এবার বিজয় কুমিল্লার মেয়েদের, চাঁদপুরের মেয়েরা তৃতীয় অবস্থানে

বিএফএফ-সমকাল জাতীয় বিজ্ঞান বিতর্ক উৎসব
নিজস্ব প্রতিবেদক :
তেজগাঁওয়ের টাইমস মিডিয়া ভবনের মাল্টিপারপাস হলে শুক্রবার বিকেলের দৃশ্যটা ছিল অন্যরকম। যুক্তির শানিত তীর ছুড়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার তীব্র প্রতিযোগিতায় মেতেছিল বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় দলের মেধাবী বিতার্কিকরা। তবে সেমি ফাইনালে বরিশালের সাথে মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ ব্যবধানে হারায় চাঁদপুরের আলআমিন স্কুল এন্ড কলেজের মেয়েদের ফাইনালে উঠা হাতছাড়া হয়। তবে তারা তারা ৪টি সেরা দলের মধ্যে ছিলো তৃতীয় অবস্থানে। ফাইনাল পর্বে ‘বিজ্ঞানমুখী শিক্ষাই পারে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ গড়তে’ শীর্ষক প্রস্তাবের পক্ষে এবং বিপক্ষে দলগুলোর যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির রসাস্বাদনে মুগ্ধ দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালিতে পুরো মিলনায়তনজুড়ে তখন উচ্ছ্বাসের ঝিলিক। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন সবাই। মঞ্চের সামনে বসা বিশিষ্টজনও বারবার করতালিতে মুখর করে তোলেন অনুষ্ঠানস্থল। নতুন প্রজন্মের মধ্য দিয়েই তারা দেখছিলেন আগামী দিনের যুক্তিনির্ভর, গণতান্ত্রিক, মননশীল ও সৃজনশীল জাতি গড়ে ওঠার প্রচেষ্টা। শেষ দিনের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ বিতর্কের মধ্য দিয়েই পর্দা নামল ‘বিএফএফ-সমকাল জাতীয় বিজ্ঞান বিতর্ক উৎসব-২০২১’-এর চূড়ান্ত আসরের। সমকাল ও বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের (বিএফএফ) উদ্যোগে সমকাল সুহৃদ সমাবেশ এ উৎসবের আয়োজন করে। এবার সারাদেশের ৬৪টি জেলার ৫২০টি স্কুলের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় পরেছেন কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিতার্কিকরা। এ দলের দলনেতা সালফিয়া তানহিয়াত নুজাইমা সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে অর্জন করেছেন শ্রেষ্ঠ বক্তার সম্মান। রানার্সআপ হয়েছে বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় দল। দুই সেমিফাইনালিস্ট হয়েছে বগুড়ার চাঁদপুর আল আমিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং বগুড়ার বিয়াম স্কুল এন্ড কলেজ দল। তারা শুক্রবার অতিথিদের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। সারাদেশের ৯টি অঞ্চলের প্রায় দুই হাজার ছাত্রছাত্রী এবারের এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।
বিশিষ্টজনের কথা :অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এক সময়ের কৃতী বিতার্কিক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি অনলাইনে যুক্ত হয়ে এ বিতর্কে অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থীকে শুভাশিস জানিয়ে বলেন, বিতর্ক মানুষকে সাহসী, আত্মবিশ্বাসী ও যুক্তিবাদী করে তোলে। এর মাধ্যমে শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, ভাষার ব্যবহার ও সুন্দরভারে বক্তব্য উপস্থাপন করার দক্ষতা বাড়ে। বিতর্ক যুক্তিকে শানিত করে। বিতার্কিকের জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে দেয়। একটা বিষয়কে নানা দিক থেকে দেখার সুযোগ করে দেয়, যা পরমতসহিষ্ণুতা শেখায়। আজকে আমাদের সমাজে অসহিষ্ণুতা বেশি। বিতর্ক চিন্তার পথকে বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত করে। এই চর্চা আমাদের দেশে একটি উদার, গণতান্ত্রিক ও মুক্তমনা সমাজ গড়ে তুলবে।
দীপু মনি বলেন, প্রতিটি স্কুলে বিজ্ঞান ক্লাব, বিতর্ক ক্লাব, দাবা ক্লাব থাকা অত্যাবশ্যক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সফল অংশীদার হওয়ার উপযোগী করে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে এগুলো প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমরা চাই বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গড়ে তুলতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বারবার তা-ই বলে গেছেন। তার গঠন করা কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষানীতি, আওয়ামী লীগের গঠনকালীন ইশতেহার, ‘৭০ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার সর্বত্রই শিক্ষার ওপরে জোর দেওয়া হয়েছে। আসলে বিজ্ঞান শিক্ষার কোনো বিকল্পও নেই। তাই ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখনও করে চলেছেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ, সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ। আমাদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও আত্মপরিচয় রয়েছে। আত্মপরিচয় না জানলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না। বিজ্ঞান আমাদের সামনে এগিয়ে দেবে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষাও হতে হবে যথাযথ। নীতি-নৈতিকতা ও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা জরুরি। তিনি বলেন, আমরা সব ধরনের চাপ ও বোঝামুক্ত আনন্দময় শিক্ষা চাই। শিক্ষার্থীরা যেন আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারে। তিনি এ ধরনের আয়োজনের জন্য সমকাল ও বিএফএফকে ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া বলেন, আমাদের ছেলেবেলায় সব স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানো হতো না। কষ্ট করে নদী পাড়ি দিয়ে দূরের স্কুলে গিয়ে বিজ্ঞান পড়েছি। সেখানে কোনো ল্যাবরেটরি ছিল না। হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিখেছি শহরে এসে কলেজ পর্যায়ে। আমরা চাই গ্রামে-গঞ্জে যত স্কুল-কলেজ রয়েছে, সবখানে যেন আমাদের শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিখতে পারে। তিনি বলেন, এই বিতর্কে চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেওয়া সব বিতার্কিকই নারী। কৃষি শিক্ষায় প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী নারী। তারা সর্বত্র এগিয়ে আসছে। তিনি বলেন, বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত আমাদের সঙ্গে আছে, নেই কেবল বিজ্ঞানের চর্চা।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও বিএফএফের ট্রাস্টি ড. রেজাউর রহমান বলেন, ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই। বিজ্ঞান নিরন্তর অনুসন্ধান করে যায়, আবিস্কার করে যায়, কোনো বিতর্কে যায় না। তিনি বলেন, এই আসরে অল্প বয়সী বিতার্কিকরা যে জ্ঞান-গরিমার পরিচয় দিয়েছে তা অভিনন্দনযোগ্য।
সভাপতির বক্তব্যে সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, আমরা বিজ্ঞানমনস্ক, উদার, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই। আর এই প্রজন্মই তা পারবে। তারা বিজ্ঞানকে, পুরো পুথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘোরে। তিনি বলেন, বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ ও জাতি গড়ে তোলার জন্য আট বছর ধরে সমকাল বিজ্ঞান বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিতর্ক প্রতিযোগিতা। আজকের এই আলোকিত ছাত্রীরাই পারবে তাদের স্কুলকে, সমাজকে বদলে দিতে। যা তারা শিখেছে, যা বলেছে, তা যেন তারা বুকের ভেতরে ধারণ করে। আমরা শুধু কয়েকজন বিজ্ঞানী তৈরি করতে চাই না, পুরো সমাজকেই বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলতে চাই।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি প্রফেসর’স কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের সম্পাদক ও কথা প্রকাশের প্রকাশক জসিম উদ্দিন বলেন, বিজ্ঞানমনস্ক হয়েই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে উঠবে এই বিতর্ক ধারার মধ্য দিয়ে। তারা আমাদের দেশ ও জাতিকে সব ধরনের কূপমণ্ডূকতা থেকে মুক্তি দেবে।
বিএফএফের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরী বলেন, করোনাকালে দীর্ঘদিন বাড়িতে আবদ্ধ থাকা শিক্ষার্থীরা এই প্রতিযোগিতাকালে দারুণভাবে উজ্জীবিত হয়েছে। তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, বিদ্যালয় খোলার পরে বহু শিশু এখনও ফিরে আসেনি। তিনি এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সমকালের ফিচার সম্পাদক মাহবুব আজীজ। সঞ্চালনা করেন সহকারী সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম আবেদ। চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেন বিতর্ক আয়োজনের মডারেটর সমকালের সিনিয়র সহসম্পাদক হাসান জাকির। পরে অনুষ্ঠানের বিজয়ী ও রানার্সআপ দলগুলোর মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
পুরস্কার বিতরণী : চ্যাম্পিয়ন দল পেয়েছে চাম্পিয়ন সম্মাননা স্মারক। এ দলের প্রত্যেক বিতার্কিক পেয়েছেন ল্যাপটপ, বই, ক্রেস্ট আর সনদপত্র। রানার্সআপ দলের তার্কিকদের দেওয়া হয় নেটবুক, বই, ক্রেস্ট আর সনদপত্র। দুই সেমিফাইনালিস্ট দলের প্রত্যেকে পেয়েছেন স্মার্টফোন, বই, ক্রেস্ট আর সনদপত্র। বিতর্কের চূড়ান্ত আসরের বিচারক ছিলেন দেবাশিষ রঞ্জন সরকার, মাজেদ আজাদ, নাজমুল হুদা সুমন, নিশাত সুলতানা ও আবদুল্লাহ চৌধুরী মামুন।
পেছনের কথা :’বিতর্ক মানেই যুক্তি, বিজ্ঞানে মুক্তি’ শিরোনামে অষ্টমবারের মতো এ আয়োজন শুরু হয়েছিল গত ১৪ মার্চ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি কাটিয়ে বিজ্ঞানের জয়গান গাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৩ সালে শুরু হয় বিজ্ঞানবিষয়ক এই স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা। সমকালের সারাদেশের হাজারো সুহৃদের সহযোগিতার মাধ্যমে এ বিতর্ক প্রতিযোগিতার সফল বাস্তবায়ন হয়েছে। এ উৎসবের বিশেষ সহযোগী ছিল প্রফেসর’স কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স। এ উৎসব নিয়ে দুই পাতার বিশেষ আয়োজন মঙ্গলবার প্রকাশিত হবে সুহৃদ সমাবেশ বিভাগে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply