সেলিম খানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ
চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
চাঁদপুরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিরুদ্ধে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করছেন আদালত। ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশ সোমবার এই আদেশ দেন। গতকাল মঙ্গলবার আদেশের কপি পুলিশের বিশেষ শাখায় পাঠিয়েছেন আদালত।
সেলিম খানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এর অনুসন্ধান চলমান রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। অনুসন্ধান করছেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান সরকার। তিনি জানান, অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে সেলিম খানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য আদালতে আবেদন জানিয়েছিল দুদক। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই নিষেধাজ্ঞা জারি হলো।
ইতোমধ্যে সেলিম খানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ২০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক। আরও সম্পদের খোঁজ মিলেছে। তার বিরুদ্ধে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণে সরকারি অর্থ আত্মসাতের ষড়যন্ত্র এবং পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।
সংস্থাটির এনফোর্সমেন্ট ইউনিট ইতোমধ্যে চাঁদপুর সদরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত স্থান, বালু উত্তোলনের স্থানে অভিযান চালিয়েছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে দুর্নীতির বিষয়ে তথ্য, নথি, কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে। এনফোর্সমেন্ট ইউনিট সেলিম খানের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণে কারসাজি করে মৌজা মূল্যের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ দাম দেখিয়ে ১৩৯টি দলিল তৈরি করে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছে।
তার বিরুদ্ধে পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করে সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সত্যতা পেয়েছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়গুলো অনুসন্ধানের সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। কমিশন এরই মধ্যে প্রতিবেদনটি পরীক্ষা করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ল²ীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনা পাড়ে একটি এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরে ৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে দেখা যায় চেয়ারম্যান সেলিম খান, তার ছেলেমেয়েসহ অন্যান্য জমির মালিকরা অস্বাভাবিক মূল্যে দলিল তৈরি করেছেন। ফলে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে জেলা প্রশাসক তদন্ত করলে বেরিয়ে আসে সরকারের কয়েকশ কোটি টাকা লোপাটের পরিকল্পনার তথ্য।
ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে জেলা প্রশাসক উল্লেখ করেন, ওই মৌজায় জমির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক। ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা যায়, অধিগ্রহণ প্রস্তাবিত ও পূর্বে অধিগ্রহণকৃত দাগগুলোর জমির হস্তান্তর মূল্য অস্বাভাবিক।
এছাড়া এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় জনস্বার্থ ও সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে সৃজন করা দলিল ছাড়া ১১৫ নম্বর ল²ীপুর মৌজার অন্যান্য সাফ কবলা দলিল বিবেচনায় নিয়ে ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অধিগ্রহণের প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। উচ্চমূল্যের সেই দলিলগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করলে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতি হতো। এছাড়া মৌজা মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণ ভূমি হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে সমস্যায় পড়তো।
এদিকে, সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের পক্ষে অবস্থান নেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ একটি অংশ। সরকারি অর্থ লোপাট চেষ্টার পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার পর শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। এরই মধ্যে চাঁদপুর ভূমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য উপস্থাপন করায় চেয়ারম্যান সেলিম খানকে গত ১০ ফেব্রæয়ারি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় জেলা প্রশাসন।
অপরদিকে, গত কয়েক বছর ধরে চাঁদপুরের নদী অঞ্চলে শত শত ড্রেজার বসিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে ওই চেয়ারম্যানসহ একটি চক্রের বিরুদ্ধে। এমনকি অনুমতি ছাড়াই চেয়ারম্যান বছরের পর বছর বালু বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। দীর্ঘদিন বালু ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। সর্বশেষ ৬ এপ্রিল সেলিম খানের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ যাচাইয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুমিল্লার সহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সা’দাতের নেতৃত্বে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক টিম।