অবশেষে চাঁবিপ্রবির ভূমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসক প্রাক্কলিত ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকাই বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়কে ভিসি’র চিঠি

ইব্রাহীম রনি :
অবশেষে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রাক্কলিত ব্যয় হিসেবে ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকাই বরাদ্দের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। ৬ মার্চ রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মো. নাছিম আখতার এ সংক্রান্ত একটি চিঠি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠিয়েছেন।
ভূমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসকের প্রাক্কলিত মূল্যকে চ্যালেঞ্জ করে ৫৫৩ কোটি টাকা মূল্য দাবি করে জমির মালিকদের করা রিটের রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য্য হওয়ার তিন দিনের মাথায় ১৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জমির মালিকদের করা রিটের রায়ের দিন ধার্য্য করা হয়েছে আগামী ২০ এপ্রিল। জেলা প্রশাসকের প্রাক্কলিত জমির মূল্য শেষ পর্যন্ত বহাল থাকলে ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে সরকার।
ভাইস চ্যান্সেলর তার চিঠিতে উল্লেখ করেন, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের বিধান অনুযায়ী সদর উপজেলার ১১৫নং ল²ীপুর মৌজার ভূমি সরেজমিন পরিদর্শন এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন যথোপযুক্ততা যাচাইপূর্বক অর্থ বরাদ্দের নিমিত্তে সম্ভাব্য হালনাগাদ প্রাক্কলন প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলে জেলা প্রশাসক কর্তৃক সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের পর এল এ কেস ১২/২০২০-২০২১ মাধ্যমে ৬২.৫৪৯০ একর জমির সর্বমোট মূল্য ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৭ টাকা প্রাক্কলন প্রদান করেন।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রাক্কলিত অর্থ ১২০ কার্য দিবসের মধ্যে এল এ কেস খাতের নির্দিষ্ট কোড নম্বরে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কর্তৃক অনুরোধ করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উক্ত অর্থ জমা না দেয়া হলে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন অনুযায়ী অধিগ্রহণ কেসটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এ অবস্থায় ভূমি অধিগ্রহণের লক্ষ্যে উক্ত টাকা জরুরী থোক বরাদ্দ দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।
হঠাৎ করে দেয়া এ চিঠির বিষয়ে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মো. নাছিম আখতার বলেন, ভূমি অধিগ্রহণে মূল্য সংক্রান্ত জমির মালিক সেলিম খান গংদের করা রিট মামলার রায় ঘোষণার জন্য ২০ এপ্রিল তারিখ ধার্য্য করা হয়েছে। মামলার রায় কি হবে তাতো জানি না। তবে এজন্যতো আমার কাজ থেমে থাকবে না। তাই ভূমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রাক্কলিত ১৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। আদালতের স্থিতিবস্থা উঠে যাওয়ার কারণে এ চিঠি দিতে পেরেছি। আমি আমার কাজ করেছি- এখন মন্ত্রণালয় টাকা বরাদ্দ দিবে কি না সেটি তাদের বিষয়।
আদালতের রায়ের আগেই এ চিঠি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি এবং মন্ত্রণালয় ওই মামলার কোন পক্ষ না। মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত ভূমি মন্ত্রণালয়, ডিসি এবং সেলিম খান গং। আমার এ চিঠি দেয়াতে আইনগত কোন সমস্যা দেখছি না। আমি আইনজীবীদের সাথে আলাপ করেছি। তিনি আরও বলেন, অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী ১২০ কার্য দিবসের মধ্যে টাকা বরাদ্দের নিয়ম থাকলেও স্থিতিবস্থার কারণে এক-দেড় মাস ছুটে গেছে। এই সময়টুকু বাদ দিলে প্রাক্কলনের মেয়াদ জুন পর্যন্ত গড়াবে।
ভিসি বলেন, আমার চিঠি মন্ত্রণালয় মঞ্জুর করলে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের করা প্রাক্কলিত ১৯৩ কোটি টাকা প্রথমে আমার একাউন্টে দেবে। আমি ওই টাকা জেলা প্রশাসকের একাউন্টে দিবো। এরপর জেলা প্রশাসক তা জমির মালিকদের দিবেন। আর যদি আদালতের রায়ে অন্য কিছু থাকে, তখন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্রাক্কলন দিয়েছি। আমরা মন্ত্রণালয়কে বলেছি, সকল দলিল ধরে মূল্য নির্ধারণ করলে দাম হতো ৫৫৩ কোটি টাকা। আর যে দলিলগুলো উচ্চমূল্যের সেগুলো বাদ দিয়ে প্রাক্কলন করলে দাম আসে ১৯৩ কোটি টাকা। এর বিরুদ্ধেই তারা আদালতে রিট করেছিল। ওই মামলার রায় হবে ২০ এপ্রিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে চিঠি দিয়েছেন সে সম্পর্কে আমার কোন মন্তব্য নেই।
উল্লেখ্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণে ল²ীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনাপাড়ের একটি এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে ৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়- ওই ইউপির চেয়ারম্যান সেলিম খান, তার ছেলে-মেয়েসহ অন্যান্য জমি মালিকরা অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে দলিল তৈরি করেছেন। এর ফলে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ তদন্ত করলে বেরিয়ে আসে সরকারের কয়েকশ’ কোটি টাকা লোপাটের পরিকল্পনা।
ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো জেলা প্রশাসক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ওই মৌজায় জমির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক। ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা যায়, অধিগ্রহণ প্রস্তাবিত ও পূর্বে অধিগ্রহণকৃত দাগগুলোর জমির হস্তান্তর মূল্য চরম অস্বাভাবিক। এছাড়া এটি উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হওয়ায় জনস্বার্থ ও সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে সৃজন করা দলিল ছাড়া ১১৫ নম্বর ল²ীপুর মৌজার অন্যান্য সাফকবলা দলিল বিবেচনায় নিয়ে ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অধিগ্রহণের প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। আর উচ্চমূল্যের সেই দলিলগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করলে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতি হতো। এতে মৌজামূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণ ভূমি হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতো।
৩৫৯ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টার বিষয়টি ফাস হয়ে যাওয়ার পর সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের পক্ষে অবস্থান নেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ একটি অংশ। সর্বত্র শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত এলাকাকে মেঘনার ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে বলে দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় অন্য কোন নিরাপদ স্থানে প্রতিষ্ঠার জন্য অনুরোধ জানান জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্নস্তরের মানুষজন।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply