চাঁদপুরের পদ্মা মেঘনায় বালু সন্ত্রাস থামায় শীতেও জেলের জালে ধরা পড়ছে প্রচুর ইলিশ

সুফল পাওয়া শুরু

চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
চাঁদপুরের পদ্মা মেঘনার ৭০ কিলোমিটার নদী অঞ্চলে এই শীত মওসুমে জেলেদের জালে ছোটবড় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। যদিও শীতে তথা ডিসেম্বর জানুয়ারিতে ইলিশ খাওয়ার নেশা কিংবা শিকার, নদীতে প্রাপ্তি বা বেচা বিক্রির ধুম বর্ষার ভরা মওসুমের চাইতে অনেক কম থাকে। কিন্তু এ বছর সেটি অনেকটা বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই জেলেরা জালে ইলিশ মাছ পাচ্ছে বেশ। শহরের বড় ষ্টেশন চাঁদপুরের মাছের বড় আড়তেও ইলিশের স্থানীয় নদী অঞ্চলে ইলিশ আমদানি বেড়েছে। জেলার হাইমচরের চরভৈরবী থেকে মতলবের ষাটনল পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক জেলে শীত আর ঘন কুয়াশার মধ্যেও মাছ পাওয়ার কারনে ইলিশ শিকার করতে যাচ্ছে।
কেন এই সময়ে এতো ইলিশ ধরা পড়ছে জালে, এর কারণ হিসাবে মৎস বিজ্ঞানী, জেলে এবং ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেলো,
ইলিশের আবাসস্থল নিরাপদ রাখতে এবং সরকারি সম্পদ রক্ষায় চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনায় অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে নির্বিচারে বালু উত্তোলন বন্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছিলো সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলো। গতবছর নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে চাঁদপুর মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনের আলোকে তৎকালিন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অন্জনা খান মজলিশ ও তার প্রশাসন ড্রেজার ও বালুবাহী বাল্কহেড যেগুলো ইলিশের ডিম এবং রেনু পোনাকে ধ্বংশ করে দিচ্ছিলো, সেসব বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শুধু এক বালু খেকোরই পৌনে চারশ অবৈধ ড্রেজিং ও বাল্কহেড আটক করা হয়। ফলে নদী ভাঙন হ্রাস এবং দীর্ঘদিন পদ্মা মেঘনায় বালু সন্ত্রাস বন্ধ থাকায় সাগর ছেড়ে মা ইলিশ এই নদীতে নির্ভয়ে আসতে থাকে। সবমিলিয়ে জাতীয় মাছ ইলিশ বালুত্রাসদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং সেটির সুফল পাওয়া শুরু হয়েছে। ইলিশ গবেষক বর্তমানে বাংলাদেশ ইলিশ গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ( প্রশাসন ও অর্থ) ড. আনিস যিনি বছর দু’য়েক আগেও চাঁদপুর মহস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে ছিলেন, তিনিও এ মওসুমে ইলিশ বৃদ্ধি ও এ মওসুমে বেশি পাওয়ার একটা বড় কারণ হিসাবে ড্রেজারে বালু কাটা বন্ধে সুফল হিসাবেই দেখলেন। শুক্রবার বিকালে তার সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, আমরা আগেও বলেছি, আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষায় গবেষনায় এসেছে, চাঁদপুরে এমন নির্বিচারে বালু উত্তোলন ইলিশের প্রজননের জন্য ক্ষতিকর, এটি বন্ধ করতে হবে। এই বিজ্ঞানী আরো বলেন, এই বালু বন্ধ ছাড়াও এই শীতে আরেকটি বিষয়ও ইলিশ বেশি পাওয়ার অন্যতম কারন। আর তা হচ্ছে- ইলিশের প্রধান প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর অক্টোবর হলেও দ্বিতীয় প্রজনের সময়টা ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি। এই সময়ে সাগর থেকে প্রচুর মা ইলিশ ব্রিডিং করতে ছুটে আসে। ইলিশের ভরা মওসুমে প্রজনন ৭০ ভাগ পর্যন্ত। আর এই ডিসেম্বর জানুয়ারি দ্বিতীয় সময়ে ২৫ থেকে যা আরো বাড়তে শুরু করেছে। আরেক ইলিশ গবেষক ড. হারুনুর রশিদ যিনি এখন বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা ইনস্টিটিউটে কর্মরত এবং গতবছর চাঁদপুরে ইলিশ নিয়ে গবেষনা করেছেন, তিনিও বলেন, ইলিশের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে চাঁদপুরের পদ্মা মেঘনা অঞ্চল যথেষ্ট নিরাপদ হয়ে উঠেছে।
তার মতে, দ্বিতীয় ব্রিডিংটা মাইনর হলেও ইলিশ নিরাপত্তা আর নির্ভরতা পেলে ব্যাপকভাবে চলাচল করবে। ডিম ছাড়বে। এখন তাদের জন্য এই সুযোগটা বেশি। চাঁদপুর মৎস্য ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্রের মৎস্য বিজ্ঞানী যিনি ইলিশ নিয়ে বর্তমানে কাজ করেন, তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, আসলে আমি নতুন গবেষক। বালুর বিষয়টি আমাকে কিছু বলবেন না, এবিষয়ে আমি কোন গবেষনা করিনি, জানিও না, তা জানেন আমার পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীরা যারা এ বিষয়ে কাজ করেছেন। তবে ঐ কর্মকর্তা বলেছেন, এই শীতে ইলিশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলেরা তাদের জালে প্রচুর ইলিশ পাচ্ছে।
শহরের পুরানবাজার এলাকার জেলে লোকমান, আবু হানিফ, রাজরাজেশ্বরের সলেমান, কুদ্দুস শেখের সাথে কথা হলে তারা জানান, বালুর ড্রেজারের জন্য তো মাছই ধরা ছিলো মুশকিল। আর এর অত্যাচারে মাছও আইতো না। বিজ্ঞানী স্যারেরা বলছে, ড্রেজিং এর এই পানির ভিতরের যন্ত্রগুলা ডিম রেনু নষ্ট কইরা দিতো, পানিরে ঘোলা কইরা ফালাইতো। এজন্য আমাগো মওসুমেও শুন্য হাতে ফিরা আইতে হইতো। তারা জানায়, জাটকা রক্ষা অভিযান, মা ইলিশ রক্ষা এবং বালু সন্ত্রাস বন্ধ থাকলে আমরা নদীতে মাছ পামু – এইটা একদম ঠিক। তারাও সবাই স্বীকার করলো – ড্রেজারে গত ৮/৯ মাস বালু উত্তোলন বন্ধে ইলিশ ধরা পড়ছে।
প্রসঙ্গতঃ প্রতিবছরের ন্যায় আসছে মার্চ এপ্রিল দু- মাস ইলিশের পোনা জাটকা রক্ষায় ৭০ কিলোমিটার পদ্মা মেঘনা অভয়াশ্রমের এ অন্চলে ইলিশসহ সকল প্রকার মাছ শিকার বন্ধ রাখার বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে।

শেয়ার করুন