চাঁদপুর মেঘনায় অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়ার নির্দেশ দিলেন সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান
চাঁদপুর প্রতিদিন রিপোর্ট :
চাঁদপুরের নদী রক্ষা, মেঘনার ভাঙন প্রতিরোধ, ইলিশ সম্পদ রক্ষা এবং যত্রতত্র অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের বিষয়ে এবার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়ার নির্দেশনা দিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ণ বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান। ২৭ ফেব্রæয়ারি চাঁদপুর জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়ার পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, জেলা প্রশাসক, বিআইডাবিøউটিএর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বক্তব্য শুনে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়ার নির্দেশনা দেন সচিব। এছাড়া সভায় অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার বিষেয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সচিব বলেন, নদীতে গবেষণা করে পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং হওয়া উচিত। যে পদ্ধতিতে ড্রেজিং হচ্ছে তা মোটেই কাম্য নয়। দরকার হলে ড্রেজিং হতে হবে পরিকল্পিত।
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম রেফাত জামিল বলেন, আইএমইডির সাথে কথা হয়েছে আমাদের কথা হয়েছে প্রজেক্টের অগ্রগতি নিয়ে। এছাড়া বালু উত্তোলনের বিষয়েও কথা হয়েছে।
তিনি বলেন, চাঁদপুরের নদী থেকে যে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে আমাদের কোন ডিপার্টমেন্টেরই অনুমতি নেই। তারা আদালতের আদেশবলে বালু উত্তোলন করছে। কিন্তু এভাবে অপরিকল্পিত বালুু উত্তোলনের কারণে আমাদের নদীর জীব বৈচিত্র এবং পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে। নদী ভাঙনরোধ করা যাচ্ছে না। এগুলো কিভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা যার যার মতামত দিয়েছি। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে- কোন ডিপার্টমেন্টই এভাবে অপরিকল্পিত বালু কাটার পক্ষে না।
আমাদের কথা শুনে সচিব মহোদয় বলেছেন, মহামান্য হাইকোর্টের যে আদেশবলে তারা বালু কাটছে সেটিকে প্রটেস্ট করার নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই সাথে বিষয়টি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নজরে আনার কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, সভায় আমার বক্তব্য ছিল, এখানে যারা বালু উত্তোলন করছে তারা অপরিকল্পিতভাবে করছে। তাদের মুনাফা লাভের জন্য যেখানে তারা বালু পাচ্ছে সেখানে অধিক মাত্রায় খনন করছে। যেখানে ডুবোচর অপসারণ করা দরকার সেখানে কোয়ালিটি সম্পন্ন বালু পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় তাদের ইচ্ছেমত বালু কাটছে। এ কাজে তারা যে ধরনের ড্রেজার ব্যবহার করছে এটি আসলে ক্ষতিকর। এ ধরনের ড্রেজার ব্যবহারের ফলে নদীতে অসম প্রবাহের সৃষ্টি হয় এবং এটি নদী ভাঙনের জন্য দায়ি। তিনি বলেন, এখানে হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভের মাধ্যমে আইডেন্টিফাই করতে হবে- কোন কোন জায়গায় ডুবোচর রয়েছে। এরপর দেখতে হবে এটি কত লেন্থে, কত গভীরতম এবং কত প্রশ্বস্ততায় কাটতে হবে। পরে নকশা প্রণয়ন করতে হবে- এ ধরনের বেশ কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে।
যারা বালু উত্তোলন করবে তাদের অর্থায়নেই যদি সার্ভে হয় তাহলে সেটি কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি আমি বুঝতে পারছি না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের যে সার্ভেগুলো হয় সেগুলোর জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করে সার্ভেটি আমরা করি। এ কাজের জন্য টাকা খরচ আমরাই করি। তাই এ বিষয়ে বিআইডাবিøউটিএ বিস্তারিত বলতে পারবে।
তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড মতামত দিয়েছে- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ড্রেজিং করলে নদীর জীব বৈচিত্র রক্ষা হয় না। তারা নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য যেখানে বালু পায় সেখান থেকেই তোলে। এতে নদীর নব্যতা রক্ষার যে ড্রেজিং সেটি হয় না।
চাঁদপুর বিআইডাবিøউটিএ বন্দর কর্মকর্তা কায়সারুল ইসলাম বলেন, সভায় আমাদের বক্তব্য ছিল নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু-মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে করে ইলিশ এবং নদীর জীব বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য আগামী দুই মাস বালু উত্তোলন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া এবং এ বিষয়ে মামলা কনটেস্ট করার নির্দেশনা দিয়েছেন সচিব মহোদয়। তিনি বলেন, বালু উত্তোলনের অনুমতি কেউই দেয়নি। আদালতের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে এটি হচ্ছে। তিনি বলেন, নদী রক্ষা কমিটি, বালু মহালসহ অন্যান্য কমিটিগুলোর সভাপতি জেলা প্রশাসক মহোদয়। স্বাভাবিকভাবেই তিনি এসব বিষয়ে উদ্যোগ নিবেন এবং আমরা তার সাথে থাকবো।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মৎস্য গবেষক ড. মো. হারুনর রশিদ বলেন, নদীর নাব্যতা রক্ষায় ড্রেজিং করলেও সেটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে এতো পরিমাণ ড্রেজারের মাধ্যমে ড্রেজিংয়ের কারণে ইলিশের ক্ষতি হচ্ছে এবং নদীতে মাছের খাদ্য সংকট হচ্ছে। এছাড়া এর আগে নদীর জীব বৈচিত্র ও ইলিশ রক্ষায় যে চিঠি দিয়েছেন সেটি সঠিক এবং তা পরিবর্তনের কোন কথা কারো কাছে বলেননি বলে সভাকে জানান।


এদিকে জেল প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, মৎস্য গবেষক, বিআইডাবিøটিএ, নৌপুলিশের কর্মকর্তাদের মতামতের ভিত্তিতে নদী রক্ষা এবং ইলিশ সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা এ বিষয়ে নদী রক্ষা কমিশন, কেবিনেট ডিভিশন, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রেরণ করবো। সভায় এটি সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, মিটিংয়ের একপর্যায়ে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ণ বিভাগের সচিব স্যার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর বক্তব্য শুনে সচিব স্যার বলেছেন, নদীতে গবেষণা করে পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং হওয়া উচিত। যে পদ্ধতিতে ড্রেজিং হচ্ছে তা মোটেই কাম্য নয়। তাই অপরিকল্পিত ড্রেজিং বন্ধের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, চাঁদপুর নদী অঞ্চল থেকে গত কয়েক বছর ধরেই অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করছে একটি চক্র। এর ফলে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করেও নদীভাঙন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশ সম্পদসহ নদীর জীববৈচিত্র্য। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
ইলিশ সম্পদ ও নদীর জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় গত ২৪ ফেব্রæয়ারি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হারুনর রশিদ চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, চাঁদপুরের উপর দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদীতে ড্রেজারের মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এ নদী থেকে স্থানীয় কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ডুবোচর খননের নামে সরকারি বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে এ কাজটি দীর্ঘ দিন করে যাচ্ছে। এর ফলে ইলিশের বৃহত্তম বিচরণ ক্ষেত্র ও অভয়াশ্রম (ষাটনল হতে চর আলেকজান্ডার) নষ্টসহ নদীর জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, মেঘনা নদীতে অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের ফলে প্রধান প্রজনন মৌসুমে চাঁদপুর অংশে ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ সাম্প্রতিক সময়ে মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়- অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে শত শত ড্রেজারের প্রপেলারের আঘাতে, নির্গত পোড়া মবিল ও তেলের কারণে মাছের প্রধান প্রাকৃতিক খাদ্য নদীর প্লাংটন আশংকাজনক হারে কমে গেছে। এছাড়া বালু উত্তোলনে নদী দূষণসহ নদীগর্ভের গঠন প্রক্রিয়া পাল্টে যাওয়ার ফলে বাসস্থানের বাস্তুতন্ত্রও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের এ ধরনের পরিবর্তনের ফলে তাদের আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে তেমনি ইলিশসহ অন্যান্য মাছের খাদ্যের উৎস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে মাছের বিচরণ ও প্রজনন পাল্টে যাওয়াসহ ইলিশের উৎপাদন মেঘনা নদীতে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জাতীয় মাছ ইলিশকে রক্ষা এবং এর আবাসস্থল নিরাপদ করতে প্রধান প্রজনন ও বিচরণ মৌসুমে মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধসহ ড্রেজারগুলো স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply