গুনগতশিক্ষা অর্জনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সম্পর্ক
প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন :
বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে এবং সব মিলিয়ে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তাদের মধ্য থেকেই শিক্ষকগণ তৈরি করবেন বিজ্ঞানী, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, দেশপ্রেমিক, রাজনীতিবিদ, দক্ষ প্রশাসক, উদ্যোক্তা, খেলোয়াড়, সমাজকর্মী, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক ইত্যাদি। তারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে এবং বিশ্বকল্যাণে কাজ করবে।
শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকের সম্পর্ক যত ভাল হবে, বন্ধুত্বপূর্ণ হবে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে তত ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। শিক্ষার্থীর কাছে তার শিক্ষক সর্বোচ্চ সম্মানিয় আসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি। আবার শিক্ষকের কাছে তার শিক্ষার্থীরা সন্তানের মতো প্রিয়। নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি ও শ্রম দিয়ে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলেন এবং নিজেকে সেই শিক্ষার্থীর আলোকিত জীবনের গর্বিত অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা জীবন এমনকি ব্যক্তি জীবনেও তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতায় শিক্ষককে স্মরণ করে। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক হলো সাফল্য-ব্যর্থতা, গ্লানি কিংবা গবের্র সমান অংশীদারিত্বের সম্পর্ক। শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসে শিক্ষার্থীরা জীবনকে জানতে, চিনতে ও বুঝতে শেখে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে যায় জ্ঞানের পথে, আলোর পথে বিচার বুদ্ধি দিয়ে কাজ করার জন্য। শিক্ষক যে দর্শন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন তার ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনের ব্রত ঠিক করে। একজন ভাল শিক্ষক বখে যাওয়া শিক্ষার্থীকেও সঠিক পথে নিয়ে আসতে পারেন এবং তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন।
ছাত্র ও শিক্ষকের সর্ম্পক হলো একটি সুন্দর ও পবিত্র সর্ম্পক। এই সম্পর্ক খুবই সাবলীল, মধুর, স্বতঃস্ফুর্ত আবার গাম্ভীর্যপূর্ণ। শিক্ষক প্রয়োজনে শিক্ষার্থীর ওপর অবিভাবকসূলভ কঠোরতা ও শাসন আরোপ করেন। আবার কখনো বা বন্ধুর মতো ভালবাসেন, পরামর্শ দেন, উৎসাহ যোগান, সব সময়ই পাশে থাকেন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে অবিভাবকের মতো সম্মান করে, তাঁদের আদেশ-উপদেশ মেনে চলে ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক পথ প্রদর্শক আর পথিকের সম্পর্কের মতো। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে পথ দেখান, ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনা দেন। শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীর মধ্যে অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার এবং চেনা-জানা বিষয়গুলোকেও নতুন করে চেনার আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেন, উৎসাহ, প্রেরণা ও শক্তি যোগান। ভাল মন্দ, ভুল-সঠিকের দৃষ্টিভঙ্গি শেখান। সর্বোপরি শিক্ষকের কাছে প্রত্যাশা হলো তিনি তার শিক্ষার্থীদের ভালমানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন। উদারতা, মায়া- মমতা, স্নেহ ও ভালবাসা আর শাসনের মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের ভেতরে স্বপ্নের বীজ বপন করেন। শিক্ষার্থীরা সেই স্বপ্নকে লালন করে। তাই ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বপ্ন স্রষ্টারও মতো।
একজন শিক্ষক তখনই সফল হন যখন তিনি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষিত করতে পারেন। আর শিক্ষার্থীরা তখনই সফল হয় যখন শিক্ষকের নির্দেশিত শিক্ষাকে আত্মস্থ করতে পারে। আর এ জন্য প্রয়োজন ছাত্র শিক্ষক সুসম্পর্ক। তাই এই সম্পর্ক উন্নয়নে যা করতে হবে তা হলো- শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে অবশ্যই পরস্পরের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলোকে যথাযথভাবে পালন করতে হবে; পরস্পরের কাছে যে প্রত্যাশাগুলো রয়েছে সেগুলো পুরণ করতে হবে; কোনো পরিস্থিতিতেই কেউ কারো প্রতি অসাদাচরণ করবে না; শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এবং শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রতি সর্বদা সন্তোষ্ট থাকবেন। শিক্ষকতা যে মহান পেশা তা কাজের মাধ্যমে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন।
শিক্ষক জ্ঞানদাতা, তাই বলে তিনি কেবল দিয়েই যাবেন তা নয়। বরং শিক্ষার্থীর কাছে তারাও কিছু প্রত্যাশা করেন। শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকের সব চেয়ে বড় প্রত্যাশা হলো শিক্ষার্থীরা তার দেয়া শিক্ষায় প্রকৃত অর্থেই শিক্ষিত হবে। তাকে সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে, তাকে উপযুক্ত মর্যাদা দিবে। শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীর শুভাকাঙ্ক্ষী। তেমনি শিক্ষক প্রত্যাশা করেন তার ছাত্ররাও তাকে ভালবাসবে এবং তার প্রতি অনুগত থাকবে। একজন আদর্শ শিক্ষক হবেন ছাত্রদের পথপ্রদর্শক। শিক্ষক শিক্ষার্থীর বন্ধু হবেন তা ঠিক কিন্তু শিক্ষার্থীরা যা খুশি তা করবে বিষয়টি এমন নয়। ছাত্ররা তাদের মনের কথা খুলে বলতে পারবে এবং শিক্ষক তা শুনে বন্ধুর মত সুপরামর্শ দেবেন। শিক্ষককে ছাত্র সন্মান না করলে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে পারবে না। শিক্ষকের প্রিয় ছাত্র প্রকৃত জ্ঞানের আলো পায়। একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে যখন শিক্ষকের সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে তখন শিক্ষক হয়ে উঠেন বিশ্বস্ততার জায়গা। শিক্ষার্থীদের ক্লাসের বাইরে কথা বলার সময় দিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের প্রধান কাজ হলো পাঠ্যবই পড়া। অবসর সময়ে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি যার যার ধর্মীয় গ্রন্থ, শিক্ষামূলক গল্প, মনীষীদের জীবনী, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ইতিহাস ইত্যাদি পড়ে জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা। নিজ দেশ সম্পর্কে জানার জন্য বিভিন্ন লেখকের বই পড়া, মা-বাবা, ভাই-বোনের সাহায্য নিয়ে যে বিষয়টি ক্লাসে বুঝতে অসুবিধা তা শিখে নেয়া, বাড়ির বুকশেলফে উপযোগী কোনো বই থাকলে সেগুলো পড়ে ফেলা, ওয়েবসাইটে থাকা উপযোগী পাঠসমগ্রী প্রয়োজনে ডাউনলোড করে নেয়া, একটা রুটিন তৈরি করা যেখানে- খাওয়া-দাওয়া, পড়ালেখা, প্রার্থনা, পিতামাতাকে সাহায্য করা, পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবদের সচেতন করা, সেখানে শরীরচর্চা, খেলাধুলা ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজের সময়-বিভাজন থাকবে। ছুটির দিনে শিক্ষার্থীদের বড় কাজ হলো পিতামাতাকে বাড়ির কাজে সহযোগিতা করা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বেশি বেশি করে কৃষিকাজে পিতাকে সাহায্য করতে পারে। এতে পরিবার উপকৃত হয় এবং নিজেরাও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। ফলে পিতা-মাতা ও কৃষক, জেলে, শ্রমিক, মজুর, কামার, কুমার সকল শ্রেণির মানুষের প্রতি দরদ তৈরি হয়। বর্তমানে প্রতিটি পরিবারেই কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন অপরিহার্য উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রন থাকা আবশ্যক। খেয়াল রাখতে হবে, এগুলোর প্রতি যেন শিক্ষার্থীদের আসক্তি তৈরি না হয়। টিভি দেখা, গান শোনা ও মুভি দেখার ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় মুভি দেখতে নির্দেশনা দিতে হবে।
সূর্যের আলো যেমন পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে পৃথিবীর রূপ-বৈচিত্র্য আমাদের সামনে দৃশ্যমান করে। তেমনি, শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদেরকে জ্ঞান দানের মাধ্যমে তাদের মন ও জীবনকে আলোকিত করে। জন্মের পর একটি শিশুর শিক্ষা গ্রহণের প্রথম পাঠ শুরু হয় তার পরিবারে। অতপর তার শিক্ষাদানের মহান দায়িত্ব অর্পিত হয় শিক্ষকের ওপর। এই শিক্ষা দান ও গ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্পর্কের এক অটুট বন্ধন। যে সম্পর্কের সামনে শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় মাথা নত করি আমরা সবাই। আগের দিনে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক ছিল অকৃত্রিম। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষককে শ্রদ্ধা করত দেবতার মতো। শিক্ষকের এক একটি আদেশ-উপদেশকে তারা বেদবাক্য বলে মনে করত। শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদেরকে ভালবাসত আপন সন্তানের মতো। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের নির্দেশনা অলঙ্গনীয় মনে করে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করতো। শিক্ষকদের সেবা করাও তাদের শিক্ষার অংশ ছিল। শিক্ষকরাও তার শিক্ষার্থীকে সঠিক শিক্ষা দিতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতেন। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের নজির স্থাপনকারী বাদশা আলমগীরের কথাও আমরা জানি।
একটা সময় ছিল যখন ছাত্ররা নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুয়ে-মুছে দিত। আজ সেই হাতে তারা শিক্ষককে লাঞ্ছিত করছে। আবার শিক্ষক যে হাত আশীর্বাদে, উৎসাহে, শুভকামনায় ছাত্রের মাথায় রাখত, সেই হাতে কোমলমতি শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষত করছে। শিক্ষার্থীরা এখন শিক্ষককে ব্যবহার করতে চায় অসদুপায়ে ভাল ফল লাভের আশায়। অন্যদিকে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদেরকে ব্যবহার করে অর্থ লাভের হাতিয়ার হিসেবে। আগে যেখানে শিক্ষকতা মহান পেশা ছিল এখন তা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে এখন স্বার্থের সম্পর্ক বিদ্যমান। সব ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক এমন নয়, এখনও সৎ শিক্ষক ও ভাল ছাত্র আছে। তবে তাদের পরিমাণ দিন দিন কমছে। শিক্ষকই জ্ঞানশূন্য মানবশিশুকে ভিন্ন চোখে বিশ্বকে দেখতে শেখায় এবং প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তাই শিশুদের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক অত্যন্ত, সম্মানজনক, বন্ধুত্বপূর্ণ ও আনন্দদায়ক হওয়া আবশ্যক।
বিশ ত্রিশ বা পঞ্চাশ বছর আগেও শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিল গুরু শিষ্যের। শিষ্য যে ভক্তি নিয়ে গুরুকে সমীহ করতেন, গুরুরাও সেই মর্যাদাকে ধরে রাখতে নিজেদের সেই উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য পড়াশোনা করতেন ও আদর্শবান হতেন। শিক্ষকদের মর্যাদার জায়গাটা আগের তুলনায় অনেকটাই হারিয়ে গেছে তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো- মানুষের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। শিক্ষক এবং ছাত্রের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা কমে গেছে। শিক্ষা এখন আর জ্ঞান আহরণের বিষয় নেই। শিক্ষা হয়ে গেছে ভালো চাকরি পাওয়ার সিঁড়ি। বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে বলেই একই শিক্ষকের ক্লাস করে এসে তার কাছে প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যাচ্ছে না। একই স্কুলে প্রতিটি শিক্ষার্থীর নিকট থেকে প্রতি বছর জোর করে সেশন ফি বা ভর্তি ফি নেয়া হচ্ছে ইত্যাদি।
আমাদের স্কুলগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যে খুব একটা সম্মানজনক অবস্থায় নেই সেটা সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনাতেই বোঝা যায়। নুসরাত হত্যার সঙ্গে জড়িত সোনাগাজীর মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত এপ্রিলে রাজধানীর ডেমরার ডগাইর এলাকার নূরে মদিনা মাদ্রাসার ছাত্র আট বছরের মনির হোসেনের হত্যার সঙ্গে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ দুই শিক্ষার্থী জড়িত বলে প্রমানিত। প্রধান শিক্ষক আফজাল হোসেন পরীক্ষার হলে সবার সামনে এক ছাত্রের চুল কেটে দেন। অপমান সহ্য করতে না পেরে ছাত্রটি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। প্রশ্নের আঙুল ওঠে শিক্ষকসমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি। কিন্তু কোথাও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মানবিক সম্পর্কের বিষয়টির কথা উঠে আসেনি। এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে, যদি শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সম্পর্কের উন্নতি না হয়।
প্রাচীনকালে জ্ঞান আহরণই ছিল শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদেরকে জ্ঞান দান করতেন। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যও ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকের প্রধান কাজ হলো জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আদর্শ নাগরিক হিসাবে তৈরি করা এবং শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সুষ্ঠু সম্পর্ক গড়ে তোলা। শিক্ষা এখন সনদমুখী। চাকরি পাওয়া ছাড়া এখন শিক্ষার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে শিক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষা পদ্ধতি বদলাতে হবে। ত্রৈমাসিক, ষাম্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষার বদলে সাপ্তাহিক ক্লাস টেস্টের মতো সৃজনশীল পরীক্ষা নিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থা বদলে দেওয়ায় জাপানে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার মাত্রা কমে এসেছে। শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াতেও এখন সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে।
শিক্ষাদান কার্যক্রমকে সফল করে তোলার জন্য এবং শিক্ষার্থীদের চাহিদা মিটিয়ে তাদের প্রতিভাকে সুষ্ঠু পথে পরিচালিত করার জন্য শিক্ষককে ছাত্রত্ব গ্রহণের বৈশিষ্ট্যটিরও চর্চা করতে হবে। শিক্ষক কেবল নিজ সাবজেক্টে বিশেষজ্ঞ হলেই চলবে না, তাকে পাঠদান প্রানবন্ত করতে হলে অন্যান্য সাবজেক্ট সম্পর্কেও জানতে হবে। জ্ঞানের বিভিন্নমুখী ধারার সাথে শিক্ষকের পরিচয় থাকলে তিনি সফলভাবে শ্রেণী পাঠদান সম্পন্ন করতে পারবেন। শিক্ষার্থীরা সব সময় শিক্ষককে সর্বপ্রকার জ্ঞানের অধিকারী হিসাবে বিবেচনা করে তাকে। তাই সব ব্যাপার শিক্ষকের কাছ থেকে জানার আগ্রহ তাদের প্রবল। শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে শিক্ষক সম্পর্কে তাদের বিরূপ ধারণা তৈরি হয়। সমসাময়িক পরিবর্তনশীল বিশ্বের নানা খবর শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির মাধ্যমে অবগত হচ্ছে। তাদের অনুসন্ধিৎসা ক্রমাগত বাড়ছে। কাজেই পরিবর্তনশীল বিশ্বের নানা খবরাখবর তাকে রাখতে হবে এবং এগুলোর উপযুক্ত ব্যাখ্যা তাকে জানতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষককে অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী হতে হবে।
ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক দুনিয়ার সেরা সম্পর্কগুলোর একটি। আগের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আর বর্তমান সময়ের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে ব্যবধান অনেক। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, ব্রতও বটে। অন্য সব পেশা থেকে এ পেশাটা একটু ভিন্ন ধরনের। কেননা এখানে উপদেশদাতা বা নির্দেশনাদানকারী যদি নিজেই বিশ্বস্ততার মধ্যে না থাকেন অথাৎ শিক্ষক যা উপদেশ দেন তা যদি তিনি নিজে পালন না করেন বা নির্ভুল না পড়ান তাহলে তার পাঠদান কার্যকর হয় না। শিক্ষকরাই পারেন বিশ্বমানের অর্জিত শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে শিক্ষার্থীকে সঠিক দীক্ষায় দীক্ষা দিতে। তাই ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক হওয়া উচিত অভিভাবকতুল্য ও বন্ধুসুলভ। শিক্ষক হবেন ছাত্রের গর্ব আর ছাত্র হবে শিক্ষকের অহংকার।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সম্পর্ক নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর সেমিনারের বা কর্মশালা আয়োজন করলে ভালো ফল বয়ে আনে। শিক্ষকের ভালোবাসা, স্নেহের সংস্পর্শে খারাপ বা কম মনোযোগী শিক্ষার্থীও ভালো হয়ে যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা একজন শিক্ষককে সম্মান ও আগ্রহভরে ভক্তি করে মনেপ্রাণে স্থান দিয়ে থাকে তখনই যখন শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে বন্ধুর মত। শিক্ষক বন্ধু হলেও মনে রাখতে হবে মা বাবার মত শিক্ষকের সম্মান যেন অক্ষুন্ন থাকে। শ্রেণিতে নানা কৌশল অবলম্বন করে শিক্ষার্থীদের মন্তব্য ও প্রশ্ন করাকে প্রসংশা করতে হবে। শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে খুব আনন্দিত ও উৎফুল্ল থাকতে হবে, শিক্ষার্থীরা যেন বুঝতে পারে শিক্ষাদানে শিক্ষার্থীদের সংস্পর্শে এসে তিনি খুবই আনন্দিত ও উৎফুল্ল বোধ করছেন; শিক্ষার্থীদের চোখে চোখ রাখতে হবে এতে শিক্ষকের সততা এবং সমান দৃষ্টি রাখা প্রকাশ পায়। পাঠ্য বইয়ের অনুশীলন শিক্ষক শিক্ষার্থীরা মিলে করলে এটিও ভাল সম্পর্ক স্থাপনে চমৎকার ভূমিকা রাখে। শিক্ষার্থীদেরকে জীবনধর্মী ও বাস্তবমূখী দক্ষতা শেখানোর ওপর জোর দেয়া উচিত। শিক্ষার আলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকের একসঙ্গে কাজ করা উচিত।
অনেক প্রতিষ্ঠানেই কিছু শিক্ষক থাকেন যারা অধিকার নিয়ে শিক্ষার্থীকে অনেক উপদেশ দেন, শাসন করেন। সেই অধিকার অবশ্য কিছু কিছু শিক্ষক অর্জন করে ফেলেন, সবাই তা অর্জন করতে পারেন না। তাই তারা শিক্ষার্থীদের কোনো কটু কথা বললেও শিক্ষার্থীরা তা মেনে নেয়। কিন্তু যারা সেই অধিকার অর্জন করতে পারেননি তারা সামান্য কিছু বললেই এই যুগের শিক্ষার্থীরা ক্ষেপে যায়, প্রতিবাদ করে এমনকি আইনের আশ্রয় নেয়। শিক্ষার্থীদের ওপর নিয়মকানুন ফলানো বা তাদের কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে রাখা যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর বর্তায়। কিন্তু ছাত্র রাজনীতি ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে ছাত্রদের কেউ কেউ হয়তো একটু অন্য রকম পোশাক পরিধান করে, ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলে চুল রাখে। সেটি হয়তো কোনো কোনো শিক্ষকের চোখে লাগে। আমাদের চিন্তা করতে হবে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক কোন অবস্থায় আছে? এমনকি চুল পরিপাটি রাখার মতো উপদেশ দেওয়ার অবস্থায় আছে কি না বা উপদেশ দিলেই শিক্ষার্থীরা শুনবে কি না সেটি শিক্ষককেই বুঝতে হবে।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় ছয় শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষক। তিনি নাকি শিক্ষার্থীদের ক্লাস থেকে ডেকে এনে চুল কেটে দিয়েছেন। এক শিক্ষার্থীর মা মামলা করায় ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার জামিন না মঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিলেই তাকে কারাগারে যেতে হবে, এ কেমন কথা ! একজন শিক্ষক কিছু শিক্ষার্থীর লম্বা চুল কেটে এত বড় অন্যায় করে ফেললেন আর রাষ্ট্রীয় তরফে এত দ্রুত সব ব্যবস্থা হয়ে গেলো! অনেক ক্ষেত্রে আরো বড় ধরনের অনিয়মেরও কোনো ব্যবস্থাই তো নেওয়া হয় না। একজন নিরীহ শিক্ষক কয়েকজন শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন যেজন্য তাকে জামিন পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না। শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় এ কেমন আচরণ? নিশ্চিয়ই ঐ শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীদের পারিবারিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্ধ ছিল না। তাহলে কেন ঐ শিক্ষককে জেলে যেতে হলো এসবই ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্কের অবনতির পরিনাম ফলাফল।
শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অবহেলা, অযত্ন ও অবজ্ঞার ফলে এই পেশা ক্রমেই মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। পত্রিকায় দেখলাম একজন বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি একজন শিক্ষককে ঘুষি মেরে তার কয়েকটি দাঁত ফেলে দিয়েছেন। যেন শিক্ষকের দাঁতের কোনো মূল্যই নেই। শিক্ষকের দাঁতের চেয়ে শিক্ষার্থীর চুলের দাম অনেক বেশি? এর পাশে আরো একটি ঘটনা দেখলাম একজন শিক্ষককে একজন শিক্ষা অফিসার লাথি-ঘুষি মেরে আহত করে ফেলেছেন এবং চাকরি থেকে বরখাস্তও করেছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্ক এবং শিক্ষক ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক এ অবস্থায় চললে শিক্ষার ভবিষ্যৎ, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে ?
শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্কে ছিড় ধরেছে কারন আমাদের বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতিটি মোটেই স্বচ্ছ নয়। মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে শিক্ষকরা স্কুল-কলেজে চাকরি নিয়ে থাকেন। ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ায় তার নিজেরও নীতি বলে কিছু থাকে না। ফলে সেই শিক্ষক ক্লাসে ছাত্রদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে নৈতিকভাবে ভালো কোনো শিক্ষা দেয়া অধিকার অধিকার রাখেন না। শিক্ষক নিয়োগ যাতে বিশেষভাবে গঠিত শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে হয় এবং শিক্ষকদের মানোন্নয়নের বিষয়টি যাতে ওই বিশেষ কমিশনের কাছে থাকে সেই বিষয়টি ভাবতে হবে। তাছাড়া স্কুল বা কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত বা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ফলে তারা শিক্ষকদের উপর কতৃত্ব করেন। অনেক সময় নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও একাডেমিক বিষয়ে নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটান সংবাদপত্রে এ ধরনের সংবাদ প্রায়শই দেখা যায়। এতে করে সেই শিক্ষক স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীসহ সবার কাছে সম্মান হারান।
বর্তমানে শিক্ষকদের উন্নয়ন ও শিক্ষার উন্নয়ন যে আদলে চলছে তাতে পুরো শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের খুব ভালো কিছু দিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। শিক্ষকদের মানোন্নয়নের নিমিত্ত যে সকল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানেও মানসম্মত প্রশিক্ষক ও তাঁদের পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে। শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা বা মনিটরিং নিশ্চিতকরণে যথাযথ কোন উদ্যোগ না নিলে অচিরেই শিক্ষার গুনগতমান বৃদ্ধির পরিবর্তে অবনয়ন হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি ফোর অথাৎ গুনগত শিক্ষা অর্জন কেবলই প্রচারনায় সীমাবদ্ধ থাকবে। একটি প্রবাদ আছে একটি দেশকে ধ্বংস করতে হলে আধুনিক মারনাস্ত্রের প্রয়োজন নেই কেবলমাত্র শিক্ষার ব্যবস্থায় অনিয়ম করে দিলেই অযোগ্য সব শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, প্রশাসক, ব্যবসায়ী তৈরি হবে দেশ এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে। একজন ভাল শিক্ষক একজন ছাত্র ও তার অভিভাবক এমনকি সামাজিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আনতে পারেন। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত ও দৃঢ় হওয়া আবশ্যক। স্মেহ ভালবাসা আর শ্রদ্ধা-সম্মানে যে সম্পর্ক রচিত হয় সেই সম্পর্ক যেন সর্বদাই অটুট থাকে। ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকের পবিত্র সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখা রাষ্ট্রিয়ভাবে সকলের জন্যই মঙ্গলজনক।
লেখক: প্রাক্তন মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা ।