চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনায় বালুসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলছে, জব্দ হচ্ছে ড্রেজার-বাল্কহেড

নিজস্ব প্রতিবেদক :
ইলিশের আবাসস্থল নিরাপদ রাখতে, সরকারি সম্পদ রক্ষায় চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনায় অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন। নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২৪ মার্চ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় অভিযান শুরু হয়। এ অভিযানে অংশ নিয়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, নৌপুলিশ, কোস্টগার্ডসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তা ও সদস্যরা। প্রথম দিনের অভিযানে এ পর্যন্ত ৩টি ড্রেজার ও ৮টি বালু পরিবহণকারী বাল্কহেড জব্দ করার খবর পাওয়া গেছে।

সকালে অভিযান শুরু আগে এসি ল্যান্ড মুহাম্মদ হেলাল চৌধুরীসহ নৌপুলিশ, কোস্টগার্ডসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

মতলবে নদী ঘুরে দেখা গেছে, বেশ কিছু বাল্কহেড বালু ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও নদী তীরে নোঙর করে রাখা হয়েছে বিপুল সংখ্যক বাল্কহেড। অভিযানের খবর পেয়ে বেশিরভাগ ড্রেজার উধাও হয়ে গেছে।
নৌপুলিশের এসআই জহিরুল ইসলাম জানান, এ পর্যন্ত ড্রেজার ৩টি এবং বাল্কহেড ৮টি জব্দ করা হয়েছে। এসব নৌযান থেকে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।

আটক নৌযানের কয়েকজন স্টাফ

নৌপুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের এসপি মো. কামরুজ্জামান জানান, সকাল ৮টা থেকে অভিযান শুরু হয়েছে। যেসব ড্রেজার ও বাল্কহেডের রেজিস্ট্রেশন নেই সেগুলো জব্দ করা হচ্ছে। অভিযান এখনো চলমান রয়েছে।


চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ ও সদর উপজেলার এসি ল্যান্ড মুহাম্মদ হেলাল চৌধুরী বলেন, এখনো অভিযান শেষ হয়নি। যেসব অবৈধ নৌযান জব্দ করা হবে সেগুলো নৌপুলিশকে বুঝিয়ে দেয়া হবে। নৌপুলিশকে আমরা চিঠি দিয়েছি। তারা এ অভিযান অব্যাহত রাখতে পারবে।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সাল থেকে চাঁদপুর জেলার নদী অঞ্চল থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানসহ একটি চক্রের বিরুদ্ধে। বালু উত্তোলনের কারণে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও নদী ভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশ সম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।


নদীভাঙন ঠেকাতে বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর ও স্থানীয়রা বিরোধিতা করলেও বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে প্রভাবশালী ওই চক্রটি। এ অবস্থায় চাঁদপুরের নদী থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে ভাঙন কবলিত মানুষ, জেলে ও জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ ফেব্রæয়ারি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিআইডবিøউটিএ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামত ও চিঠির আলোকে সরকারি সম্পদ ও ইলিশ রক্ষায় ভূমি মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ। ওই চিঠির পর গতকাল সোমবার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অধিদফতর, বিআইডবিøউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনে সম্পৃক্ত অবৈধ নৌযান জব্দ ও চোরাই বালু বিপনন কার্যক্রমের সাথে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা দেয়া হয়।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, বালু ব্যবসায় যারা সম্পৃক্ত তাদের তিন শতাধিক নৌযান রয়েছে। সেগুলো জব্দ করার জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছি। তাদের লাইসেন্স আছে কিনা সেগুলো পরীক্ষা করতে হবে। তারা অবৈধভাবে বালু তুলছে। কারণ, মাটি এবং বালু উত্তোলন বিধি অনুযায়ী তা উত্তোলন করতে হবে। সেটি তারা করছে না। তাই আইন অনুযায়ী তাদের গ্রেফতারের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিআইডবিøউটিএ অ্যাকশন নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এখানে যেহেতু পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে তাই অধিদফতরকে আদালত চালু করার নির্দেশ দিয়েছি।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভাতেও বালু উত্তোলনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। সভায় জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিআইডব্লিউটিএর তথ্যমতে চাঁদপুরের নদী থেকে যে প্রক্রিয়ায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তা সঠিক হচ্ছে না। এতে নদীর ক্ষতি হচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্যেরও ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া আমাদের দিক থেকে বলা হয়েছে, এই প্রক্রিয়ায় বালু উত্তোলনের ফলে সরকার কোনও রাজস্ব পাচ্ছে না। সেলিম খান নামে এক ব্যক্তি আদালতে মামলা করে ২০১৫ সাল থেকে বালু উত্তোলন করছেন। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম রেফাত জামিল বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে বালু উত্তোলন করছে, তা তারা বৈজ্ঞানিকভাবে তুলছেন না। তারা চাহিদাভিত্তিক বালু তুলছেন। যেখানে পাওয়া যাচ্ছে সেখান থেকেই তারা বালু তুলছেন। নদীর গতিপথ আছে। এই গতিপথের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কোথায় পানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং সেসব জায়গায় যদি ডুবোচর থাকে এবং কতটুকু গভীরতায় যেতে হবে, সেটি একটি স্তরের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু যারা বালু উত্তোলন করছেন তারা সেটি মানছেন না। তারা যেভাবে বালু উত্তোলন করছেন তা নদীর জন্য ক্ষতিকর এবং ভাঙনের জন্য দায়ী।’

এ বিষয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসককে একটি চিঠি দেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হারুনুর রশিদ। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘চাঁদপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদীতে ড্রেজারের মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এই নদী থেকে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান ডুবোচর খননের নামে সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে এই কাজটি করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন। ফলে ইলিশের বৃহত্তম বিচরণ ক্ষেত্র ও অভয়াশ্রম (ষাটনল থেকে চর আলেকজান্ডার) নষ্টসহ জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, মেঘনা নদীতে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের ফলে প্রধান প্রজনন মৌসুমে চাঁদপুর অংশে ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ সম্প্রতি মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।’

চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে শত শত ড্রেজারের আঘাতে, নির্গত পোড়া মবিল ও তেলের কারণে মাছের প্রধান প্রাকৃতিক খাদ্য নদীর প্লাংটন আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এছাড়া বালু উত্তোলনে নদী দূষণসহ নদী গর্ভের গঠন প্রক্রিয়া বদলে যাওয়ার ফলে বাসস্থানের বাস্তুতন্ত্রও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের এই ধরনের পরিবর্তনের ফলে তাদের আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি ইলিশসহ অন্যান্য মাছের খাদ্যের উৎস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাছের বিচরণ ও প্রজনন বদলে যাওয়াসহ ইলিশের উৎপাদন মেঘনা নদীতে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ইলিশ রক্ষা এবং আবাসস্থল নিরাপদ করতে প্রধান প্রজনন ও বিচরণ মৌসুমে মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধসহ ড্রেজারগুলো স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply