কারাগারে ‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান সেলিম খান

চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় চাঁদপুরের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান, শাপলা মিডিয়ার কর্ণধার বিতর্কিত সেলিম খানের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. আছাদুজ্জামান বুধবার এ আদেশ দেন। দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর সেলিম খান আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত শুনানি শেষে বুধবার তদন্ত প্রতিবেদনসহ জামিন শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেন বিচারক। দুপুরে সেলিম খান আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে জামিনের পক্ষে তার আইনজীবী শাহিনূর ইসলাম আদালতে বক্তব্য তুলে ধরেন।
অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান জামিনের বিরোধিতা করে বক্তব্য তুলে ধরেন। শুনানি শেষে আসামি সেলিম খানের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
গত ১ আগস্ট সেলিম খানের বিরুদ্ধে ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান বাদী হয়ে সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ মামলাটি দায়ের করেন। ওই মামলায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট সেলিম খানকে চার সপ্তাহের আগাম জামিন দেন। এ সময়ের মধ্যে তাকে ঢাকার বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়।
এদিকে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে দুদক। শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ২০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আদেশ স্থগিত করেন। একই সঙ্গে আসামি সেলিম খানকে ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আদালতে আত্মসমর্পণ করার আদেশ দেন।
দুদক জানায়, প্রাথমিক অনুসন্ধানে সেলিম খানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সম্পদ বিবরণী চায় দুদক। সেলিম খান ৬৬ লাখ টাকার সম্পদের হিসাব জমা দেন। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে তার ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ ৮১ হাজার ১১৯ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। অনুসন্ধান কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কমিশন সভায় সেলিম খানের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, সেলিম খান অবৈধ উপায়ে ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ ৮১ হাজার ১১৯ টাকার সম্পদ তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতি পূর্ণভাবে নিজ ভোগদখলে রেখেছেন। এছাড়া তিনি ৬৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪৭৭ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। সেলিম খান যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেছেন, তা যাচাই-বাছাই করে অসঙ্গতি পাওয়া গেছে।
ল²ীপুর মডেল ইউনিয়নের ল²ীপুর মৌজায় সেলিম খানের ১৯ দশমিক ৮৯ একর জমি, ঢাকার কাকরাইলে আজমিন নামে একটি পাঁচতলা ভবন, কাকরাইলে ৭১৫ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভুঁইগড় এলাকায় ১০ তলা বাড়িসহ মোট ২৬ কোটি ৪২ লাখ ৩২ হাজার ২১ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ রয়েছে। এছাড়া, তার ছয়টি ড্রেজার, তিনটি প্রাইভেটকার, জিপ, একটি পিস্তল, একটি শটগান, আসবাবপত্র, পাঁচ ভরি স্বর্ণালংকার, একটি মোটরসাইকেল, ইলেকট্রনিক সরঞ্জামাদি, নয়টি সিনেমা নির্মাণ ও আমদানিতে বিনিয়োগ, ৫৮টি সিনেমা নির্মাণে অনুমতির নিবন্ধন ফি জমা, ব্যাংক হিসাবে জমা ও হাতে নগদসহ আরও ১১ কোটি ১৯ লাখ ৩৫ হাজার ৩৬৪ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
এজাহারে আরো বলা হয়, স্থাবর ও অস্থাবর মিলে সেলিম খানের ৩৭ কোটি ৬১ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮৫ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। পারিবারিক ও অন্যান্য বাবদ রয়েছে এক কোটি ছয় লাখ ৩৮ হাজার ৩১০ টাকা। এসব সম্পদের বিপরীতে গ্রহণযোগ্য চার কোটি ১৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৭৬ টাকা আয়ের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলেও বাকি ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ ৮১ হাজার ১১৯ টাকার সম্পদ জ্ঞাত আয় বহির্ভূত।
প্রসঙ্গত, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ল²ীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনা পাড়ে একটি এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরে ৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়, চেয়ারম্যান সেলিম খান, তার ছেলেমেয়েসহ অন্যান্য জমির মালিকরা অস্বাভাবিক মূল্যে দলিল তৈরি করেছেন। ফলে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে জেলা প্রশাসক তদন্ত করলে বেরিয়ে আসে সরকারের কয়েকশ কোটি টাকা লোপাটের পরিকল্পনার তথ্য।
ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে তৎকালীণ জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ উল্লেখ করেন, ওই মৌজায় জমির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন জেলা প্রশাসক। ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা যায়, অধিগ্রহণ প্রস্তাবিত ও পূর্বে অধিগ্রহণ করা দাগগুলোর জমির হস্তান্তর মূল্য অস্বাভাবিক।
এ ছাড়া এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় জনস্বার্থ ও সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে সৃজন করা দলিল ছাড়া ১১৫ নম্বর ল²ীপুর মৌজার অন্যান্য সাফ কবলা দলিল বিবেচনায় নিয়ে ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অধিগ্রহণের প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। উচ্চমূল্যের সেই দলিলগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করলে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতি হতো। এ ছাড়া মৌজা মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণ ভূমি হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে সমস্যায় পড়তো।
বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের পক্ষে তথা চাঁদপুরের সম্পদ রক্ষায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু নঈম পাটওয়ারী দুলালসহ মূল জেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা কর্মি ও সাধারন মানুষ । এ বিষয়ে চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানিয়েছিলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্রাক্কলন দিয়েছি। মন্ত্রণালয়কে বলেছি, সব দলিল ধরে মূল্য নির্ধারণ করলে দাম হতো ৫৫৩ কোটি টাকা। আর যে দলিলগুলো উচ্চমূল্যের সেগুলো বাদ দিয়ে প্রাক্কলন করলে দাম আসে ১৯৩ কোটি টাকা। এর বিরুদ্ধে সেলিম খান ও অন্যরা আদালতে রিট করেন।
কিন্তু সরকারি বিপুল অঙ্কের টাকা রক্ষায় রাষ্ট্রপক্ষের শক্ত অবস্থানে অবস্থা বেগতিক দেখে পূর্ব নির্ধারিত রায়ের দিন নিজের করা রিট প্রত্যাহারের আবেদন করেন তিনি। এ ঘটনায় বিজ্ঞ আদালত সেলিম খান ও তার সহযোগীদের রিট খারিজ করেন এবং আদালতের সময় নষ্ট করায় সেলিম খান ও তার দুই সহযোগীকে কোটি টাকা জরিমানা করা হয় এবং তার রিট খারিজ করা হয়। এর মধ্যে সেলিম চেয়ারম্যানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তার অপর দুই সহযোগী রিটকারী আবদুল কাদের ও জুয়েলকে ২৫ লাখ করে মোট ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। গত ৯ জুন বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এদিকে বাড়তি দামে জমি বিক্রির চেষ্টার অভিযোগের পর সেলিম খানের অবৈধ উপায়ে বালু উত্তোলনের বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। চাঁদপুরের নদী অঞ্চলে শত শত ড্রেজার বসিয়ে গত কয়েক বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে সেলিম খান বালু উত্তোলন করে আসছিলেন। দীর্ঘদিন বালু ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে নদীভাঙনসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইলিশ সম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য। পরে গত ১৯ ফেব্রæয়ারি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিআইডবিøউটিএ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামত ও চিঠির আলোকে সরকারি সম্পদ ও ইলিশ রক্ষায় ভূমি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ।
ওই চিঠির পর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে ভূমি মন্ত্রণালয়ও। এরই মধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ ও চেয়ারম্যান সেলিম খানকে গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন নদীপাড়ের ভাঙনকবলিত মানুষ। তবুও বালু উত্তোলনের জন্য উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। যা স¤প্রতি প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ খারিজ করে দেয়। এর ফলে চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয় তার অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন।
এদিকে গত ৬ এপ্রিল সেলিম খানের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ যাচাইয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুমিল্লার সহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সা’দাতের নেতৃত্বে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণের সুযোগে ৩৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা ও পদ্মা-মেঘনা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক।
এদিকে, গতকাল সেলিম খানকে গ্রেফতারের খবর পেয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে চাঁদপুর ও ল²ীপুর ইউনিয়নের মানুষজন সস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।

শেয়ার করুন