সেলিমের চেয়ারম্যান পদ এখনো বহাল কেন?

চাঁদপুরে ঘরে বাইরে স্থানীয়দের প্রশ্ন
চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
কোটি টাকার গাড়ি হাঁকিয়ে, চলচ্চিত্র প্রযোজক, নায়কের বাবা, টাকা যার কাছে কাঠাল পাতা, মনে করতেন কোর্ট কাচারি যার সম্পুর্ন অনুকূলে, নো পরোয়া ভাব নিয়ে যিনি চলতেন, কেউ কিছু বল্লেই দেখাতেন ভুয়া হাইকোর্টের রায়! এমনকি এক সময় দুদকও তাকে খালাস দিয়েছে দেখাতেন এমন কাগজ , দেখাতেন এমপি মন্ত্রীর বড়াই, প্রশাসনের উচ্চস্তরের কর্মকর্তাদের ভয়- তিনি এখন জেল খানার চার দেয়ালে। হ্যাঁ, বহুল আলোচিত সমালোচিত সারা দেশে বালু খেকো নামে স্বনামে পরিচিত এবং চাঁদপুরে চোরা সেইল্লা নামে যে অধিক পরিচিত চাঁদপুর সদরের লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম খানকে নিয়ে চাঁদপুরে গত ২ দিন ধরে আলোচনার ঝড় বইছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদকের মামলায় সেলিম খানের জামিন নাকচ হয় গত বুধবার। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া সম্প্রতি তাকে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ে দলিল উচ্চ দামে সৃজন, ভুয়া দলিল এবং পৌনে চার শ কোটি টাকা বেশি হাতিয়ে নেয়ার পায়তারা ও এ নিয়ে আদালতে রীট করার কারনে হাইকোর্ট তার নিজের অর্ধকোটি টাকাসহ তার সাঙ্গ আরো ২ জনের মিলে ১ কোটি টাকা জরিমানা করে। এছাড়া চাঁদপুরের পদ্মা মেঘনা থেকে গত এ দশকেরও বেশি সময় ধরে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ায় বিগত বছরগুলোতে যতো বালু উত্তোলন করেছে সে, তার টাকা হিসাব করে সরকারি কোষাঘারে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত। এছাড়া আর কখনোই সে চাঁদপুরে পদ্মা মেঘনার ৭০ কিলো মিটার তলদেশ থেকে বালু তুলতে পারবে না, এমন নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত। আদালত তাকে চরমভাবে ভৎসনা করে বলেছে, একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে সেলিম খান ঘৃনীত কাজ করেছে। এমনকি এজন্য সে শিক্ষা মন্ত্রনালয়কেও ব্যবহার করেছে, উচ্চ পর্যায়ের জনপ্রতিনিধির সহযোগিতা নিয়েছেন যা কখনোই কাম্য নয়। এছাড়া দুদক কয়েক মাস আগে তার বিদেশ যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। যা এখনো বহাল রয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে তাকে মিডিয়ার কাছে মিথ্যা কথা বলায় চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক অন্জনা খান মজলিশ তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ প্রদান করেন। এতে সে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যায়। এদিকে সেলিম খানের এই অপকর্মের জন্য চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ তাকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির পদসহ দলের সকল পদ থেকে আজীবনের জন্য বহিস্কার করে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, চোখের সামনে এতোসব প্রমানিত অপরাধ করেও সেলিম খান এখনো কিভাবে জনপ্রতিনিধি তথা ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকেন, তা নিয়েও স্থানীয়ভাবে হাজারো প্রশ্ন মানুষের মুখে মুখে। শুধু তাই নয় সে যেই দলের অনুসারী তাদের শিবিরেও অস্বস্তি। যদিও একটি ক্ষুদ্র অংশ কিন্তু উপরের একটা প্রভাব বড়, তারা এই বহিস্কারাদেশকে আমলে নিতে চায়নি। তবে সেলিম জেলে যাওয়ার পর সেখানেও কারো কারো অস্বস্তি বলে জানা গেছে।
মাস কয়েক আগে, চলচ্চিত্রে প্রযোজক সমিতির নির্বাচনেও সেলিম খান জালিয়াতি করেছেন। সেখানে একটি পদে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। সেখানেও সেলিম ধরা খেয়ে যায়। ভোটের মধ্যে দেখা গেলো তার ভোটারদের মধ্যে ভুয়া প্রযোজক প্রচুর । তার গ্রাম এবং ইউনিয়ন এলাকাতেই অর্ধশত প্রযোজক। যারা বেশির ভাগই শ্রমিক এবং কৃষক কিংবা তার সঙ্গীয় টাউট বাটপার। আবদুল কাদির নামে তার দেহরক্ষী ও বাড়ির কেয়ার টেকার সেও প্রযোজকদের একজন!
চাঁদপুর, ঢাকা এবং নারায়নগন্জে চাওর আছে, দুদক সেলিম খানের যে অবৈধ সম্পদের সন্ধ্যান পেয়েছে, তা তার করায়ত্ত সম্পত্তির বহু বহু গুন কম। অনেকে এমনও মন্তব্য করেন হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে বটগাছ বনে যাওয়া সেলিম খানের কাছে ৩৪ কোটি টাকা কয়েক বেলা খাবারের সমান। তার অবৈধ সম্পদ রয়েছে কয়েশ কোটি টাকা। যা হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বিশেষ করে পাশের দেশ ভারতে তার সম্পত্তি রয়েছে, আছে বড় একাধিক হোটেল এবং বাড়ি। আর চাঁদপুরেও রয়েছে নামে বেনামে অনেক বাড়ি। ইদানিং সে অনেক সম্পদ ছেলের নামে, বউয়ের নামে ভাইদেরর এমনকি মেয়ে জামাতাদের নামেও বন্টন করে দিয়েছে। নিরব্ছিন্ন অধিক এবং নিরপেক্ষ তদন্ত ও অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসবে এসব। তাছাড়া তার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী যারা রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে সহায়তা করে এসেছে, তারাও তার কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে টাকা এবং সম্পদ।
এ সম্পর্কে দুদকের একটি সূত্র জানায়, আমরা আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে যেটুকু অবৈধ সম্পদ পেয়েছি, সেটি দিয়েই মামলা করেছি। অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। ঐ সূত্র জানায়, যে কেউ আমাদের তার আরো কোন অবৈধ সম্পদ সম্পর্কে আমাদের জানাক আমরা তার ব্যবস্থা নেবো। হ্যাঁ, আমরাও শুনতে পারছি তার সম্পদ আরে রয়েছে। কিন্তু তা হতে হবে তথ্যভিত্তিক। আর তার জন্য আপনারা যারা জানেন আর উৎসগুলো কোথায়, সম্পদগুলো কোথায় সেসব সম্পর্কে আমরা এগুবো।
দুদক ঐ সূত্র আরো জানায়, সম্প্রতি আদালত তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করেছে এবং ঐ রা এখনো বলবৎ রয়েছে। তার এসবে রিসিভার নিয়োগ দেবে নয়তো আদালতের এখতিয়ার বলে কোন একটা ব্যবস্থা অবশ্যই নেবে বা নিয়েছে বলে ঐ সূত্র জানায়।
এদিকে সেলিম শিবিরে তোর জোর শুরু হয়েছে তাকে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে জামিন নিয়ে ছাড়া জন্য। কিন্তু যতোটুকু অনুমেয় তার জামিন আবেদনের আগে তার রিমান্ডসহ জিজ্ঞাসাবাদ চাঁইতে পারে দুদক। এ ব্যাপারে এই মামলার আইও উপপরিচালক আতাউর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় পরবর্তী পদক্ষেপ। তিনি বলেন, আমাদের যা কিছু তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোনে। প্রমানে। আপনারা যারা আছেন, তার সম্পদ সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য দিতে পারবেন যা আমাদের নজরে আসেনি সেসব সম্পর্কে আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করুন।
এদিকে তার কারাগারে যাওয়া প্রসঙ্গে জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই বলছেন, তার জন্য দলের অনেক বদনাম আমাদের হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্সে। প্রধানমন্ত্রী একটা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এর মধ্যে যদি এরা এসব করে তাহলে কিভাবে আমরা এগুবো? এইসব লোকের কারনে জেলা উপজেলা এমনকি ইউনিয়নের পরীক্ষিত অনেক নেতাই উপেক্ষিত, অনেকে অপমানিত হন। তাদেরও দাবি অবিলম্বে তাকে জনপ্রতিনিধির পদ থেকে সরিয়ে দেয়া। তাকে নিয়ে যে বা যারাই খেলবেন, কাছে টানার ব্যবস্থা করবেন, তারা চাঁদপুরের ক্ষতি করবেন। বরং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
এদিকে জানা গেছে, দুদকের মামলা ছাড়াও অনেক ভুক্তভোগীই সেলিমের বিরুদ্ধে, জমি দখল, জবরদস্তি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, মারামারি, সস্তায় জমি কেনা, মানহানিসহ নানা বিষয়ে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

শেয়ার করুন