ইলিশ : চাঁদপুরের জলজ্যোৎস্না

মারুফা সুলতানা খান হীরামনি ::
রুপ লাবণ্যে ভরপুর ইলিশ, বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। যাকে কিনা মাছের রাজা বলেও কেউবা ডাকে। আর এই ইলিশকে নিয়েই দেশে এবং এর বাইরে নানা গল্প এবং লেখালেখি। বিশেষ করে, চাঁদপুরের সুবিশাল পদ্মা-মেঘনার ইলিশের স্বাদ-গন্ধ, বিচরণ, প্রজনন, শিকার, সংরক্ষণসহ আছে নানারকমের কথা। ২০১৫ সাল। চাঁদপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুস সবুর মন্ডল ইলিশ নিয়ে জেলা ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম শুরু করেন এবং তিনি চাঁদপুর জেলাকে “ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’’ নামে ব্র্যান্ডিং করেন। এর দু’ বছর পর ২০১৭ সালে এই জেলা ব্র্যান্ডিংকে সরকার স্বীকৃতি দেন এবং একই বছরে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশেকে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই (GI) পণ্যের স্বীকৃত চেয়ে আবেদন করলে মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা World Intellectual Property Organization (WIPO) ইলিশকে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত করে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।


মজার ব্যাপার হচ্ছে, সারাবিশ্বে যে পাঁচ প্রজাতির ইলিশ মাছ পাওয়া যায়, তার মধ্যে তিন প্রজাতির ইলিশই পাওয়া যায় ব্র্যান্ডপণ্যখ্যাত “ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর”-এ। আরও একটি মজার ব্যাপার, চাঁদপুরের মানুষজন ভালোবেসে ইলিশ মাছকে বিভিন্ন নামে ডাকে যেমন; জলপুষ্প, জলজ শস্য, জলজ্যোৎস্না ইত্যাদি। সেখানের মানুষ মনে করেন, ইলিশের বাবার বাড়ি চাঁদপুর। তাইতো বাংলাদেশের চিরায়ত সংস্কৃতির মতো মেয়েরা সন্তানদানের সময় যেমন তাদের বাবার বাড়িতে আসে ইলিশ মাছও তেমন গভীর সমুদ্রে বিচরণকারী হলেও ডিম পাড়ার জন্য নদীতে চলে আসে। বিশেষ করে, ভোলা-বরিশাল জেলার নদীগুলো পেরিয়ে চাঁদপুরের প্রায় ৭০ কিলোমিটার পদ্মা-মেঘনা অঞ্চলকে পছন্দ করে নেয় বেশি। যদিও ওইসব এলাকার নদীগুলোতে চাঁদপুর অঞ্চলের চেয়ে বেশি ইলিশ শিকার হয়। ইলিশের এই ভরা মৌসুমে জেলেরা দলে দলে নেমেছে ইলিশ শিকারে। আর জেলেদের এই আহরিত ইলিশ গত কয়েক বছরই উৎপাদনের দিক থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু চাঁদপুরের জেলেদের একটাই হতাশা- ওরা এই মিঠাপানি থেকে ইলিশ ধরতে পারছে কম। এর কারণগুলো বহুবিধ।
ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস হলো চলার পথে পানির গভীরতা, পানির স্রোত, প্রয়োজনীয় খাবার এবং দূষণমুক্ত পানি। এই মাছের বসবাস মূলত সমুদ্রে হলেও কেবল ডিম পাড়ার জন্য পদ্মা ও মেঘনায় চলে আসে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ইলিশের ডিমের জন্য অনুকূল নয়। এছাড়া ইলিশের মূল খাদ্য প্লাংকটন বা ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ নদীতেই পাওয়া যায়। বৃষ্টির উপর ইলিশের গতিপথ নির্ভর করে এবং বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেলে নদীর পানির বৃদ্ধির সাথে সাথে এর উৎপাদনও বাড়ে। পানিপ্রবাহ কমে গেলে ইলিশের স্বাভাবিক বিচরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে এরা মোহনাতে ডিম পাড়তে বাধ্য হয়। এতে করে ইলিশের প্রজনন ব্যাহত হয় আর মাছের স্বাদেও ঘটে তারতম্য। এবছর ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাব ও করোনাকালের জন্য নদীর পানি বৃদ্ধি ও পানি বেশ দূষণমুক্ত হওয়ায় নদীতে ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদদের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ইলিশের প্রজননের অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনুমান করছেন মৎস্য বিজ্ঞানী এমনকি শিকারীরাও।
ইলিশ মাছ প্রায় সারা বছর ডিম পাড়লেও আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে ও পূর্ণিমার পরে প্রায় একমাসের মতো সময় ডিম পাড়ার হার অধিক । বাংলাদেশ সরকার এই সময়টিকে আরও প্রজননবান্ধব করার জন্য নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই প্রায় একমাস মা ইলিশকে নিরাপদে ডিম পাড়ার জন্য সরকার ইলিশ মাছ আহরণ, বিপণন ও মজুদ নিষিদ্ধ করেন। অর্থাৎ ওই মাসটি অক্টোবর। তাছাড়া ডিম পাড়ার সময় ডিম ফুটে যখন জাটকা মাছে পরিণত হয় তখন সেই জাটকা মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময়টা হলো মার্চ-এপ্রিল। জাটকা এবং মা ইলিশ ধরার এই নিষিদ্ধ সময়ে সরকার নিবন্ধিত জেলেদের জীবনধারণের জন্য সরকারিভাবে সহায়তা করছে। জাটকা সংরক্ষণ, অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা এবং ইলিশ প্রজনন সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।


সুস্বাদু এই ইলিশ মাছের স্বাদ ও গন্ধ নির্ভর করে মাছের তেল এবং মাছ ধরার স্থানের পরিবেশের উপর। সমুদ্রের লোনা পানি থেকে ইলিশ যখন নদীর উজানে যেতে থাকে তখন শরীর থেকে লবণ ঝরতে থাকে। ইলিশ যখন নদীতে আসতে থাকে তখন এর প্রজননকাল চলতে থাকে বিধায় এই সময় ইলিশ মাছ কিছু খায় না, শক্তির যোগান আসে শরীরে জমে থাকা চর্বি থেকে। বলা হয়ে থাকে, পদ্মার ইলিশ সবচেয়ে সুস্বাদু। তবে চাঁদপুরে পদ্মা ও মেঘনার মিলন থাকায় সেখানকার ইলিশে অন্য রকম এক স্বাদ পাওয়া যায়। নদীর পানির দূষণের কারণে ইলিশের স্বাদে ও গন্ধে পরিবর্তন হচ্ছে; তবে এই করোনাকাল হয়তো ইলিশের জন্য আশীর্বাদ হলেও হতে পারে। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সময়ে এই নদী অঞ্চল দিয়ে বিগত কয়েক মাসই যান্ত্রিক নৌ চলাচল বন্ধ ছিল। যার ফলে পানি দূষণ হয়েছে কম এবং ইলিশের খাদ্য তৈরি হয়েছে বেশি।
অতুলনীয় স্বাদের এই মাছে উচ্চ মানের আমিষ, তেল, চর্বি, খণিজ উপাদান, ভিটামিন ( এ, ডি, ই ), অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড, ১০ ধরণের এমাইনো এসিড ইত্যাদি পাওয়া যায়। বর্তমানকালের অন্যতম সমস্যা বিষন্নতা কমাতেও ইলিশের জুড়ি মেলা ভার। ইলিশ মাছের বিভিন্ন উপাদান ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অসামান্য অবদান রাখে। চর্বিযুক্ত ইলিশ মাছের কাঁটাও খুব সুস্বাদু। ইলিশ মাছ দিয়ে বিভিন্ন স্বাদের শতাধিক রেসিপি তৈরি করা যায়।

মার্চে ইলিশের পোনা জাটকা রক্ষা অভিযানে পদ্মা-মেঘনা চষে বেড়ান লেখক।-ফাইল ছবি

ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করার সুবাদে চাঁদপুরের ইলিশকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। জাটকা ও মা ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ সময়েও আমি কিছু জেলেদেরকে মাছ ধরতে দেখেছি। তবে বেশির ভাগ জেলেই ঐ সময় মাছ শিকার থেকে বিরত থাকায় বর্তমানে দেশে মাছের উৎপাদন এতো বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা সহজেই অনুমেয় যে, নিষিদ্ধ সময়েও সরকারি বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে যেসব জেলে মাছ শিকার করেন তারা একান্ত জীবিকার তাগিদে বা লোভের বশবর্তী হয়েই নদীতে নামেন। চকচকে রুপালি আলো ছড়ানো ইলিশ মাছ ধরার লোভ। একবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালীন রায় লিখার ঠিক আগে আগে এক আসামী আমাকে বলছিলেন, তার জেল হলে সে আর মালয়েশিয়া যেতে পারবে না, তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত জনতার কাছ থেকে আমি এটাও জানতে পারি যে, সে প্রতিবছর ঠিক মা ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ সময়েই দেশে আসে শুধু ইলিশ মাছ ধরে ব্যবসা করার জন্য। এই ধরণের লোভ ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির অন্তরায়।
চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার মিঠা পানির ইলিশসহ এতদঞ্চলের নদীর সুস্বাদু ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে হলে ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ সময়টিতে একটি মাছও যেন আহরিত না হয় তার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে। তাছাড়া মাছ শিকারের মৌসুমে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে উপযুক্ত পদ্ধতিতে মাছ শিকার করতে হবে। কাঠের নৌকা আর হারিকেন জ্বালিয়ে ঢেউ বাতাস খেয়ে খেয়ে মাছ ধরার রীতি থেকে জেলেদেরকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। নিবন্ধিত জেলেদেরকে মাছ ধরার আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ইলিশ শিকারের পরবর্তী ধাপে আহরিত মাছ সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপনের পাশাপাশি মাছ মজুদ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ জরুরি।
বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম একটি রীতি পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়া। বৈশাখ মাসে পরিপক্ক ইলিশসহ জাটকা মাছ বেশি পাওয়া যায় আর বাংলা নতুন বর্ষ বরণ করার সময় পাতে পান্তা ইলিশকে প্রাধান্য দেয়া হয় বিধায় এই সময়টায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ হলেও জেলেরা ইলিশ ধরার উৎসবে মেতে উঠতো। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইলিশ বাঁচানোর দায় থেকে তাঁর পহেলা বৈশাখের খাদ্য তালিকা থেকে ইলিশ মাছ বাদ দেয়ায় দেশের জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং সেজন্য ইলিশ মাছেরও উৎপাদন বেড়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেল, পৃথিবীর মোট ইলিশের প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে এবং দেশে মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ দখল করে আছে এই রুপালি ইলিশ। দেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১ শতাংশেরও বেশি।
ভীরু এবং একসাথে ঝাঁক বেঁধে চলা অত্যন্ত দ্রুত সাঁতারু ইলিশ মাছ দিনে প্রায় ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত সাঁতরাতে পারে। সমুদ্র ও নদীতে বিচরণকারী এই মাছকে পুকুরের মিঠাপানিতে চাষ করার গবেষণা করা হলেও সেই গবেষণা আলোর মুখ দেখেনি। অপার সম্ভাবনার এই ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি থেকে শুরু করে এর আহরণ, সংরক্ষণ ও বিপণন পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ও উন্নত মানসম্মত গবেষণার দাবিদার। সেক্ষত্রে বাংলাদেশের জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই ইলিশ মাছের জন্য স্বতন্ত্র ইলিশ গবেষণা ইন্সটিটিউট স্থাপন করা সময়ের দাবি। ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ বিধায় বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীকেন্দ্র চাঁদপুরে স্থাপন করা যেতে পারে ইলিশ গবেষণা ইন্সটিটিউট।
লেখক : মারুফা সুলতানা খান হীরামনি, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, পরিবেশ অধিদপ্তর, সদরদপ্তর, ঢাকা

শেয়ার করুন

Leave a Reply