কৈশোরে সোশ্যালমিডিয়ায় আসক্তি : সচেতন হবার সময় এখনই

আলী হায়দার ::
ধানমন্ডির একটি ক্লিনিকে শিশু বিশেষজ্ঞ এক ডাক্তারের চেম্বারের সামনে অপেক্ষমান আমি। সাথে আমার কন্যা। আমার সামনের চেয়ারে বসা এক ৭-৮ বছরের শিশু। শিশুটির অভিভাবক পাশেই আছেন আর শিশুটিকে ব্যস্ত রাখতে হাতে দিয়েছেন স্মার্টফোন। শিশুটি কিছু সময় পর পর মোবাইলের স্ক্রিণকে নিচ-থেকে উপরে স্ক্রল করছে, নিজে থেকেই হাসছে। মোবাইল ফোন থেকে আসা শব্দ আর সঙ্গীতে বুঝতে পারলাম শিশুটি টিকটক দেখছে।


যারপরনাই বিস্মিত হলাম! এ বয়সে শিশুটি শুধুমাত্র স্মার্টফোনে এক্সেসই নয়, রীতিমত টিকটকের দর্শক বনে গেছে! মনে প্রশ্ন জাগলো, শিশুটির অভিভাবক কী জানেন এর ভয়াবহতা বা টিকটকের কন্টেন্ট তার শিশুটির জন্যে উপযোগী কি-না?
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বিকশিত হয়েছে এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সোশ্যাল মিডিয়া এখন কিশোর-তরুণদের জীবনে একটি অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে সামাজিক মিডিয়া বিশেষ করে টিকটক নতুন চ্যালেঞ্জ এবং উত্তেজনাপূর্ণ সুযোগ উভয়ই তৈরি করেছে কিশোর-তরুণদের মাঝে। প্রশ্ন উঠেছে কীভাবে নির্দিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়ার অভিজ্ঞতা কিশোর-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। ইতোমধ্যে দেশে বেশ কয়েকবার খবরে উঠে এসেছে টিকটকের প্রভাবে কীভাবে কিছু কিছু কিশোর-কিশোরী বিপথে যাচ্ছে।
স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, এবং গেমিং কনসোল সহ অসংখ্য ডিভাইস জুড়ে কিশোর-তরুণদের অভূতপূর্ব বিচরণ ও ডিজিটাল সামগ্রীর অ্যাক্সেসের সাথে আজকের মিডিয়ার সংযোজন আগের চেয়ে বড় এবং আরও বৈচিত্রময়। সোশ্যাল মিডিয়া এই ল্যান্ডস্কেপের একটি কেন্দ্রীয় অংশ। সোশ্যাল মিডিয়া এর ব্যবহারকারীদের সামাজিকভাবে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে দেয় যা প্রথাগত মিডিয়ায় সম্ভব না (যেমন, টেলিভিশন, রেডিও বা প্রিন্ট নির্ভর মাধ্যমগুলো)। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ার প্লাটফর্ম থেকে ব্যবহারকারীরা শুধু এর কন্টেন্ট দেখা বা শোনা-ই নয়, নিজেরো তৈরিও করতে পারে এবং জনপ্রিয়তাও নির্ণয় করতে পারে। এর একটা গভীর প্রভাব আমাদের তরুণ সমাজে পরিলক্ষিত। ভিউ আর লাইকের প্রতিযোগিতা সব সময় শুধুই মেধার ভিত্তিয়ে হয়, তা’ কিন্তু নয়। কিছু কিছু কিশোর-তরুণ কন্টেন্ট ক্রিয়েটর শোভন-অশোভন আর নীতি-নৈতিকতার বাউন্ডারি ডিঙিয়ে কন্টেন্ট তৈরি করতে চায় যার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য একটিই – যে কোনো মূল্যে বেশি ভিউ বা লাইক সংগ্রহ করা।
“সোশ্যাল মিডিয়া”র অধীনে সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট (যেমন ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম), টেক্সট মেসেজিং অ্যাপ, সোশ্যাল গেমিং টুলস, ইউটিউবসহ আরও কিছু এপ আছে এবং এসব এপের বিভিন্ন রকম প্রভাব শুধুমাত্র কিশোর-তরুণ নয়, এমনকি প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের ওপরও পড়তে পারে। সমসাময়িক কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বোঝার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা বিবেচনা করা প্রয়োজন। তদুপরি, কিছু মহল সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াবারও উদাহরণ আছে অনেক।
অন্যদিকে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক বিকাশকালীন সময়ের বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিবেচনা করে সোশ্যাল মিডিয়া কিশোর-কিশোরীদের কাছে এপগুলোকে অনন্যভাবে আবেদন করে, যা তার ব্যবহারকারীদের এক ধরণের আসক্তি তৈরিতে সহায়তা করে। বয়ঃসন্ধিকালে এ ধরণের প্রভাবে সামাজিক তথ্যের প্রতি সংবেদনশীলতা বাড়াতে পারে, সামাজিক পুরস্কারের জন্য ড্রাইভ বাড়াতে পারে এবং সমবয়সীদের মূল্যায়নের বিষয়ে উদ্বেগও বাড়াতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালের গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়া, প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে স্বাধীনতা বৃদ্ধির চেষ্টা এবং জনপ্রিয়তার অন্বেষণ শিশু-কিশোরদের মানসিক উন্নয়নে বাধা তৈরি করে। সোশ্যাল মিডিয়া এই কাজগুলিকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আইডিয়া, প্রতিযোগিতা ও চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জটিল সব উপায়ে নেভিগেট করার জন্য একটি প্রধান প্রেক্ষাপট তৈরি করে। আর এ প্রতিযোগিতায় “পছন্দ” এবং “ভিউ” এর সংখ্যা দিয়ে নির্ণয় হচ্ছে সফলতা বা ব্যর্থতা। এক্ষেত্রে মেধার মূল্যায়ন খুব কম ক্ষেত্রেই হয় যার পরিপ্রেক্ষিতে কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা প্রতিনিয়ত ”এক্সট্রিম” উপায়ে কন্টেন্ট তৈরিত উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
বেশীরভাগ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী, অল্পবয়সী বা প্রাপ্তবয়ষ্ক – তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় যাতে এটি তাদের জীবনকে দখল করে না নেয়। যাইহোক, এদের বাইরে একদল ব্যবহারকারী রয়েছে যাদের অন্তত একটি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট আছে এবং তারা মনে করেন তাদের উদ্বিগ্ন বোধ এড়াতে প্রতি তিন ঘন্টায় অন্তত একবার একটু ”ঢুঁ মেরে” দেখতে হবে। এটি একটি মানসিক পরিস্থতি যা ওই ব্যক্তির আচরণে প্রভাব ফেলতে পারে। অসঞ্চিুতা, ধৈর্যের অভাব বা অন্যের প্রতি রূঢ় আচরণ এক্ষেত্রে লক্ষণীয়। এর বাইরে আরো কিছু মানসিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতে পারে। যেমন: কথোপকথনের মাঝেই ঘনঘন সোশ্যাল মিডিয়া চেক করা, এভারেজ প্রতিদিন ছয় ঘন্টার বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানো, সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করা সময় সম্পর্কে মিথ্যা বলা, পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে দুরত্ব তৈরি হওয়া, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার কমানোর চেষ্টায় ব্যর্থতা, স্কুল, কাজ এবং নিজের হবিকে অবহেলা বা এর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, সোশ্যাল মিডিয়া চেক করতে না পারলে গুরুতর নার্ভাসনেস, উদ্বেগ বা অনুরূপ উপসর্গ অনুভব করা, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের কার্যকলাপ শেয়ার করার অদম্য ইচ্ছে – এগুলো লক্ষ্যনীয় হলে অভিভাবকদের নজর দেয়াটা দরকার হয়ে পড়বে।
অধিকাংশ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারী তার আসক্তির কথা বুঝতে পারে এবং নিজের সময় এবং প্রায়োরিটি সেভাবে সাজিয়ে নিতে পারে। কিশোর-তরুণদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি একটু জটিল। সহপাঠী বা ভুল বন্ধু-বান্ধবদের সাহচর্যা ও প্রতিযোগিতা, উভয় ক্ষেত্রই অনেক সময় কিশোর-তরুণদের সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি আসক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনতা, সন্তানদের সোশ্যাল মিডিয়ায় এক্টিভিটি মনিটরিং এবং সন্তানদের সাথে মুক্ত আলোচনা তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার পরিমিত ব্যবহার শেখাতে কার্যকর বলে বিবেচিত।

লেখক পরিচিতি: তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা, প্রকৌশলী ও গবেষক।

শেয়ার করুন

Leave a Reply