একদিকে ৪ হাজার কোটি টাকার চাঁদপুর রক্ষা বাঁধ অন্যদিকে মেঘনায় যত্রতত্র বালু উত্তোলন এ দু’টি একত্রে হতে পারে না
জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ
চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
চাঁদপুর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভাটি গতকাল ২০ ফেব্রুয়ারি জুম অ্যাপের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভা প্রধান ছিলেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ। সভায় চাঁদপুরের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়। ওই সভায় প্রায় ৭৪ জন অংশগ্রহণ করেন।
সভায় মেঘনায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে আলোচনায় আসে।
এ বিষয়ে সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, একদিকে ৪ হাজার কোটি টাকার শহর রক্ষা বাঁধ, অপরদিকে মেঘনায় যত্রতত্র অবৈধ বালু উত্তোলন, এ দুটি একত্রে হতে পারে না। তিনি বলেন, ২০১৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মেঘনার বালু উত্তোলনে সরকারের ১ টাকাও লাভ হয়নি বরং ডুবোচর খননের নামে শতাধিক ড্রেজারের মাধ্যমে এলোমেলোভাবে বালু উত্তোলনের কারণে মেঘনার দুই পাড়ে ভাঙনের প্রকোপ দিনদিন বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি হিসেবে আমি স্পষ্ট বলছি- অবৈধ বালু উত্তোলনে নদী ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ভাঙন বৃদ্ধি পাবে, পরিবেশ বিপর্যয় হবে, শহর ভাঙনের হুমকির মুখে পড়বে তা আমরা কখনোই চাই না। ইতোমধ্যেই মৎস্য বিজ্ঞানিরা বলেছেন, নির্বিচারে বালু উত্তোলনের ফলে ইলিশের ডিম এবং তাদের বিচরণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধ এবং নদী ও ইলিশ রক্ষায় যা যা করণীয় তা প্রশাসন করবে। যেসব বিভাগ এর সাথে সংশ্লিষ্ট আছেন তারাও এগিয়ে আসবেন।
তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্বৃতি দিয়ে সভাকে জানান, চাঁদপুরকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষায় স্থায়ী বাধ নির্মাণে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনেক দূর এগিয়ে আছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, মেঘনায় যারা বালু কাটছে নামে-বেনামে তার কয়েকটি কোম্পানির মালিক মোঃ সেলিম খান। এ বিষয়ে তিনি পাউবো চাঁদপুর-এর নির্বাহী প্রকৌশলী এবং বিআইডব্লিউটিএ চাঁদপুর-এর উপপরিচালক এবং নির্বাহী প্রকৌশলীর বক্তব্য জানতে চান৷
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, কাগজে-কলমে মেঘনায় বালু উত্তোলন বন্ধ আছে। কিন্তু আসলে বাস্তবে তা নেই। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ড্রেজিংয়ের নিয়ম রয়েছে, তার কোন প্রক্রিয়াই এখানে প্রয়োগ করা হয়নি। যারা এখানে বালু উত্তোলন করছে তারা নিয়মনীতি না মেনেই শুধুমাত্র ব্যবসার উদ্দেশ্যে বালু উত্তোলন করছে। আমরা ইতোমধ্যেই এভাবে বালু উত্তোলনের সম্পর্কে মতামত দিয়েছি।
জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী তাদের বক্তব্যে বলেন, গুটি কয়েক মানুষের কারণে নদী আমাদের গ্রাস করবে, ভাঙনের শিকার হবে নদীপাড়ের মানুষ। এমনকি ভাঙনের আতংকে থাকবে শহরের মানুষ এটি হতে পারে না। তারা বলেন, চাঁদপুরকে রক্ষায় একদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছেন, আরও করবেন। অন্যদিকে নদীতে বালু সন্ত্রাসের কারণে নদী ভাঙন ঠেকানো যাবে না- এমন অপরাধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানতে পারে না। আমরা বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে যত্রতত্র বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছি। কিন্তু এখনো বালু উত্তোলন বন্ধ করা হয়নি। নানা পন্থায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে একটি চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিএ-র উপপরিচালক বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে বিআইডাব্লিউটিএর মাটি বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়ার সুযোগ নেই। যারা বালু উত্তোলন করবে তারা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করবে। এখানে সেটি হয়নি। কারণ একটি পক্ষের আবেদনে আদালতের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে বিআইডাব্লিউটিএ হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করেছে। তারপর থেকেই সেলিম খান নদী থেকে বালু উত্তোলন করছেন।
তিনি বলেন, নদী ড্রেজিংয়ের নামে থার্ডপাটি যেভাবে বালু উত্তোলন করে সেটি নদীর জন্য ভালো না। জেলা প্রশাসক মহোদয়ের অবজারবেশনের সাথে আমরাও একমত পোষণ করি।
সভায় গুরুত্বের সাথে মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযথ মর্যাদায় পালনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। একইসাথে আলোচনায় আসে, ২৬ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে একযোগে চাঁদপুরে প্রায় লক্ষাধিক স্কুল এবং মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ফাইজারের টিকাদানের বিষয়টিও। এ ব্যাপারে স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তদের সহায়তা কামনা করা হয়েছে। সহায়তা দিতে জনপ্রতিনিধিদেরকেও এগিয়ে আসার আহবান জানানো হয়েছে। পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, বিদ্যুৎ বিলের বকেয়া আদায়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মারাত্মক চাপ রয়েছে। তিনি বলেন, চাঁদপুর পৌরসভার কাছে বকেয়া পাওনার পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাছে পাওনা ২৭ লাখ টাকা। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অ্যানালগ মিটারের পরিবর্তে ডিজিটাল মিটার লাগানো নিয়ে জটিলতার বিষয়টিও তিনি সভায় উত্থাপন করেন। এলজিডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইউনুস হোসেন বিশ্বাস বলেন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সকল কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। কাজের অগ্রগতি প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফাহিম ইকবাল বলেন, আমাদের কোনো মেগা প্রকল্প নেই। তবে ৫ কোটি টাকার উপরে কিছু কাজ আছে, সেগুলো চলমান রয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, তাঁর দপ্তরে বড় দুটি কাজ চলমান আছে। প্রত্যেক উপজেলায় গভীর নলকূপ বরাদ্দের তালিকা স্ব স্ব এলাকার সংসদ সদস্যগণ দ্রুত দিলে তাদের কাজগুলো আরো দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো।
সভায় রমজানের সময় এবং পূর্বে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক বলেন, কঠোর মনিটরিং-এর মাধ্যমে যেকোনো মূল্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হবে। এ ব্যাপারে তিনি চেম্বার অব কমার্সের সহায়তা কামনা করেন।