সেই শাহাতলী রেল স্টেশন 

মোঃ মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী, প্রাক্তন সিনিয়র সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয় ::

পাইকদির গুদাড়াঘাট সবেমাত্র পার হয়েছি। মানসিক অবস্থা এমন যে, একটু হেলেদুলে হাটবো।  তাড়াহুড়া করার দরকার নেই। কিন্তু বিধিবাম। এর মধ্যেই কানফাটা লম্বা হুইসাল। আর ঝক ঝক আওয়াজ করে ধেয়ে আসছে মধুরোড হতে  শাহাতলী রেল স্টেশন অভিমুখে। মধুরোড ষ্টেশন হতে  রেলগাড়িটি দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। এই ছাড়লো আর কয়েক মিনিটে শাহতলীতে হাজির।


প্যান্ট গুটাতে গুটাতে হাফ প্যান্ট করা, জুতা খুলে হাতে আর বই-খাতা বগলদাবা করে ভো-দৌড়। সেই দৌড়ের কি তুলনা হয় ?  হাল আমলের ম্যারাথন-চ্যাম্পিয়নও হার মানতে বাধ্য। হালকা-পাতলা গড়ন, যেন তালপাতার সেপাই, দৌড়াতে ওস্তাদ। আসলে দৌড়ের কোন  বিকল্পও ছিল না। শীত কাল হলে তো কথাই নেই।  জুবুথুবু অবস্হা। আজকের মতো অতো গরমের কাপড় ক’জনই পরতে পারতো।   সেই সাত-সকালে চারিদিক ঘন কুয়াশার ছাদরে  ঢাকা , রাস্তা  শিশির সিক্ত, উত্তরের হিমেল হাওয়া। প্রকৃতির বিরুদ্ধে কী কঠিন যুদ্ধ !  উল্লেখ্য, আমাদের গ্রামের বাড়ি  সকদি রামপুর হতে সোজা উত্তরে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে এই রেলস্টেশনটির অবস্থান।

শীতকালে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় প্রকৃতি থাকে নির্জীব, ম্রিয়মান। মনে হয় বরফের দেশে বসবাস। গোসলতো করতে হয়। গরম পানি দিয়ে গোসল করা, চরম বেরাইম্যার  কান্ড! তা কি হয়?  উত্তরমুখি পুকুরের বিশাল ঘাটে বসে বসে রোদে পিট তাতানো। কতো সময় যে চলে যেতো তার হিসাব কে রাখে?  হঠাৎ করে  ঠান্ডা  হাওয়ায় কাচুমাছু করছে । গুলমারা মানুষগুলো বলে উঠতেন- সিলেট-আসাম থেকে আমদানিকৃত অনেক ডাব্বা শীত শাহাতলীতে ছেড়ে দিয়েছে। এই শীত সেই শীত।হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে পানিতে নাকানিচুবানি। শীতও গেল, গোসলও হলো। সে কী ভয়ংকর সুন্দর দিনগুলো ছিল। আর রাতের বেলায় ট্রেনের হুইসল শুনে মনে হতো কষ্ট করে শাহাতলীতে যেতে হবে না। পাশের বাড়ির উত্তর দিয়েই ট্রেন যাতায়াত করছে। ঘর হতে শুধু দু’পা ফেলেই চম্পট।
তবে, বাস্তবতা সুদূর পরাহত।  বাড়ি হতে কঠিন পথ পেরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে স্টেশনে আগমন। এ-কি!   ট্রেন কোথায়? ধক্কর ধক্কর করে কেবল  ইঞ্জিনের অশরীরী আওয়াজ। এর উপর   গাদাগাদি করে হাজারো মানুষ, বাদুরঝোলা। বাহির হতে  ঠেলাঠেলি  করলে কি কোন লাভ আছে?  আগের দুই-তিন স্টেশনেই ওভার লোডেড। তিল ধারনের ঠাঁই নাই। তাতে কী ? যেতেই হবে।  কোন রকমে একটা পায়ের স্পর্শ দিতে পারলেই কেল্লাফতে। মনে হয় বিশ্বজয়।  এটাই ছিল রূঢ় বাস্তবতা। এ যেন মহান স্বাধীনতা দিবসে ঢাকা স্টেডিয়ামে  ভারতেশ্বরী হোমস্ এর সেই বিখ্যাত মোটরসাইকেল রেস। মোটরসাইকেল আদৌ দেখার উপায় নেই। দুই দিকে, উপরে, পাশে মনে হতো শত শিশুর অলৌকিক ক্রীড়াচক্র। আমাদের ট্রেনেরও এমন অবস্থা।

যাত্রাপথের  কী ভয়ংকর অবস্থা। একটু পা পিছলে ভবলীলা সাঙ্গ। ছোট কালের ছড়া-“রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম…। ” ভেতরে নিঃশ্বাস ফেলার যো নেই। ঘামের দুর্গন্ধে ভূত পালায়। বুমি আসলেও আটকিয়ে রাখা ছাড়া উপায় নাই। মহান আল্লাহ-ভগবানকে ডাকতে ডাকতে কালীবাড়ি ষ্টেশনে পৌঁছলে মনে হতো মহান আল্লাহর রহমতে এইযাত্রায় বেঁচে গেলাম। পরেরটা পরে দেখা যাবে।

সেই ৮০-এর দশকে রাস্তা-ঘাটের যে কী দুর্গতি এই প্রজন্মের মানুষের কল্পনাশক্তিকেও হার মানাবে। বর্ষাকালের মাঠ-ঘাট-ক্ষেত-খামার পানিতে টুইটুম্বুর। অনেক স্হানের কাঁচা  রাস্তাও পানির নীচে। ঘোলাটে থাকায় পা টিপে টিপে অগ্রসর হওয়া, নচেৎ নির্ঘাত হাবুডুবু। যেটুকু দৃশ্যমান তাও আবার হাটু পর্যন্ত কাঁদা। ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।

সেই ভোরে  মায়ের রান্না করা  গরম ভাত আর আগের দিনের এটা-সেটা মোটকথা পেট চুক্তি ভূরিভোজন করেই রওনা দিতে হতো। কারন সারাদিনের চালান, এনার্জি।  খেতের মধ্যে দিয়ে কখনো কোণাকুণি দৌড়। তবে, ফ্যাশন-সচেতনদের কি যে হাল হতো তা দেখে শরৎচন্দ্রের “নতুনদা”  হার মানবে । কলেজ-স্টুডেন্ট, হঠাৎ আধুনিক সাজা, টাইট-ফিট শার্ট,  প্যান্টের নীচের অংশ যেন প্যাটি কোট বা লুঙ্গির সাইজ – কি যে বেহাল দশা হতো তা দেখলে ঢাকাইয়াদের মতো “ঘোড়াবি হাসে”। প্রায় সকলেরই  তিন-চার ইঞ্চি উঁচু বেল্টযুক্ত  হাই-হিলের ১০০/টাকার জুতার কি যে কদর ছিল, বই-খাতা নষ্ট হোক – মাগার জুতোতে একফোঁটা কাঁদা-পানি লাগবে-তা কি হয়?

আজকের মতো ঘরে ঘরে ঘড়ি। সে-তো কেবলই স্বপ্ন। তাই সূর্য-ঘড়ি, সূর্যের ছায়া-ঘড়ি, দেহ-ঘড়ির উপরে আন্দাজ করে চলা ছাড়া গতন্তর ছিল না। ফলে দ্রুত পাইকদি গুদাড়া ঘাটে আগমন। দূর হতে সামনে  কাউকে দেখলে নৌকা আটকাও বলে চিৎকার, মাইকের আওয়াজও হার মানতো। কেননা, গুদাড়া ফেল, ট্রেন ফেল। মাথায় হাত।সেই ভাব সম্প্রসারন- “এক নদী বিশ ক্রোড়, কাল ক্ষয়ে নাই হেথা আপসোস”। ফলে আর আপসোস করতে হয়নি। চার আনা দিয়ে গুদাড়া পার -মানি উল্কা বেগে ট্রেন আসলেও ডেম কেয়ার।

একটা প্রবাদ প্রচলিত  আছে- ন’টার ট্রেন কয়টায় যায়। হাই এন্টেনা/ উপগ্রহ/ ট্রেনের বার্তা টরে টক্কা না শুনে এবং জ্যোতিষী না হয়েও অবলীলায় বলা যেতো- নির্ধারিত সময়ে ট্রেন আসতেই পারে না। তবে, দুই এক দিন যে এর ব্যত্যয় ঘটেনি তা নয়। সেই ফাঁকি ফুসিয়ে নিতেও সিদ্ধহস্ত ছিলাম। ঐ যে গানের কলি-“রেললাইন,  লাইন বহে সমান্তরাল “।  দুইজনের দুই হাত ধরে রেললাইনের উপর দিয়ে মার্চ করতে করতে ঠিকই চাঁদপুরে উপস্থিত। দুই একবার সোজা হেটে মহামায়া বাস ষ্টেশন হয়ে চাঁদপুরে গিয়েছি । তাও নাছোড়বান্দা, মোমিনের এক জবান।

তারুণ্য-দীপ্ত উদ্দামতার সুখময় স্মৃতি রোমন্থন করে এখনো রক্ত টগবগিয়ে উঠে। সেই চল্লিশ বছরের পুরনো স্মৃতি একটু ঝালিয়ে নেয়ার অভিলাষ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। হঠাৎ করেই সুযোগ হয়েছে। চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তাকে অনুরোধ করলাম- ছোটকালের এক বিলাসী স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। কালিবাড়ি ষ্টেশন থেকে শাহাতলী পর্যন্ত ট্রেনে যেতে ইচ্ছুক। তবে, অবশ্যই টিকেট কেটে। তাঁর বদান্যতায় টিকেট পেলাম। বড় ষ্টেশন হতে দুইজন দিয়ে অগ্রীম সিট দখল। তারা নেমে আমাদের নিকট দখল হস্তান্তর হলো । সঙ্গে  সম্মানিত কর্মকর্তা সহযাত্রী। একজন ভদ্রলোক চিৎকার দিয়ে বলেই যাচ্ছেন, “এরই-এরই ডাব্বা কাইত কচ্ছে, তাড়াতাড়ি রেডি হ, গাট্টিডা আরে দে “। খাঁটি দেশি কথা। বন্ধুসহ একটু মজাই পেলাম।

এবার কিন্তু নির্ধারিত সময়েই ট্রেন ছেড়েছে।   Just time, no complain. সাথে সাথে  কোকিলকণ্ঠী রুনা লায়লার সেই বিখ্যাত গান মনে পড়ে গেল-
” ইস্টিশনের রেলগাড়িটা
মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা
কখন বাজে বারটা… ।

সেই বাদুড় ঝোলা আর নেই। নিঃশ্বাস ফেলার যথেষ্ট ফুরসৎ রয়েছে। কাছেই গাড়ি থামানোর শেকল। ছোট কালের  মুখস্হ উক্তি, ” গাড়ি   থামাতে  হলে শিকল টানুন, অযথা টানলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা ( Stop train pull chain, penalty tk. fifty for improper use).  রুনা লায়লার সেই গানের সঙ্গেও কী মিল!  ” জরিমানা হইয়া যাইবো
যদি টানে চেনটা “।

যাত্রী একবারে কমও নয়। একপাশে যতদূর দৃষ্টি যায় সবুজ বনানী, ডাকাতিয়া নদী, ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ফসলি মাঠ । ট্রেনের গতিও বেশ ভালো। বিখ্যাত  Scottish Novelist Robert Louis Stevenson -এর কবিতা ” From a railway Carriage ” এর কবিতাংশ  মনে পড়ে গেল :-
“Faster than fairies, faster than witches… ”

কামরা ভর্তি  শিক্ষার্থী। অনেকেই দাঁড়ানো।  বিশেষ করে মেয়েদের জন্য খুবই  অস্বস্তিকর অবস্থা। একজনকে আমি সিটটি ছেড়ে দিলাম। আমার সহকর্মীও অগত্যা আমাকে অনুসরণ করলো। মনে মনে হয়তো কষ্ট পেয়েছেন, আর ভাবছেন কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম রে । প্রশ্ন করলাম – কে কোথায় পড়ে, কোথায় যাবে, কষ্ট হয় কিনা, বিকল্প আছে কি -না ইত্যাদি ইত্যাদি। উপযাচক হয়ে নিজের পরিচয় এবং চল্লিশ বছর আগের A journey by Train -এর অভিজ্ঞতা বিনিময় করলাম। কথা শুনে যেন হাসির খোরাক  হয়ে গেছি। পুরনো দিনের স্মৃতি তাদের কাছে অবিশ্বাস্যই মনে হয়েছে।

সুবোধ বালকের মতো একজন টিটিই এর মুখদর্শন হলো। তিনি ভুলেও টিকেট চেক করলেন না। করবেনই বা কেন?  কথা প্রসঙ্গে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম- কালিবাড়ি টু শাহাতলী টিকেট করেছো?  তাদের-তো আক্কেল গুড়ুম। মনে মনে ভাবে- বোকা নাকি রে ? ট্রেন আমাদের পৈত্রিক সম্পদ। এর আবার ভাড়া কি ?  কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলাম – আচ্ছা বলোতো -ভাড়া কতো ? এতে তাদের চেহারা মোবারক দেখে মনে হয়েছে – মহাপাপরে পড়েছে। এটাতো কোন প্রশ্ন হলো না। সোজা উত্তর বলে দিচ্ছি -১০০% ফেল।  কেননা, এটাই মফস্বলের রেলওয়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য। টিকেট না করা জন্মগত অধিকার, রাষ্ট্রের স্হায়ী দায়।

বিষয়টি নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। রেলপথের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। ব্রিটিশরা এদেশে শাসন, শোষণ, নিয়ন্ত্রণ, সহজ ও দ্রুত সেনাবাহিনীর গমনাগমন, এদেশের উৎপাদিত  কাঁচামাল ব্রিটেনে প্রেরণের লক্ষ্যে নৌ-সংযোগ স্হলে প্রেরণ ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী এবং ঔপনিবেশিক কারণে ভারতবর্ষে রেললাইন স্হাপন করে। জনগণের যাতায়াতের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি -অতি অবশ্যই এমন মহৎ উদ্দেশ্য ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি আমলে  ছিল না । পূর্বোক্ত লক্ষ্য,  দুর্গম, পাহাড়ি-প্রত্যন্ত অঞ্চল  ইত্যাদি দিক বিবেচনায় নিয়ে তারা আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ১৮৯২ সনে। ঢাকা, চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযোগ করার জন্য  লাকসামকে করে জংশন। আর আসাম, সিলেট, চট্টগ্রামের সঙ্গে  চাঁদপুরের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য গড়ে তোলে রেলপথ। তখন স্হল পথে যাতায়াত সহজসাধ্য ছিল না। খরস্রোতা গঙ্গা, মেঘনা, পদ্মা বৃহত্তর বাংলায় জালের মতো সুবিস্তৃত ছিল। নৌ পথে মালামাল বহনের খরচও অনেক কম। চাঁদপুর স্টিমারঘাটের সে কি নামডাক ছিল তা কল্পনাতীত। চাঁদপুরের সঙ্গে ঢাকা, নদীবাহিত অন্যান্য অঞ্চল,   দক্ষিণাঞ্চল এবং সুদূর কলিকাতা পর্যন্ত নদীপথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্হাই    লাকসাম-চাঁদপুর রেললাইন নির্মাণের মূল লক্ষ্য  ছিল।

লাকসাম হতে বড় স্টেশনের দূরত্ব ৪৩ কিলোমিটার। বড় স্টেশন হতে শাহাতলীর দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। এই স্টেশনটি চালু হয়েছিল ১ জুলাই ১৮৯৫ তারিখে। সেই থেকে চলছেই। এটা ‘বি’- শ্রেণিভুক্ত একটি প্ল্যাটফর্ম। এতে ১টি লুপ-লাইনসহ রেলপথ রয়েছে দু’টো। মধুরোড বা কালিবাড়ি ষ্টেশন হতে  (সরকারি  নাম চাঁদপুর কোর্ট রেলওয়ে স্টেশন)  সামান্য সময়ই লাগে। মৈশাদীতে পরে একটি নতুন স্টেশন হয়েছিল।

পৃথিবীর সকল দেশে রেলওয়ের মর্যাদা অনেক অনেক বেশি। রেলপথে অতি সহজে,অল্প খরচে, একইসঙ্গে  বিপুল সংখ্যক যাত্রী পরিবহন এবং আলাদাভাবে মালামাল পরিবহনের জন্য মালগাড়ির ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বুলেট ট্রেন, ইলেকট্রনিক ট্রেন, দ্রুতগামী ট্রেন দূর পাল্লার যাত্রীদের জন্য বিশ্বব্যাপী নিরাপদ ও  অতি জনপ্রিয় বাহন। বহু উন্নত দেশে মাটির উপরে পরিচালিত যানবাহনের যাত্রীর তুলনায় বহুগুণ বেশি যাত্রী চলাচল করে সাব-ওয়ে তথা পাতালরেলে।   সরকার রেলওয়ের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। আলাদা মন্ত্রণালয় করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব শৈলী এখানেও সগৌরবে উপস্থিত। পদ্মা সেতুর সঙ্গে সুবিস্তৃত এলাকার সঙ্গে রেলপথও সমানতালে পাল্লা দিয়ে স্থাপিত হচ্ছে। অচিরেই তা দৃশ্যমান হবে।

ঢাকা শহরের যানজট হ্রাস, যাতায়াত সহজসাধ্য করার লক্ষ্যে জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণছে বহুল কাঙ্ক্ষিত মেট্রোরেলের যাত্রী হওয়ার জন্য। আরও অসাধ্য সাধন করা এবং কল্পনাশক্তিকে হার মানানোর ঘটনাও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকা শহরে হচ্ছে সাব-ওয়ে/পাতাল রেল। অদূর ভবিষ্যতে  পাতালপুরীতে চলবে লাখ লাখ মানুষ। ঐ সময় পর্যন্ত মহান আল্লাহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং আমাদের হায়াত-দারাজ করুন।

স্বপ্ন হতে  ফিরে যাই কঠিন বাস্তবতায়। চলুন আবার শাহাতলী স্টেশনে। মহান সংবিধান বলছে- এ দেশের মালিক জনগণ। সকল রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিক সম্মানিত জনগন। তেমনিভাবে রেলওয়ের মালিকও জনগণ। কোন বেসরকারি পরিবহনে বিনা ভাড়ায় বা বিনা টিকেটে যাত্রী হওয়ার বিষয়টি কল্পনাও করা যায় না। আর আইন দিয়ে সব কিছু করা যায় না। কেননা,  The Railways Act, 1890 (Act No. 1X  of 1890) – এর ধারা ১১৩/১১৪ অনুযায়ী বিনা টিকেটে ভ্রমণের শাস্তির বিধান এখনো বিদ্যমান। আইন সর্বক্ষেত্রে, সমানতালে প্রয়োগ করা সমীচীনও নহে।

পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে  যানবাহনের ক্রয়মূল্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, জ্বালানী, মেরামত, ঝুঁকি  ইত্যাদি ইত্যাদি বহুবিধ খরচ এর সঙ্গে যুক্ত। তারপর লাভ। বেসরকারি পরিবহন লাভজনক এবং জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে কিন্তু যাত্রীর পরোক্ষ অবদানই অনেক বেশি। ফলে এ খাত দিনদিন বিকশিত হচ্ছে। আর কোন কোন ক্ষেত্রে  জনগণের অসচেতনতা, কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শীতা, জনসম্পৃক্ততার অভাবে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রেলওয়ের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। অবশ্য  এটা কেবল কিছু কিছু স্টেশনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

চাঁদপুর হতে লাকসামমুখি প্রতিটি ট্রেন হতে  প্রত্যেক স্টেশনে যাত্রী উঠানামা করতো। বড় স্টেশন, কালীবাড়ি ষ্টেশন, মৈশাদী, শাহাতলী, মধুরোড, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, ওয়ারুক, মেহের, চিতৌষী, শাহারাস্তি হয়ে লাকসাম পর্যন্ত কতো স্টেশন ছিল। সাধারণ মানুষের কতো যে উপকার হতো তা ভাষায় প্রকাশের অতীত। এসব স্টেশনকে কেন্দ্র করে হরেক রকমের ব্যবসা-বানিজ্য হতো, বহুমাত্রিক উন্নয়নের ফসল মানুষ ভোগ করতো। সরকার হয়তো বাস্তব কারনেই অনেকগুলি বন্ধ করে দিয়েছে। বিকল্প হিসেবে বেসরকারি পরিবহন অনেক বিকশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের দিকেও দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক  মর্মে সচেতন মহলের অভিমত। সহজলভ্য এবং স্বল্প ব্যয় বিশিষ্ট এই রেললাইনটির পুনরুজ্জীবন দেয়া যেতে পারে। মূলত আর্থিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় শাহাতলীসহ অনেক স্টেশন বন্ধ। ট্রেনের সংখ্যাও হাতে গোনা কয়েকটি। জনবল সঙ্কট এবং অলাভজনক হওয়ায় টিকেট কাটার লোক পর্যন্ত নাই। আলাপকালে জানা গেল যে, সকলে মিলে পুনরায় উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে জনবহুল এলাকার এসব স্টেশন প্রাণ ফিরে পাবে।

স্হানীয় রেল কর্তৃপক্ষ উদ্যোগটি নিতে পারেন। জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-প্রধান, ছাত্র প্রতিনিধি, সুধীমহল, সাংবাদিক, অভিভাবক-প্রতিনিধি প্রমুখের উপস্থিতিতে আলোচনার ভিত্তিতে এসব স্টেশন পরিপূর্ণভাবে চালুকরন, বিনা টিকেটে যাত্রী হওয়া বন্ধে যথাযথ ব্যবস্হা গ্রহণ, প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ বা সাপ্তাহিক/মাসিক ভাড়ার ব্যবস্হাকরন, আরও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নেয়া যেতে পারে।

শাহাতলী রেল স্টেশন শাহানশাহের মতো আলোকোজ্জ্বল হোক।

শেয়ার করুন

Leave a Reply