চেয়ারম্যান সেলিমের অনিয়ম-দুর্নীতি সম্পর্কে অনুসন্ধান অব্যাহত
* চাঁবিপ্রবির ভূমি অধিগ্রহণে জালিয়াতি করেছেন সেলিম খান
* পদ্মা-মেঘনা থেকে অনুমতি ছাড়াই নির্বিচারে বালু উত্তোলন করেছেন
* যারাই এসবের সাথে জড়িত তাদের নাম অটোমেটিক্যালি চলে আসবে : দুদক সচিব মাহবুব হোসেন
চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণের সুযোগে ৩৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা ও বহু বছর ধরে পদ্মা-মেঘনা নদীতে শত শত ড্রেজার বসিয়ে নির্বিচারে বালু উত্তোলন করে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিশাল অনিয়ম-দুর্নীতি অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পরও আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। তথ্য সংগ্রহ শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বৃহস্পতিবার (২১ এপ্রিল) বিকেলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মাহবুব হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০নং লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিষয়ে প্রাপ্ত অভিযোগ এবং তথ্যের প্রেক্ষিতে চলতি মাসের প্রথম দিকে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম পাঠানো হয়েছিল। বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে আমরা প্রাথমিকভাবে যেনেছি, জেলা প্রশাসন যখন ওই জমির মূল্য নির্ধারণ করেন তখন বিষয়টি ধরা পড়ে- লক্ষ্মীপুর ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জমির বেশি মূল্য দেখিয়ে প্রায় ১৩৯টি দলিল করেছেন। এতে জমির বিক্রি-ক্রয় দেখিয়েছেন যাতে মৌজামূল্য বাড়িয়ে ২০ গুণ দেখানো হয় এবং ওই প্রাক্কলনে যাতে বর্ধিত মূল্যটি আসে তার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন বিষয়টি বুঝতে পারায় পরবর্তীতে তিনি আর এটি নিয়ে অগ্রসর হতে পারেননি। কিন্তু দলিল এবং তার প্রসেস তিনি নিয়েছিলেন। তিনি যদি সফল হতেন তাহলে সরকারের ৩৬০ কোটি টাকা গচ্ছা যেত। এ বিষয়ে প্রথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। এ কাজে তিনি সফল না হলেও এটি একটি জালিয়াতি।
দুদক সচিব বলেন, চাঁদপুর পদ্মা-মেঘনা থেকে অনুমতি ছাড়াই নির্বিচারে বালু উত্তোলন করেন। কারণ, বালু মহল ইজারার একটি বিষয় আছে। এখানে যদি সেরকম কোন কিছু না থাকে তাহলে তিনি কিভাবে বালু উত্তোলন করছেন, কত দিন ধরে তুলছেন- এ বিষয়গুলো আমাদের এনফোর্সমেন্ট টিম সেখানে গিয়েছিল। তারা জেলা প্রশাসন, জেলা রেজিস্টারের কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছ থেকে আরও তথ্য নিবেন। এরপর যে বিষয়গুলো উঠে আসবে সেগুলো সম্পর্কে আইন মোতাবেক সামনের দিকে অগ্রসর হবো।
তিনি আরও বলেন, আপাতত জমি অধিগ্রহণের সুযোগে দলিল বেচাকেনা করে মূল্য বৃদ্ধি এবং বালু উত্তোলনের বিষয়ে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম তথ্য পেয়েছে। এ সম্পর্কে আরও যখন অনুসন্ধান হবে তখন এর সাথে আরও কারা জড়িত বা কি কি বিষয় সম্পৃক্ত আছে সেগুলো জানা যাবে। যারাই এসবের সাথে জড়িত তাদের নাম অটোমেটিক্যালি চলে আসবে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ শেষ হলে সেটি কমিশন বরাবর উপস্থাপন করা হবে। এরপর আইন যে বিষয়টি পারমিট করে সেটি করা হবে।
প্রসঙ্গত, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনা পাড়ে একটি এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরে ৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে দেখা যায় চেয়ারম্যান সেলিম খান, তার ছেলে-মেয়েসহ অন্যান্য জমির মালিকরা অস্বাভাবিক মূল্যে দলিল তৈরি করেছেন। ফলে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে জেলা প্রশাসক তদন্ত করলে বেরিয়ে আসে সরকারের কয়েকশ কোটি টাকা লোপাটের পরিকল্পনার তথ্য।
ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে জেলা প্রশাসক উল্লেখ করেন, ওই মৌজায় জমির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক। ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা যায়, অধিগ্রহণ প্রস্তাবিত ও পূর্বে অধিগ্রহণকৃত দাগগুলোর জমির হস্তান্তর মূল্য অস্বাভাবিক।
এছাড়া এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় জনস্বার্থ ও সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে সৃজন করা দলিল ছাড়া ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর মৌজার অন্যান্য সাফ কবলা দলিল বিবেচনায় নিয়ে ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অধিগ্রহণের প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। উচ্চমূল্যের সেই দলিলগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করলে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতি হতো। এছাড়া মৌজা মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণ ভূমি হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে সমস্যায় পড়তো।
এদিকে, সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের পক্ষে অবস্থান নেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ একটি অংশ। সরকারি অর্থ লোপাট চেষ্টার পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার পর শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। এরই মধ্যে চাঁদপুর ভূমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য উপস্থাপন করায় চেয়ারম্যান সেলিম খানকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় জেলা প্রশাসন।
অপরদিকে, গত কয়েক বছর ধরে চাঁদপুরের নদী অঞ্চল থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে চেয়ারম্যান সেলিম খানসহ একটি চক্রের বিরুদ্ধে। এমনকি অনুমতি ছাড়াই চেয়ারম্যান বছরের পর বছর বালু বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। দীর্ঘদিন বালু ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি।
বালু উত্তোলনের কারণে শত কোটি টাকা ব্যয় করেও নদীভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশ সম্পদসহ জীববৈচিত্র্য। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
এদিকে গত ৬ এপ্রিল দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পত্তি অর্জন বিষয়ে চাঁদপুরের লক্ষ্মীপুরের ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ যাচাইয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুমিল্লার সহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সা’দাৎ-এর নেতৃত্বে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে। দুদকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দুদকের টিম চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মৌজায় চাঁদপুর-হাইমচর সড়কের পাশে মেঘনা নদী থেকে ৮০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত জমি সরেজমিন পরিদর্শন করে। এছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, বিআইডব্লিউটিএ ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে অভিযোগ সম্পর্কিত রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে। সংগৃহীত রেকর্ডপত্রে চাঁদপুর জেলার পদ্মা-মেঘনা নদী অংশে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে প্রকৃতি-পরিবেশ বিনষ্টসহ রাজস্ব ক্ষতি এবং প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণে সরকারের বিরাট অঙ্কের অর্থ লুটপাটের দুরভিসন্ধি সম্পর্কিত অভিযোগের সত্যতা পায়। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কমিশনে বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
দুদক সূত্র জানায়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণে কৌশলে জমির মূল্য প্রায় ২০ গুণ বেশি দেখিয়ে সরকারের প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি, মেঘনা নদীতে নির্বিচারে বালু উত্তোলন করে পরিবেশের ক্ষতি এবং সরকারের বিপুল রাজস্ব ক্ষতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে সেলিম খানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য রাফী মো. নাজমুস সা’দাৎ-এর নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানের সময় সেলিম খানের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির সত্যতা পায় দুদক টিম।