‘চাঁদপুরের বালুসন্ত্রাসীদের বিতাড়িত করা নদী ও পরিবেশ রক্ষার ইতিহাসে বিরাট বিজয়’

বালু সন্ত্রাসীরা জেলে যাবে : নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী
চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারী ‘বালুসন্ত্রাসীরা’ কারাগারে যাবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। সেই সাথে চাঁদপুরের নদী অঞ্চল থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিতাড়িত করতে পারার বিষয়টিকে বাংলাদেশের নদী রক্ষা ও পরিবেশের ইতিহাসে একটা বিরাট বিজয় হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।
৩১ মার্চ বৃহস্পতিবার চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত পদ্মা-মেঘনা নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন এবং নদীর ইকোলজি, জীববৈচিত্র্য, ইলিশের উৎপাদন ইত্যাদি বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। এছাড়া সভায় অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বালু উত্তোলনের কারণে ক্ষতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।


নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, চাঁদপুরের নদীর যে চিত্র ২০ মার্চ দেখানো হয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল মেঘনায় একটা নৌযুদ্ধ হচ্ছে। এতো ড্রেজার, এতো বাল্কহেড মেঘনার বুক ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। তাই আমি দেখতে এসেছি এখন কি অবস্থা। আমি নদী ঘুরে সত্যি আনন্দিত। এখানের জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা সততা ও সাহসিকতার সাথে তাদেরকে বিতাড়িত করেছে এ কয়েকদিনে। আমি জানলাম, যারা বালুসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তাদেরকে মামলাসহ বিভিন্ন হুমকি দেয়া হচ্ছে। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, কোন বালু সন্ত্রাসীর হাতে একটি নদী খুন হতে পারে না।


ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী আরো বলেন, চাঁদপুর সদরে মেঘনা নদীর ১২টি মৌজার মধ্যে ৭টির অস্তিত্ব বিলিন হয়ে গেছে। তারা যে হাইড্রোগ্রাফি জরিপ করেছে তা সঠিক নেই। তিনি বলেন, বালু উত্তোলনকারীরা হাইকোর্টে আদেশ অমান্য করেছে। আদালত তাদেরকে ড্রেজিংয়ের অনুমতি দিলেও বালু বিক্রির কোন অনুমতি দেয়নি। কিন্তু তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে বালু কেটেছে এবং বিক্রি করেছে। যে পরিমাণ বালু উত্তোলন করার কথা তার চেয়ে বহু গুণ বেশি বালু উত্তোলন করেছে।
তিনি আরও বলেন, শোনা যাচ্ছে তারা ঈদের পর আবার নদীতে ফিরে আসবে। বালু সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্যে বলছি, খুব সম্ভব তারা জেলে যাবে। তাদের স্থান হতে পারে কেরানিগঞ্জ অথবা কাশিমপুর কারাগার। পদ্মা-মেঘনার বুক ছিড়ে নেয়ার সুযোগ তাদেরকে আর দেয়া হবে না। তারা যদি আবার আসে আমরাও আবার আসবো। সুতরাং তারা এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, চুরি-চামারি অন্য জায়গা পারলে করুক। কিন্তু এই মেঘনার বুকে আর পারবে না। কারণ, এখানে জাতীয় সম্পদ ইলিশের অভয়াশ্রম। ইলিশ ছাড়াও অনেক মাছের স্পনিং গ্রাউন্ড হচ্ছে মেঘনার এই অববাহিকা। এখানে যদি এভাবে শত শত ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হয় তাহলেতো মৎস্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদেরকে বার বার বুঝিয়ে বলা হচ্ছে, আর কত? মাছের খাবারের মধ্যে ৩৭ শতাংশ যদি বালু থাকে। বালু খেয়ে মাছ বড় হতে পারে না। সেজন্য এখন অনেক ইলিশের সাইজ ছোট হয়ে গেছে। জাটকা সাইজের ইলিশের ভেতরে ডিম পাওয়া যাচ্ছে। বালু উত্তোলনের ইফেক্টগুলো দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, নদী থেকে বালু সন্ত্রাসীদের বিতাড়িত করায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারদেরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানাই।
তিনি আরও বলেন, নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশনার পর অভিযানের খবর পেয়ে যখন ২২ মার্চ তিনশ/সাড়ে তিনশ ড্রেজার-বাল্কহেড পালিয়ে যাচ্ছিল সেটি ছিল একটি বিরাট সংবাদ। বাংলাদেশের নদী রক্ষায়, পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা বিরাট বিজয় হয়েছে। সে বিজয় জনগণের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সারা বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু তা জানে না। তার কারণ হচ্ছে, এখানে মাত্র কয়েকজন সংবাদকর্মী আছেন যারা সাহসি এবং সৎ। যারা এই সংবাদটি প্রকাশ করেছেন আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।
চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে বলেন, কারা বালু সন্ত্রাসীদের এ ধরনের অপকর্ম করতে সহায়তা করছে? বালু উত্তোলনের জন্য একজন জনপ্রতিনিধি ১৫টি ডিও লেটার দিয়েছেন। যা আমার সংগ্রহে আছে। কিন্তু কার স্বার্থে?
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, এই কয়েক বছরে বালু উত্তোলনের কারণে কি পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি, নদীর ইকোলজিক্যাল ক্ষতি, পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে, মাছের উৎপাদন কম হয়েছে, সামাজিক ক্ষতি- এসব ক্ষতির একটা হিসাব দিবে বিআইডব্লিউটিএ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ২১ মার্চ ঢাকায় নদী রক্ষা কমিশনের সভায় যে সিদ্ধান্তগুলো হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে খুব একটা অগ্রগতি দেখছি না। আশা করি, ১৪ কার্য দিবসের মধ্যেই আমি এগুলো পাবো। তা না হলে আমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।
এদিকে এই সভায় পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ অনেক কর্মকর্তার বক্তব্য। এই বক্তব্যের মধ্যে বিআইডব্লিটিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, নদীর নাব্যতার কথা বলে যারা ড্রেজিং করেন সেটি ঠিক নয়। কারণ, যে নাব্যতা রয়েছে তার জন্য ড্রেজিং দরকার হয় না।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের উপ-পরিচালক (প্রশাসন ও পরীবীক্ষণ ) মো. আক্তারুজ্জামান তালুকদার, পুলিশ সুপার মো. মিলন মাহমুদ, চাঁদপুর নৌ পুলিশের পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান, উপ-পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) ড. খ.ম কবিরুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রাণি বিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি ও মাউশির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর খান হাবিবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম
এর আগে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী চাঁদপুরের নদী অঞ্চল ঘুরে দেখেন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply