সরকারের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও চাঁদপুরে সরকারি কাজে পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক ব্যবহারের বাস্তবায়ন নেই

* একমাত্র কংক্রিট ব্লক তৈরি কারখানা মালিকের মাথায় হাত
* চলতি অর্থ বছরে ৬০ শতাংশ ব্যবহার বাধ্যতামূলক
* ২০২৫ সালে শতভাগ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আছে সরকারের

ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী :

পরিবেশ ও কৃষি জমি রক্ষায় মাটি পোড়ানো ইটভাটার চেয়ে পরিবেশবান্ধব কংক্রিট ব্লক কারখানা স্থাপনকে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কিন্তু চাঁদপুর জেলায় সরকারের এই নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই। বিশেষ করে সরকারি কোন স্থাপনা নির্মানে এই নির্দেশনা থাকলেও জেলায় তা মানা হচ্ছে না। সরকারি নির্মাণকাজে পোড়া মাটির ইটের পরিবর্তে চলতি অর্থবছর ৬০ শতাংশ কংক্রিট ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকার মাটির ব্যবহার কমাতে এবং মাটি রক্ষায় আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারের উন্নয়ন ও সংস্কার কাজে মাটি পোড়ানো ইট ব্যবহার নিষিদ্ধ করে শতভাগ ব্লক ব্যবহারের সিদ্ধান্তও নিয়েছে । আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারের উন্নয়ন কাজে মাটি পোড়ানো ইট ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে সতর্ক করা হয়েছে, উল্লেখিত সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনরুপ ব্যত্যয় বা ব্যর্থতার ক্ষেত্রে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলেও বলা আছে । কিন্তু এমন পরিবেশ বান্ধব কংক্রিট ব্লক চাঁদপুরে উৎপাদন হলেও জেলায় কোন সরকারি দফতরই এই ইট ব্যবহার করছেন না। অর্থবছর শেষ হতে চল্লেও এর ব্যবহার চোখে পড়েনি। অথচ কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ঋন নিয়ে এই রকম কারখানার এখানের মালিকের শুরুতেই হতাশ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
জানা গেছে, গণপূর্ত, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সরকারের এই ৪টি প্রকৌশল অধিদফতর দেশের সকল উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ করে থাকে। এরমধ্যে শিক্ষা প্রেেকৗশল অধিদফতর অন্যতম। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী গণপূর্ত এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর জেলায় কিছু কিছু প্রকল্পে ব্লক ব্যবহার শুরু করেছে। জানা গেলো, গণপূর্ত এবং স্থানীয় সরকার (এলজিইডি) প্রকৌশল অধিদফতর এখন থেকে সকল উন্নয়ন প্রকল্পের দরপত্রে শতভাগ কংক্রিট ব্লক বা ব্রিক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সরকারের চলতি অর্থ বছরের এখন ক্লান্তিকাল। চাঁদপুরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর এই কাজটি শুরুই করেনি । কোন কাজে একটি কংক্রিট ব্লক ব্যবহার তারা করেনি। এ জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন বহুতল ভবনগুলো তৈরি হচ্ছে পোড়া মাটির ইট দিয়েই । বাকি ছোটবড় ভবনগুলোও চলতি অর্থ বছর পোড়ামাটি ইট দিয়ে তৈরি হয়েছে।

শিক্ষামন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুর পুরানবাজার কলেজের একটি বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে পোড়া মাটির ইট দিয়ে। চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী নিবাসের কাজও তা দিয়েই। এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে জেলা সদরে স্বয়ংক্রিয় কারখানায় মানসম্মত ব্লক উৎপাদিত হলেও কেন সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে পোড়ামাটির ইট দিয়ে এ ভবন তৈরি করা হচ্ছে?
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯) এর ক্ষমতাবলে সরকারি সকল নির্মান, মেরামত ও সংস্কার কাজে ২০১৯-২০ অর্থ বছর থেকে ইটের বিকল্প হিসেবে কংক্রিট ব্লক ও ব্রিক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে সকল সরকারি উন্নয়ন ও সংস্কার কাজে শতভাগ ব্লক ব্যবহার করে ইটের ব্যবহার শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁদপুর জেলায় সরকারি উন্নয়ন কাজে চলতি বছর ব্লক ব্যবহারের হার প্রায় শূন্য। এসব কারনে কংক্রিট ব্লক উৎপাদনে আধুনিক কারখানা স্থাপনে উদ্যোক্তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সরকার উৎসাহিত করলেও চাঁদপুর জেলাসহ আশপাশের অধিকাংশ জেলাগুলোতে আধুনিক কংক্রিট ব্লক কারখানা স্থাপিত হয়নি। সেমি অটোমেটিক কিছু কারখানা থাকলেও সরকারি কাজে ব্লক ব্যবহার না হওয়ায় তারা উৎপাদিত পন্য বাজারজাত করতে পারছে না। ইটের বিকল্প কংক্রিট ব্লক এদেশে সম্পূর্ণ নতুন পন্য হওয়ায় চাঁদপুর জেলার এতদিন কোন নতুন উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীক ঝুকি নিতে চাননি। তবে চাঁদপুর জেলা সদরের শাহতলী এলাকায় প্রিমিয়াম ইকো ব্লকস লিমিটেড নামের একটি সর্বাধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় কংক্রিট ব্লক কারখানা স্থাপিত হয়েছে। সম্প্রতি কারখানাটির ব্লক বাজারজাতকরণ উদ্বোধনী করেন শিক্ষামন্ত্রী ড.দীপু মনি এমপি।
জানা গেছে, সম্প্রতি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রিমিয়াম ইকো ব্লকস লিমিটেডের চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন তার বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পরিবেশ দূষনের কারনে ৬৩ বছরের পারিবারিক ইটভাটা বন্ধ করে তিনি পরিবেশবান্ধব আধুনিক কংক্রিট ব্লক কারখানা স্থাপন করেছেন। কিন্তু সরকারি কাজে ব্লক ব্যবহার না হওয়ায় তার কোটি টাকার উৎপাদিত পন্য অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। তিনি লোকসান গুণছেন। এ কারনে নতুন কোন উদ্যোক্তা ব্লক কারখানায় বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। তিনি মন্ত্রীকে অবহিত করে বলেন,শিক্ষা প্রেেকৗশল অধিদফতর আজ পর্যন্ত কোন প্রকল্পেই ব্লক ব্যবহার করেনি। চাঁদপুর পুরানবাজার কলেজে একটি বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে পরিবেশ দূষনকারী মাটি পোড়ানো ইট দিয়ে। যা সরকারি নির্দেশনার পরিপন্থী। অথচ এই একটি ভবনই যদি কংক্রিট ব্লক দিয়ে নির্মান হতো তাহলে সরকারের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় হতো বলে প্রিমিয়াম ইকো ব্লকস লি: এর চেয়ারম্যান জানান। তিনি চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি তার ফার্মের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করে বলেন, এই একটি কলেজও যদি শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর পোড়ানো ইটের বদলে শতভাগ পরিবেশ বান্ধব ব্লক দিয়ে নির্মান করতো তাহলে নতুন নতুন ব্লক কারখানা স্থাপন উৎসাহিত হতো। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও এর ভালো দিক সম্পর্কে তুলে ধরে বক্তব্য দেন এবং এর ব্যবহার বাড়াতে হবে বলে মত ব্যক্ত করেন।তাছাড়া নিজ নির্বাচনী এলাকায় এমন কারখানা তৈরি হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
এই বিষয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চাঁদপুরস্থ সহকারি প্রকৌশলী স্বপন দত্ত জানান, মাটির ব্যনহার কমিয়ে আনার জন্য এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এই ব্লকস অনেক উপযোগী এবং সাশ্রয়ী। কিন্তু আমাদের অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে লিখিত কোন নির্দেশনা আমাদের দেয়নি। এ ব্যাপারে যখন মন্ত্রনালয় বা অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত দেবে লিখিত, তখন আমরা অবশ্যই করবো। তিনি বলেন, আমাদের কাজ বা সিডিউল ঘোষনায় যা আসে উপর থেকে তাতে, এই ব্লকস এর কথা থাকে না। থাকে মাটির তৈরি ব্রিকস এর কথা। তাহলে এটা আমরা করি কিভাবে? তবে এটি ব্যবহার করা ভালো বলে ঐ প্রকৌশলী জানান।
স্থানীয় গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রফিবুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমাদের চীফ ইন্জিয়ার প্রকৌশল অধিদপ্তর কার্যালয় থেকে সম্প্রতি নির্দেশ এসেছে, পোড়ানো ইট আর ব্যবহার না করতে এবং সামনে যতোগুলো কাজ হবে তা কংক্রিট ব্লকসই হবে। তিনি জানান এই নির্দেশনা পেয়ে আমরা একটা গাইড ওয়ালের কাজ ব্লকস দিয়ে শুরু করেছি। এ কর্মকর্তাও জানান, প্রধানমন্ত্রীর নিজেরও নির্দেশনা আগের। আমাদের নির্দেশনা উপরের পাওয়া যায়নি বলে দেরি। তিনি বলেন আল্টিমেটলি মাটির ব্যবহার কমাতে এবং রক্ষায় এই কংক্রিট ব্লকের বিকল্প নেই। তাই এর উৎপাদন কারিদের এখনই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। প্রসঙ্গত : একটা কংক্রিট ব্লক পাঁচটা ইটের সমান। প্লাস্টার লাগে না। ইটের চেয়ে নির্মানে খরচ কমে ৩০ শতাংশ। বাড়ির স্থায়িত্ব বেশি, দেখতেও সুন্দর। ভবন গ্রীষ্মকালে ঠাণ্ডা, শীতকালে গরম থাকে। শব্দ, অগ্নী ও তাপ নিরোধক। পরিবেশ বান্ধব এবং ভুমিকম্প সহনশীল।

 

৮ এপ্রিল ২০২৩

শেয়ার করুন