‘ক্ষুধার জ্বালায় সন্তানকে মেরেছি’ শিশুকে ফিরে পেতে চান সেই মা
শাহরাস্তি প্রতিনিধি :
চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে শিশুসন্তানকে মায়ের মারধর করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। শিশুটিকে উদ্ধার করে আদালতের নির্দেশে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রামের ছোটমণি নিবাসে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) জনি কান্তি দে।
অভিযুক্ত মা পারভীন আক্তার বলছেন, ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে নিজের দুই বছর বয়সী সন্তান ফাহাদকে মারধর করেছিলেন তিনি। গতকাল জামিনে ছাড়া পেয়েছেন তিনি। আজ শুক্রবার দুপুরে বাড়িতে আসেন। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, পরিস্থিতির শিকার হয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন।
গতকাল দুপুর আড়াইটায় গণমাধ্যমকর্মীরা পারভীন আক্তারের বাড়ি উপজেলার চিতোষী পশ্চিম ইউনিয়নের হাঁড়িয়া গ্রামের দুলাল মেম্বারের বাড়িতে গেলে দেখেন, তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামছেন। সাংবাদিকদের দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। শিশুপুত্রকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানান পারভীন।
ছেলেকে কেন নির্যাতন করেছেন জানতে চাইলে পারভীন বলেন, শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আদালত নির্দেশিত মাসিক ৮ হাজার টাকা দিয়ে চলতেন তিনি। অনেক দিন ধরে খরচের টাকা না পেয়ে স্বামীকে ফোন দেন। ওপাশ থেকে স্বামী রেগে গিয়ে মা-ছেলেকে মরে যেতে বলেন!
পারভীন বলেন, ‘বিয়ের পর থেকে আমার স্বামীর বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক। এমনকি আপন বড় ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে আমি বেশ কয়েকবার অশ্লীল অবস্থায় তাকে দেখতে পাই। আমি ওই সব ঘটনার প্রতিবাদ করলে সে ও তার পরিবারের লোকজন আমাকে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে নির্যাতন করত। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার আমার এলাকার চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সালিস বৈঠকও হয়েছে। তাতে কোনো লাভ হয়নি। বরং আমাকে একবার খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে এবং তিনবার মারধর করে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। ওই সব ঘটনার প্রমাণ হিসেবে আমার কাছে ছবি, অডিও এবং ভিডিও আছে। আমি তাদের নির্যাতন সহ্য করে শুধু শিশুপুত্রটির মুখের দিক তাকিয়ে বারবার সংসার করতে চেয়েছি। সংসারের প্রয়োজনে স্বামী প্রবাসে যাওয়ার সময় বাপের বাড়ি থেকে ২ লাখ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। এত কিছুর পরও তারা আমাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। প্রতিনিয়ত আমাকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।’
পারভীন আরও বলেন, ‘ঈদে তাদের বাড়িতে গেলে তারা আমাকে দেখে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি খাবারের জন্য একমুঠো ভাত চেয়ে পাইনি। অনেকবার বলেও আমার ছেলেকে একটি রুটি দেয়নি তারা। বাবার বাড়িতে আমি একা থাকি। সেখানে দিনের পর দিন খরচের টাকা না পেয়ে অনাহারে ছিলাম। আমার কষ্ট দেখে পাশের ঘরের চাচা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দু’দফা চাল এনে দিয়েছেন। ক্ষুধার যন্ত্রণা কত ভয়াবহ আমি সেটি প্রতিদিন উপলব্ধি করেছি। আমি ওই সব যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে রাগের বশে আমার সন্তানকে মারধর করে ওই ভিডিও আমার স্বামীর কাছে পাঠাই। আমি ধারণা করেছি, সে ওই ভিডিও দেখে পরিবর্তন হবে। অথচ উল্টো নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে ভিডিওটি বিভিন্ন জনের মাধ্যমে ছড়িয়ে আমাকে সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে দোষী বানিয়েছে। অথচ তাদের নির্যাতনে আমার গর্ভের আট মাসের একটি কন্যা সন্তান মারা গেছে। আমি তাদের সঠিক বিচার দাবি করছি।’
পারভীনের ভাই মো. শাহ পরান বলেন, ‘বিয়ের পর থেকে আমার বোনটি ওই পরিবারের নির্যাতন ছাড়া কিছুই পায়নি। আমরা আমাদের সাধ্য মতো সহযোগিতা করেও নির্যাতনের হাত থেকে বোনকে রক্ষা করতে পারিনি। আমার বোন সংসার করতে চেয়েছে। তাই তাদের শত নির্যাতনের পরও সংসার ছেড়ে আসার কথা চিন্তা করেনি। অথচ আজকে তাদের অমানুষিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে শিশু বাচ্চাটিকে মারধরের ভিডিওকে কেন্দ্র করে আমার বোনকে তারা নিঃশেষ করে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। আমরা ঘটনার সঠিক তদন্ত পূর্বক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে বিচার দাবি করছি।’
পারভীনের চাচা সাবেক ইউপি সদস্য মো. দুলাল হোসেন বলেন, ‘শ্বশুরবাড়ির অমানুষিক নির্যাতন ও অনাহারে থেকে মেয়েটি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। পুলিশ বাচ্চাটিকে উদ্ধার না করলে হয়তো সে বাচ্চাটিকে মেরে নিজে আত্মহত্যা করত।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চিতোষী পশ্চিম ইউপি চেয়ারম্যান জোবায়েদ কবির বাহাদুর বলেন, ‘পারভীন বিয়ের পর থেকে স্বামীর পরিবারের কাছে বারবার নির্যাতিত হয়েছে। আমি কয়েকবার তাদের সালিস বৈঠকে গিয়েছি। ওই পরিবারের অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় মেয়েটি তার শিশুপুত্রকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানে অর্ধাহারে-অনাহারে রয়েছে শুনে আমি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দু’দফা চালের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’
উল্লেখ্য, তিন বছর আগে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার চিতোষী পশ্চিম ইউনিয়নের হাড়িয়া গ্রামের নূরুল আমিনের মেয়ে পারভীন আক্তারের (২৩) বিয়ে হয় কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার আশিয়াদারি গ্রামের আবদুল করিমের ছেলে প্রবাসী মহিনউদ্দিনের সঙ্গে। তাঁদের সংসারে ফাহাদ (২) নামের একটি শিশুসন্তান রয়েছে। বিয়ের এক বছর পর থেকে তাঁদের দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। এ নিয়ে পারভীন আক্তার বাবার বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। চাঁদপুর লিগ্যাল এইড কার্যালয়ের সিদ্ধান্তমতে ভরণপোষণ বাবদ প্রতি মাসে স্বামীর ৮ হাজার টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
প্রবাসী স্বামী মহিনউদ্দিন ওই টাকা নিয়মিত না দেওয়ায় স¤প্রতি পারভীন তাঁর দুই বছরের শিশুসন্তানকে নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে স্বামীকে পাঠান। শিশুটির বাবা ওই ভিডিও দেখে সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মনোহরগঞ্জ এলাকার বিভিন্নজনকে অনুরোধ করেন। এরই মধ্যে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে শিশুটিকে আদালতে হাজির করা হলে শিশু আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদাউস চৌধুরী শিশুটিকে পরিচর্যা ও ভরণ-পোষণের জন্য চট্টগ্রামের রৌফাবাদ ছোটমণি নিবাসে পাঠানোর নির্দেশ দেন।