরাধ আদালত কর্তৃক আমলে নেয়ায় স্থানীয় সরকার আইনের (৩৪)১ ধারা অনুসারে উক্ত চেয়ারম্যান কর্তৃক ক্ষমতা প্রয়োগ পরিষদের স্বার্থের পরিপন্থি এবং প্রশাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে সমীচীন নয় বিধায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ বলে চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিয়েছেন জেলা প্রশাসক বরাবর । আর ঐ প্রতিবেদনের আলোকে সে চিঠি প্রেরন করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কিছুদিন ধরেই এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এ বিষয়ে ফাইল চালাচালি হচ্ছে। দু’ একদিনের মধ্যেই সেলিম খানকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব বলেন, নথিটি চলমান আছে। যখন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোন সিদ্ধান্ত দিবেন তখন আমরা জানাতে পারবো। এর আগে কিছু বলতে পারছি না।
মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যে চিঠিটি প্রেরন করেছে, তা মূল কপি ছিলো না। এটি ছিলো ছায়া কপি। কিন্তু এ ধরনের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিতে হলে স্থানীয় প্রশাসনের স্বাক্ষরিত মূল কপিটি প্রয়োজন হয়। তবে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ফের তাগিদ দিয়েছে বলে সূত্রটি জানায়।
উল্লেখ্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণে ৩৫৯ কোটি টাকা লোপাট চেষ্টাকাণ্ড বহু বছর ধরে পদ্মা-মেঘনা নদীতে বিপুল সংখ্যক ড্রেজার বসিয়ে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন করে অবৈধ বালু ব্যবসার সূত্র ধরে আলোচনায় আসেন ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান। তার অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করে প্রশাসন। বন্ধ করা নদী থেকে বালু উত্তোলন। ঠেকিয়ে দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণের নামে ৩৫৯ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা। এরই মধ্যে এসব বিষয়ে তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। সেলিম খানের অঢেল অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়ে মামলা দায়ের করা হয়। অপরদিকে রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তাদের তৎপরতায় বিজ্ঞ উচ্চ আদালত থেকে সেলিম খানের বিপক্ষে একাধিক রায় আসে। তাকে হাইকোর্ট ঘৃনিত ব্যক্তি হিসাবে আখ্যয়িত করে এবং রিট করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত বিষয়ে কাল ক্ষেপন করায় আদাল তাকে অর্ধকোটি টাকা জরিমানা করে। সে জরিমানার টাকাও সে জমা দেয়। এছাড়া তাকে আওয়ামী লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিস্কার করে জেলা আওয়ামী লীগ। তাছাড়া তার বিদেশ যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মিডিয়ার সাথে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাক্ষাত দেয়ায় তাকে সোকজ করা করা হয় জেলা প্রশাসন থেকে। উচ্চ আদালতের ২ টি রায়েই সেলিম খানের অবৈধ বালু উত্তোলন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ে দুর্নীতি ও অপকর্ম চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় । সবশেষ দুদকের মামলায় গত ১২ অক্টোবর আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত তা নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠান।
দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়, সেলিম খান অবৈধ উপায়ে ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ ৮১ হাজার ১১৯ টাকার সম্পদ তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতি পূর্ণভাবে নিজ ভোগদখলে রেখেছেন। এছাড়া তিনি ৬৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪৭৭ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। সেলিম খান যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেছেন, তা যাচাই-বাছাই করে অসঙ্গতি পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গতঃ স্থানীয় পরিষদ বিধিমালা তথা আইনে চেয়ারম্যান বা সদস্যগণের সাময়িক বরখাস্তকরণ ও অপসারণে বলা হয়েছে
৩৪। (১) যে ক্ষেত্রে কোন পরিষদের চেয়ারম্যান বা সদস্যের বিরুদ্ধে উপ-ধারা (৪) এ বর্ণিত অপরাধে অপসারণের জন্য কার্যক্রম আরম্ভ করা হইয়াছে অথবা তাঁহার বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলায় অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হইয়াছে অথবা অপরাধ আদালত কর্তৃক আমলে নেওয়া হইয়াছে, সেইক্ষেত্রে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের মতে চেয়ারম্যান অথবা সদস্য কর্তৃক ক্ষমতা প্রয়োগ পরিষদের স্বার্থের পরিপন্থী অথবা প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণে সমীচীন না হইলে, সরকার লিখিত আদেশের মাধ্যমে চেয়ারম্যান অথবা সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করিতে পারিবেন। ২০০৯ সালের এ আইনের ৩৪ (১) ধারায় বর্নিত এই আইন সম্পুর্নভাবে প্রজোয্য হয়েছে বলে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের সরকারি আইনজীবী এবং অন্যান্য সিনিয়র আইনজীবীরা তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন।