বাইরে মুক্তির কল্লোল ও বন্দী একটি পরিবার

-মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান :
আজ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ৯১তম এর জন্মদিন। ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’- এ কথাটির জ¦লন্ত প্রমাণ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’তে রূপদান করেছেন ছায়ার মত পাশে থেকে। তাঁর পারিবারিক জীবনের ত্যাগ বঙ্গবন্ধুকে নির্ভার হয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি বিপদে, আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সাহস যুগিয়েছেন। তাঁকে পরিবারের কোন ব্যক্তিগত বা আর্থিক টানাপোড়েনের বিষয় বঙ্গবন্ধুর কাছে তুলে ধরার ইতিহাস দেখা যায় না। নিজে বরং বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুকে টাকা পাঠিয়েছেন। জেলখানায় গিয়ে দেখা করেছেন। কখনো বলতে দেখা যায়নি যে, তিনি বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে সংসারমুখী হতে বলেছেন। বরং পরম ভালবাসায় বঙ্গবন্ধুকে সিক্ত করেছেন। পরিবারটিকে তিনি আগলে রেখেছেন যেমন মা পাখি তার বাচ্চাদের আগলে রাখে।
বঙ্গমাতাকে জানা মানে বাংলাদেশের ইতিহাসকে জানা। ইতিহাসের তিনি এক জীবন্ত সাক্ষী। তাই বারবার তিনি পত্রিকায় ওঠে এসেছেন। দেশবাসীকে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় জানাতে সাহায্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কেমন করে কাটিয়েছেনÑ একাধিক সাক্ষাৎকারে তা উঠে এসেছে। এমনি একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয় ১৯৭৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের দৈনিক বাংলায়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয়া হাসিনা আশরাফ। এটি মূলতঃ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের দিন নিয়ে। নতুন প্রজন্মের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
‘ডিসেম্বরকে আমি স্মরণ করবো, জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত। ১৬ই ডিসেম্বর আমাকে দিয়েছে এক অনন্য উপলব্ধি। এই দিনটির মাঝেই আমি পেয়েছিলাম নতুন জীবনের প্রতিশ্রæতি’Ñবললেন শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব।
১৬ই ডিসেম্বরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকেন বেগম মুজিব। দু’বছরের ব্যাবধানেও তাঁর কাছে অস্পষ্ট হয়ে যায়নি ১৬ই ডিসেম্বরের অনন্য মুহুর্তগুলো। প্রতি বছর উত্তরের হিমেল হাওয়ার সাথে ডিসেম্বর যেনো ফিরে আসে অতীত স্মৃতি নিয়ে। নিজের অজান্তেই তিনি ফিরে যান ধানমন্ডির ১৮ নং রোডের সেই একতলা বাড়ীটিতে। বন্দী জীবনের সেই বাসাটিতে মুক্ত সুর্যের আলো যেনো বাধা পেতো। এক চিলতে ছাঁয়াও পড়তো না তাঁর ঘরটিতে।
১৯৭১ সালের গণসংগ্রামে দীপ্ত দিনগুলোকে স্মরণ করতে বেগম মুজিবের ভালো লাগে। আকাশে জঙ্গী বিমানের প্রচন্ড শব্দ শুনলে এখনো তিনি বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। দু’বছর আগেও এমনি করে জঙ্গী বিমানের আনাগোনায় আচমকা তিনি বেরিয়ে আসতেন ঘর থেকে বাইরে। অশরীরী ছায়ার মত অনুসরণ করতো তাঁকে বেয়নেটধারী প্রহরী। নিঃশব্দে তখন ফিরে যেতেন ঘরে। এ সময় জঙ্গী বিমানের শব্দে বেশী ঘাবড়াতো ছোট্ট রাসেল। বিমানের শব্দ পেলেই চিৎকার করে সে ছুটে যেতো তার ছোট্ট ভাগ্নেটার (জয়) দিকে। পকেট থেকে তুলা বের করে জয়ের কানে গুঁজে দিতো। তারপর ছোট্ট ভাগ্নেটাকে বুকে চেপে ধরে তার মায়ের পাশেই বসে থাকতো শীর্ণ মুখে। এক বার । দুই বার। তিন বার। যতবার বিমান আসতো, ঠিক ততবারই রাসেল দৌড় দিতো জয়ের কাছে। একইভাবে কানে তুলা গুঁজে দিতো তার অবুঝ ভাগ্নেটাকে।
দু’বছর কেটে গেছে। মনে পড়ে সেই স্মৃতি। বন্দী জীবনের কালো দিনগুলো ভুলতে পারেন নি বেগম মুজিব। মনে পড়ে সেই মানসিক নির্যাতনের কথা। মনে পড়ে সেই দুঃসহ মুহুর্তগুলো। শুধুমাত্র বুকের বল সম্বল করে কাটিয়ে দিতে হয়েছিল মাসের পর মাস। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়াও পরিবারের সবার মনে সাহস যোগাতে হতো তাঁকে। আগস্ট মাসে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বন্দী জীবনের চৌহদ্দি পেরিয়ে পালিয়ে গেল। সন্তানের চিন্তায় ¯েœহাক‚ল মায়ের মনের ভেতরটা জ¦লে যেত। কিন্তু বাইরে তিনি নির্বিকার ভাব দেখাতেন। ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটি ধামাচাপা দেবার জন্য প্রহরীদের কাছেই তিনি দাবী করতেনÑ ‘আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও’। অনেক কামনার ধন প্রথম নাতীর জন্ম মুহুর্তেও বেগম মুজিব যেতে পারেন নি কন্যার শয্যাপার্শে। কিন্তু পরিবেশকে অনুধাবন করে নিজেকে সংযত রেখেছিলেন তিনি। গোপনে খবর পাঠিয়েছিলেণ ননদের কাছে। আর নিজে বেছে নিয়েছিলেন জায়নামাজ।
‘জানেন, সেই দুঃসহ স্মৃতি বাইরের আলোতে মেলে ধরতে ভালো লাগে না আমার। কেননা অনুভ‚তি কখনও পুরোপুরি বুঝানো যায় না। কি করে সে ব্যথা প্রকাশ করবো?
বিগত কয়েক মাস আমি অসুস্থ ছিলাম। দেশী-বিদেশী চিকিৎসকরা দেখেছেন। ঔষধ খেয়েছি। এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নই। ছেলেমেয়েরা বলে, সেই সময়কার মানসিক চাপ ও ক্লেশের জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়েছি ধীরে ধীরে। অসুখ সহ্য করার ক্ষমতা কবে হারিয়ে গেছে।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেনÑ ‘নতুন বলার কিছুই নেই। একদিকে তখন স্বপ্ন দেখেছি মুক্ত স্বাধীন বাংলার আর অন্যদিকে ভেবেছি পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী আমার স্বামীর উপর নির্যাতনের কথা। ভেবেছি পরিবারের ভবিষ্যতের কথা। জীবন আর মৃত্যুর সেই টানাপোড়েনের মুহুর্তগুলোকে ব্যাখ্যা করার ভাষা আমার নেই।’
১৬ই ডিসেম্বরের কথা বলতে গিয়ে কেমন যেনো অন্যমনস্ক দেখালো বেগম মুজিবকে। একটু থেমে বললেনÑ‘সারাজীবন মনে থাকবে এই দিনটি। ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই বাইরের জগতের সাথে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক কেটে দিয়েছিল পাকিস্তানীরা। আমরা ছিলাম চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী। তবুও মুক্তি সংগ্রামের সব খবরই আমি পেতাম। ধন্যবাদ আমার ট্রানজিস্টরকে। ১৫ই ডিসেম্বর রাতেই জানতে পেরেছিলাম পাকিস্তানী সেনাদের ভরাডুবির কথা। তাহলে আমরা স্বাধীন হচ্ছি! মুক্তি তরঙ্গের দোলা লেগেছে ছোট্ট পরিবারটিতে। কেমন যেনো ঝকমক করছে সবার চোখমুখ। নিজেকেও আর সম্বরণ করতে পারছিলাম না।
১৬ই ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে একটি মিলিটারী জীপ এসে আমার বাসার দু’জন সিকিউরিটি অফিসারকে তুলে নিয়ে গেল। বাসায় থেকে গেল নি¤œ পর্যায়ের হাবিলদারসহ পাহারারত সেপাইরা। বেলা বাড়তে লাগলো। ততক্ষণে শোনা যাচ্ছে জয়বাংলা ধ্বনি। পাঞ্জাবী প্রহরীরা অস্থির হয়ে উঠেছিল। বুঝলাম হয়তোবা আমাদের জন্য মৃত্যু আসন্ন। ছোট্ট রাসেল আর পাঁচ মাসের নাতীটির দিকে তাকিয়ে কষ্ট হচ্ছিল। ওদের দু’জনকে সারাদিন লুকিয়ে রাখলাম বাথরুমের অন্ধকার কোণে। একপাশের ছোট্ট ঘরের মধ্যেই আমরা সকলে লুকালাম। বাইরের কলগুঞ্জন ক্রমেই বাড়ছে। আর শোনা যাচ্ছে জয়বাংলা ধ্বনি। হঠাৎ ছাদের ওপর থেকে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ হল। বেপরোয়াভাবে ছাদের উপর থেকে ক্ষিপ্ত সৈনিকরা গুলি চালাতে লাগলো পথচারীদের ওপর। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমার বাসাটিকে ঘিরে তখন এক বিশৃংখল অবস্থা। শান্তভাবে তাই ডাক দিলাম হাবিলদার রিয়াজকে। বুঝিয়ে বললাম যে, তাদের সেনানায়ক নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেছেন। তারা যেনো অযথা নিরীহ লোকদের হত্যা না করে। আমার কথা শুনে রক্তচক্ষু মেলে ধমক দিয়ে উঠলো সে। বলল, নিয়াজীকে সে চেনে না। নিজে সে আত্মসমর্পণ করেনি। কাজেই বাজে কথা যেনো কেউ না বলে।
দু’বছর আগের স্মৃতি। এক মিশ্রিত অনুভ‚তি নিয়ে ফিরে আসে দিনটি। সমস্ত রাত গোলাগুলির আওয়াজ। এক মিনিটের জন্যও থামে নি। ঘরের ভিতর সবাই আমরা প্রহর গুণছি। দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে ভারী বুটের আওয়াজ। রাত তখন প্রায় নয়টা। ঘরের ভিতরের বাচ্চাদের জামা-কাপড় শুকাতে দেবার তারটা হঠাৎ নড়ে উঠলো। এক লাফে উঠে দাঁড়ালেন বেগম মুজিব। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাবিলদার রিয়াজ। লাল রক্তের মত জ¦লন্ত চোখে সে তাকালো। বললোÑ খোকাকে (শেখ সাহেবের ভাই) পাঠিয়ে দিন। কথা আছে। সহসে ভর করে বেগম মুজিব এগিয়ে গেলেন। বললেনÑ ওরা ঘুমিয়ে আছে। যা কিছু বলতে চাও আমাকেই বলতে পারো। উত্তর শুনে হিং¯্র দৃষ্টিতে ঘরের দিকে চেয়ে ফিরে গেল রিয়াজ। রাত যেনো কাটতে চায় না। স্বাধীনতার স্পর্শে রঙিন বাংলা মেতে উঠেছে উৎসবের আমেজে। আর এদিকে বন্দী পরিবারটিতে রাত জাগছেন এক ¯েœহময়ী মা। মৃত্যু যার শিয়রে করাঘাত করছে।


১৬ই ডিসেম্বরের সেই কালো রাতের পর দুটো বছর কেটে গেছে। বেগম মুজিব আজও স্মরণ করে শিউড়ে ওঠেন মৃত্যুনীল সেই রাতটিকে। বর্ণনা করতে গেলে এখন স্মিতহাস্যে শুধু বলেনÑ অনুভ‚তি ঠিক প্রকাশ করা যায় না—।

শেয়ার করুন

Leave a Reply