চলে যাওয়া মুর্তজা বশীর সম্পর্কে চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম

জন্মদিনের ঠিক দুই দিন আগে গত ১৫ আগস্ট চলে গেলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। বেঁচে থাকলে ১৭ আগস্ট ৮৮তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হতো। একই দিনে জন্মদিন দেশের আরেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলামের। জীবনের দীর্ঘ সময় স্পেনে কাটানো এই শিল্পী গত পাঁচ বছর ধরে দেশেই আছেন। ৭৭ বছর বয়সে এসে এঁকে যাচ্ছেন একদম নিজের মতো করে।
মনিরুল ইসলামের জীবনে অগ্রজ শিল্পী মুর্তজা বশীরের প্রভাব রয়েছে। মুর্তজা বশীরের যুক্তিভিত্তিক চিন্তা-ভাবনা আকর্ষণ করত তাকে। আর তাদের জন্মটাও একই দিনে। এই দিনে শিল্পী মুর্তজা বশীর এবং নিজের সম্পর্কে বলেছেন শিল্পী মনিরুল ইসলাম।

মুর্তজা বশীরের সঙ্গে যখন পরিচয় হয়, তখন আর্ট কলেজের (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট) তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন মনিরুল ইসলাম। ‘পরিচয়ের শুরুতেই বুঝেছিলাম যে তার বিরাট একটা সাংস্কৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। যেটা মনে হয় পরিবারের কারণে। তিনি ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সন্তান। মুর্তজা বশীর শুধু ছবি আঁকতেন না। লেখালিখি, সিনেমা, সাহিত্যসহ নানা বিষয়েই অনেক দক্ষতা ছিল তার। চিত্রশিল্পীদের সাধারণত এই গুণগুলো থাকে না। হাতেগোনা কয়েকজন হয়তো এমন গুণের অধিকারী’, বলছিলেন মনিরুল ইসলাম।
‘আমি যখন তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী, তখন মুর্তজা বশীরের এক্সিবিশন দেখেছিলাম। তখন তো আসলে ওই অর্থে কোনো গ্যালারি ছিল না। ‘এপিটাফ’ বলে মুর্তজা বশীরের একটা ওয়ার্ল্ড সিরিজের সেই এক্সিবিশন দেখেই মডার্ন আর্ট সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। আসলে তখন সুযোগ কম ছিল। আর্ট কলেজের লাইব্রেরিতে কয়েকটা বই ছিল, সেগুলো থেকে আমরা জানতাম। কিন্তু, বাইরের জগৎ নিয়ে জানার সুযোগ তখন কম ছিল। তখন মুর্তজা বশীরের এক্সিবিশন দেখে নতুন ধরনের আর্ট সম্পর্কে জানতে পারি। আমরা তো তখন শিক্ষার্থী, ল্যান্ডস্কেপ আঁকি, চাষির ছবি, কুঁড়েঘর, নদীনালা, এগুলো আঁকছি। তখন তার আঁকা দেখে ভিন্ন ধরনের কাজ সম্পর্কে ধারণা পাই।’
শিল্পী মুর্তজা বশীর ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। শুধু চিত্রশিল্পী নন, একাধারে তিনি কার্টুনিস্ট, কবি, লেখক ও গবেষক ছিলেন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মুর্তজা বশীর। শিল্পের বিভিন্ন ধারায় এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন তিনি। যে কারণে তার মনোজগতের বহুমুখিতা সম্পর্কে যেমন মানুষ জানতে পেরেছে, তেমনি তাকে সমালোচনাও শুনতে হয়েছে। এ বিষয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘শিল্পীদের ক্ষেত্রে আসলে দুই ধরনের বিষয় হয়। একটা হলো ডুয়িং আর্ট, যেটা সবাই করছে। আরেকটা হলো— আর্ট অব টকিং (কথাশিল্পী)। তার মধ্যে আর্ট অব টকিংটা ছিল। ওয়েস্টার্ন আর্টসহ বিভিন্ন বিষয়ে মুর্তজা বশীরের পড়াশোনা ছিল অনেক বেশি। তিনি তো এক্সপেরিমেন্টটা করেছেন। তিনি একটার ভেতরে আটকে থাকতেন না। একজন আর্টিস্ট হিসেবে তিনি চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। এটা তো একটা বহুমুখিতার ব্যাপার। অনেকেই এটা করতে পারেন না। তিনি খুব সচেতন ছিলেন যে তার অন্য কিছু করতে হবে। হঠাৎ করে তিনি ক্যালিগ্রাফিও করেছেন। যার জন্য তাকে সমালোচনাও শুনতে হয়েছিল।’
এই যে মুর্তজা বশীর ভিন্নধারার একজন শিল্পী ছিলেন, যার কাছে কোনো নির্দিষ্টতা নয়, প্রাধান্য পেয়েছে শিল্পটাই। কিন্তু, তার কাজের যথাযথ মূল্যায়ন কি হয়েছে? জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, এখানে দুইটা বিষয় বলি। প্রথমে, আমরা বেসিক্যালি শুরুই করি ওয়েস্টার্ন আর্ট দিয়ে। ওয়েস্টার্ন আর্ট তো খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে আমরা কী করি? একটা জাম্প দেই অ্যাবস্ট্রাক্টস আর্টে। এটা একটা পয়েন্ট। দ্বিতীয়ত একটা ছবি আন্তর্জাতিক কমিউনিকেশন। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, একটা লেখা বা শিল্প, যেই সৃষ্টিই হোক না কেন, তার ক্ষেত্রে যদি আন্তর্জাতিক যোগাযোগটা স্থাপন করতে না পারে, তাহলে সেই শিল্পটা এতটা জোরদার হয় না। এখন যদি মূল্যায়ন করা হয়, ওইটা একটা সময়, যখন মুর্তজা বশীর বা আমিনুল ইসলাম বা সমসাময়িক অন্যান্যরা কাজ শুরু করলেন, তখন বাইরে যাওয়ার তেমন সুযোগ ছিল না। সুযোগের অভাবের কারণেই ওই অর্থে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের কাজের পরিচিতি আসেনি।’
‘আমার কাছে মুর্তজা বশীর বিরাট মাপের ব্যক্তিত্ব ও শিল্পী। তিনি তো একটা জিনিস নিয়ে বসে নেই। তার মধ্যে কাজের পিপাসাটা ছিল। একটা কাজ নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। তার যে বৈচিত্র্যময় জগৎ, সেখানে তিনি নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, কাজ করেছেন। কাজের ক্ষেত্রে তিনি কখনও কারো সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেননি। যখন যে সাবজেক্ট তার ভালো লেগেছে, সেটা নিয়েই তিনি কাজ করেছেন। এবং কেউ যদি এর ব্যাখ্যা চেয়েছে, তিনি খুব সুনিপুণভাবে এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তার উপস্থিত বুদ্ধি যথেষ্ট ভালো ছিল। তিনি তর্কও করেছেন, কিন্তু, সেখানে কোনো রাগ ছিল না। মানে ঝগড়া করেননি। আরেকটা ব্যাপার তিনি সবসময় আপডেট থাকতেন। খোঁজ রাখতেন যে কোথায়, কী হচ্ছে। তার আরেকটা বিষয় ছিল যে, গুরু হলেই যে মাথা নত করতে হবে, তা নয়। ভুল থাকলে সেটা নিয়ে সমালোচনা করতে হবে। তিনি কাজের সমালোচনা করতে পছন্দ করতেন এবং এটা করতে উৎসাহ দিতেন।’
ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে চারুকলার পাঠ শেষে ১৯৬৬ সালে সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন মনিরুল ইসলাম। এরপর ১৯৬৯ সালে স্পেন সরকারের বৃত্তি নিয়ে সেই দেশে যান উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য। পরবর্তীতে স্পেনেই স্থায়ীভাবে বাস করে শিল্পচর্চা করেছেন। এচিংয়ে নিজস্ব শৈলী ও দক্ষতার কারণে সত্তরের দশকেই স্পেনে তিনি পরিচিতি পান। এচিং মাধ্যমে তার দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে ‘মনির স্কুল’ কথাটি স্পেনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এচিংয়ের পাশাপাশি এঁকেছেন পেইন্টিং বা জলরঙের ছবিও। তার হাতের ছোঁয়ায় রঙ-তুলিতে সৃষ্টি হয়েছে অনন্য সব চিত্রশিল্প।
দীর্ঘদিন ইউরোপে থেকে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে পরিচয়-সখ্যতা হয়েছে, তাদের কাজ সম্পর্কে জেনেছেন এবং তাদের সঙ্গে কাজও করেছেন মনিরুল ইসলাম। স্পেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার বহু একক ও যৌথ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়াও, তিনি স্পেন, মিশরসহ বহু দেশে আন্তর্জাতিক চারুকলা প্রদর্শনীর বিচারক হিসেবেও কাজ করেছেন। নিজের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দুই বার স্পেনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড অব স্পেন, সেখানকার মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা দ্য ক্রস অব দ্য অফিসার অব দ্য অর্ডার অব কুইন ইসাবেলা, দেশে একুশে পদক ও শিল্পকলা একাডেমি পদকসহ দেশ-বিদেশে নানা পদক-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন মনিরুল ইসলাম।
এতকিছুর পর বিগত পাঁচ বছর ধরে দেশেই রয়েছেন এই গুণী শিল্পী। মাঝে হয়তো কিছু সময়ের জন্য ভারতসহ কিছু জায়গায় গিয়েছিলেন ছবি আঁকার কাজেই। এখন কী ধরনের কাজ করছেন দেশে থেকে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা যারা শিল্পী তাদের অভ্যাসে দেখা যায় শেওলা পড়ে যায়। অর্থাৎ, একই গাড়িতে করে যাওয়া, একইভাবে ভাবা, কাজগুলো একইভাবে করা। কিন্তু, আমার নিজের মধ্যে এখন একটা সাহিত্য জন্মেছে যে ভাবনার বাইরে কিছু করা। যেটা আমি করিনি কোনোদিন, সেটা এখন করার চেষ্টা করছি। আসলে একটা শিল্পীকে অভ্যাস ও প্রথার বাইরে যেতে হয়। নিজের স্বাধীনতাটা নিজেকে দিতে হয়। এখন প্রচুর ছবি আঁকছি। নিজের মতো করে নানা বিষয়ে আঁকছি। নতুন কিছু খুঁজছি।’
করোনাকালে অন্যান্য মানুষের মতো শিল্পীদেরও অনেকটা ঘরবন্দি জীবন যাপন করতে হচ্ছে। তবে, মনিরুল ইসলামের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু ভিন্ন। কারণ, এমনিতেই তিনি ঘরবন্দি থাকতে পছন্দ করেন। পছন্দ করেন একাকিত্ব। এ বিষয়ে শিল্পী বলেন, ‘আমার একাকিত্ব আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। আমার ছবির জন্য এটা আমার দরকার। আসলে আমরা শিল্পীরা সাধারণত একাই।’
গত ১২ বছরে কোনো এক্সিবিশন করেননি এক সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক্সিবিশন করা এই শিল্পী। নিজের মতো করে শুধু আঁকছেন, এক্সিবিশনের কথা ভাবছেন না। ‘এ ছাড়া, এক্সিবিশন করার জন্য কিছু বিশেষ সাইজের (আকার) ছবি আঁকতে হয়। আমরা তো দেখা যায়, যা করি সবই এক্সিবিশনে তুলে দেই। এখন আমার দর্শন ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হচ্ছে— আমি বর্তমানে ভাগ্যবান যে ছবি আঁকার যেকোনো উপাদান কিনতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। যা দরকার আমি কিনতে পারছি। এখন শুধু ছবি আঁকার জন্য সময় প্রয়োজন। এঁকে যদি মনে হয় যে আমি সন্তুষ্ট, তারপর হয়তো এক্সিবিশন হবে’, বলেন মনিরুল ইসলাম।
সবশেষে মুর্তজা বশীর সম্পর্কে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার তাকে খুব ভালো লাগত। তার ব্যক্তিত্ব আমি খুব পছন্দ করতাম। তিনি একটা চরিত্র ছিলেন। তিনি আমার সিনিয়র আর্টিস্ট ছিলেন। তার সঙ্গে মজার কথা হতো আধ্যাত্মিক কথাও হতো। তিনি যে পথে হেঁটেছেন, আমিও সেই পথেই যাচ্ছি।’
১৭ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত

শেয়ার করুন

Leave a Reply