চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় ভাঙনরোধ, ইলিশসহ নদীর সম্পদ রক্ষায় তদন্ত কমিটি গঠন

নদীতে যত্রতত্র অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন
ইব্রাহীম রনি :
চাঁদপুরের নদীতে যত্রতত্র অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিকভাবে শত শত ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে এ অঞ্চলে ইলিশ রক্ষা, পদ্মা-মেঘনা নদীর সম্পদ রক্ষা, নদী ভাঙনরোধ ও নদীর নাব্যতা রক্ষায় এবার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (খাস জমি) জহুরুল হককে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের এ কমিটিকে আগামী ১০ কার্য দিবসের মধ্যে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. জসিম উদ্দিন পাটওয়ারী স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানা গেছে।
পদ্মা-মেঘনার ভাঙন থেকে চাঁদপুরকে রক্ষা, ইলিশ সম্পদ রক্ষায় অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধে জেলে ও স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশের দেয়া চিঠির পাওয়ার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তদন্ত কমিটি গঠন করলো ভূমি মন্ত্রণালয়।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়, চাঁদপুর জেলার পদ্মা-মেঘনা নদীর অংশে নদীর নাব্যতা, ইলিশের অভয়াশ্রম রক্ষা, নদী ভাঙনরোধসহ নদীর সম্পদ রক্ষায় জেলা প্রশাসকের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রেরিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক বিষয়টি তদন্তপূর্বক মতামত/সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রণয়নের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত কর্মকর্তাগণের সমন্বয়ে নির্দেশক্রমে একটি কমিটি গঠন করা হলো।
ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (খাস জমি) জহুরুল হকের নেতৃত্বে সদস্য হিসেবে আছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদা একজন প্রতিনিধি, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (আইন-২) আবুল কালাম তালুকদার, ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (অধিগ্রহণ-১) কবির মাহমুদ, চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দাউদ হোসেন চৌধুরী।
এ কমিটিকে আগামী ১০ কার্য দিবসের মধ্যে মতামত/সুপারিশ প্রণয়নপূর্বক প্রতিবেদন করবে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সায়রাত) কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা করবে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, আমাদের যে সমন্বয় সভা, ইলিশ রক্ষায় টাস্কফোর্সের সভা এবং নদী রক্ষা কমিটির যে সভা হয়েছে সেই সভার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য এবং মতামতের রেজুলেশন ছিল। মামলা করে নদী থেকে যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রি করা হচ্ছে এতে শহরের কি ক্ষতি হচ্ছে তা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, নদী গবেষক, ইলিশ গবেষক বলেছেন সেগুলো ছিল। তাদের মতামতের ভিত্তিতে অতিসত্বর নদী থেকে যত্রতত্র অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে মামলাগুলো ভ্যাকেট করতে নদী রক্ষা এবং ইলিশ রক্ষার জন্য আমরা মন্ত্রি পরিষদ বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়কে বিষয়গুলো জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ও বিভিন্ন দফতরের দেয়া চিঠির প্রেক্ষিতে চাঁদপুর জেলার পদ্মা-মেঘনা নদীর অংশে নাব্যতা রক্ষা, ইলিশের অভয়াশ্রম রক্ষা, নদী ভাঙনরোধসহ নদীর সম্পদ রক্ষায় এবং সরকারি রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে এ সংক্রান্ত মহামান্য উচ্চ আদালতের রীট পিটিশন নং ৭৫৪৫/২০১৫, সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল মামলা নং ৮৭৫/২০১৬ এবং সিভিল রিভিউ পিটিশন নং ৫৯৩/২০১৬ এর আদেশ সমূহ ভ্যাকেট করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
জেলা প্রশাসক বলেন, নদী থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হলে মামলাগুলো ভ্যাকেট করতে হবে। আমাদের চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে ভূমি মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে তদন্তের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, চাঁদপুর নদী অঞ্চল থেকে গত কয়েক বছর ধরেই অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করছে একটি চক্র। এর ফলে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও নদীভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশ সম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
নদীভাঙন ঠেকাতে বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর ও স্থানীয়রা বিরোধিতা করলেও বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে প্রভাবশালী ওই চক্রটি। সর্বশেষ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বালু উত্তোলনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এক পর্যায়ে জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিআইডব্লিউটিএ’র তথ্য মতে চাঁদপুরের নদী থেকে যে প্রক্রিয়ায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তা সঠিক হচ্ছে না। এতে নদীর ক্ষতি হচ্ছে এবং নদীর জীববৈচিত্র্যেরও ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া আমাদের দিক থেকে বলা হয়েছে, এ প্রক্রিয়ায় বালু উত্তোলনের ফলে সরকার কোনও রাজস্ব পাচ্ছে না। সেলিম খান নামে এক ব্যক্তি আদালতে মামলা করে ২০১৫ সাল থেকে বালু উত্তোলন করছেন। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘একদিকে চার হাজার কোটি টাকার শহররক্ষা বাঁধ করার পরিকল্পনা, অপরদিকে মেঘনায় যত্রতত্র অবৈধ বালু উত্তোলন-এ দুটি একসঙ্গে চলতে পারে না। ২০১৫ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মেঘনার বালু উত্তোলনে সরকারের এক টাকাও লাভ হয়নি বরং ডুবোচর খননের নামে শতাধিক ড্রেজারের মাধ্যমে এলোমেলোভাবে বালু উত্তোলনের কারণে মেঘনার দুই পাড় ভাঙনের শিকার হচ্ছে। এ বালু উত্তোলন বন্ধ এবং নদী ও ইলিশ রক্ষায় যা যা করণীয় তা প্রশাসন করবে।’
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম রেফাত জামিল বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে বালু উত্তোলন করছে তা তারা বৈজ্ঞানিকভাবে তুলছে না। তারা চাহিদাভিত্তিক বালু তুলছে। যেখানে বালু পাচ্ছে সেখান থেকেই তারা বালু তুলছে। নদীর গতিপথ আছে। এই গতিপথের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কোথায় পানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং সেসব জায়গায় যদি ডুবোচর থাকে এবং কতটুকু গভীরতায় যেতে হবে সেটি একটি স্তরের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু যারা বালু উত্তোলন করছে তারা সেটি মানছে না। তারা যেভাবে বালু উত্তোলন করছে তা নদীর জন্য ক্ষতিকর এবং ভাঙনের জন্য দায়ী।’
বিআইডব্লিউটিএ’র উপপরিচালক কায়সারুল ইসলাম বলেন, ‘নদী ড্রেজিংয়ের নামে তৃতীয় পক্ষ যেভাবে বালু উত্তোলন করে সেটি নদীর জন্য ভালো না।
এর কয়েকদিন পর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুরে জাটকা নিধন প্রতিরোধে জেলা টাস্কফোর্স কমিটির সভায় ইলিশ গবেষকসহ সংশ্লিষ্টরা নদীতে শত শত ড্রেজার দিয়ে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে ইলিশ সম্পদসহ মাছের ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মার্চ-এপ্রিল জাটকা রক্ষায় দু’ মাস নদীতে বালু উত্তোলন বন্ধ থাকবে। পরে এ বিষয়ে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হারুনর রশিদ একটি চিঠিও দেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, চাঁদপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদীতে ড্রেজারের মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এ নদী থেকে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ডুবোচর খননের নামে সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে এ কাজটি দীর্ঘ দিন করে যাচ্ছে। ফলে ইলিশের বৃহত্তম বিচরণ ক্ষেত্র ও অভয়াশ্রম (ষাটনল হতে চর আলেকজান্ডার) নষ্টসহ নদীর জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, মেঘনা নদীতে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের ফলে প্রধান প্রজনন মৌসুমে চাঁদপুর অংশে ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ সাম্প্রতিক সময়ে মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে শত শত ড্রেজারের প্রপেলারের আঘাতে, নির্গত পোড়া মবিল ও তেলের কারণে মাছের প্রধান প্রাকৃতিক খাদ্য নদীর প্লাংটন আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এছাড়া বালু উত্তোলনে নদী দূষণসহ নদীগর্ভের গঠন প্রক্রিয়া পাল্টে যাওয়ার ফলে বাসস্থানের বাস্তুতন্ত্রও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে তাদের আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে তেমনি ইলিশসহ অন্যান্য মাছের খাদ্যের উৎস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে মাছের বিচরণ ও প্রজনন পাল্টে যাওয়াসহ ইলিশের উৎপাদন মেঘনা নদীতে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জাতীয় মাছ ইলিশকে রক্ষা এবং আবাসস্থল নিরাপদ করতে প্রধান প্রজনন ও বিচরণ মৌসুমে মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধসহ ড্রেজারগুলো স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply