সাহিত্যপ্রেমীর সংখ্যা কমছে কেন?

ইলা ইয়াসমীন ::
সমাজের কিছু সমস্যাকে উপেক্ষা করা যায়, যেমন ধরুন কোনো দম্পতির দাম্পত্য কলহ বাঁধল, কিংবা কারো ব্যবসায় মন্দা হলো। এগুলো ব্যক্তিগত সমস্যা, এসবের প্রভাব পুরো জাতির উপর পড়ে না। পুরো জাতিকে অচলায়তনে আটকে পড়তে হয় না। কিন্তু কিছু সমস্যা থাকে একেবারে মৌলিক। যেগুলো পুরো জাতির জীবনপ্রবাহে বিপর্যয় ডেকে আনে। জান-মালের অনিরাপত্তা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক সংঘাত, অর্থনৈতিক শোষণ ইত্যাদি হচ্ছে এই কিসিমের সমস্যা।
এই সঙ্কটগুলো যখন সামনে আসে তখন জনজীবন আর স্বাভাবিক থাকে না। এর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত অন্যদিকে মনোযোগ ঘোরানো যায় না। একজন অনাহারী মানুষকে কি আপনি কোল্ড ড্রিংকস কিনে খাওয়াবেন? কখনই না। আগে খাওয়াবেন ভাত, মাছ, গোস্ত। কোল্ড ড্রিংকস তার প্রয়োজন নেই। ওটা তার কাছে বিলাসিতা। কিংবা ছিনতাইকারীর হাতে সর্বস্ব খোয়ানো ব্যক্তিটিকে আপনার পছন্দের সেরা রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাবেন? তাও না। আপনি তার হারিয়ে যাওয়া টাকা-পয়সা উদ্ধারের চেষ্টা করবেন। ওটা গান শোনার সময় নয়।
আমাদের সমাজের বেলাতেও এই সত্যটি খাটে। মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের প্রত্যেকেরই জান-মাল ঝুঁকিপূর্ণ, প্রত্যেকেই আমরা ক্ষতির শিকার হতে থাকব কোনো না কোনোভাবে। কাজেই এর সমাধান সবার আগে দরকার, তারপর অন্য ছোটখাটো সমস্যা। আর চিত্তবিনোদন তো আরও অনেক পরের বিষয়। এই গুরুত্বের অগ্রাধিকার না বোঝার কারণে বর্তমানে মুশকিলে পড়েছেন আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা, লেখকরা।
দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। আগে একটা চিঠি লিখতে পাড়াগাঁয়ের মেট্রিক পড়ুয়া ছেলেটির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হত। এখন ঘরে ঘরে লেখুয়া পড়ুয়া ছেলে মেয়ে বেড়ে উঠছে। তবু কেন আমাদের সাহিত্য দিনদিন পাঠকপ্রিয়তা হারাচ্ছে সেটাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমার মনে হয় এই অবস্থার কারণ সাহিত্যিকরা সমাজের মৌলিক সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করে যাচ্ছেন। পেছনে যে অনাহারী ব্যক্তির কথা বলে এসেছি আমাদের সমাজের অবস্থা এখন কিন্তু তেমনই। বড়ই সঙ্গীন মুহূর্ত। অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, অনিরাপত্তা, রক্তপাত, বিদ্বেষ, হানাহানির সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে সমাজ। তার দরকার একটু সত্য, একটু ন্যায়ের উৎসাহ, একটু চিন্তার খোরাক। প্রাণ বাঁচিয়ে তীরে পৌঁছবার মত একটুখানি পথনির্দেশ। কিন্তু না, আমাদের অধিকাংশ সাহিত্যিকরা মৃতপ্রায় সমাজকে কোল্ড ড্রিংকস খাওয়াতেই ব্যস্ত। তারা সমস্যার গভীরতা বুঝতে অক্ষম হচ্ছেন। এর ফলস্বরূপ মানুষ সাহিত্যকে বিলাসিতার সামগ্রি ভাবতে শুরু করেছে। পেটে ভাত নাই, প্রেমের কবিতা কে পড়ে? দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারে খোদার আরশ কেঁপে যাচ্ছে, কোন বোকা এমন সময় জোছনামাধুর্য উপভোগ করবে? একটা বুলেটের যে দাম মানুষের প্রাণের দাম তার চেয়েও কমে গেছে, কোন আক্কেলে মানুষ তোমার বিরহের গল্পে মুগ্ধ হবে?
আমাদের এক শ্রেণির কবি সাহিত্যিকের রচনা পড়ে মনে হয় দুনিয়ার যত সমস্যা ছিল সবার সমাধান হয়ে গেছে, কেবল একটি সমস্যার সমাধান হয় নাই। সেটা হচ্ছে প্রেম। সকল সৌন্দর্যের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে, কেবল একটি রহস্যের উদ্ঘাটন বাকি আছে, নারীদেহ। সকল মানুষ সুখে আছে, শান্তির সাগরে সাঁতার কাটছে, কেবল এক ধরনের মানুষ অশান্তির সাগরে লোনা পানি খাচ্ছে, তারা হচ্ছে বিরহে জর্জরিত প্রেমিক-প্রেমিকা।
সাহিত্যের পরিধীকে ছোট করতে করতে তারা এই পর্যায়ে এনেছে বলেই আজকের এই আবেদনহীন সাহিত্য মানুষ গিলছে না। এসব দিয়ে হাজারো সমস্যায় জর্জরিত মানুষকে আকৃষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply