স্বাধীনতা উত্তর চাঁদপুরের সাহিত্য অঙ্গন

ইলিয়াস ফারুকী ::
একটি জাতির উন্নয়ন এবং উৎকর্ষতা নির্ভর করে তার সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতির উপর। কথাটি সর্বজন বিদীত। সাহিত্যের সর্ববিদিত মূল অংশ কবিতা। স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে কবিতাই ছিল চাঁদপুর সাহিত্য অঙ্গনের প্রধান প্রাণ। কবিতার প্রাধান্য এর একটা প্রধান কারণ উল্লেখ করেছেন দেশের বরেণ্য কবি ও সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ, তিনি কবিতা নিয়ে বলেন “মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে”। কবিতা সবসময়ই যে কোন স্থানের রাজনৈতিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে। চাঁদপুর মফস্বল শহর হলেও রাজধানী থেকে এর দুরত্ব মাত্র কয়েক ঘন্টার। সুতরাং সমসাময়িক যে কোন বিষয়ের প্রভাব অতিদ্রæত এই শহরে পৌঁছে যায়। স্বাধীনতা পূর্বে যেমন বিভিন্ন আন্দোলনের ঢেউয়ের মতোই সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঢেউ দ্রæত প্রভাব বিস্তার করে এই শহরে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় দেশের সব চাইতে আধুনিক ও দ্রোহী কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার উপলদ্ধি দিয়ে বলেছেন “রাজনীতিহীন সাহিত্য চর্চা কপটতা ছাড়া আর কী”। স্বাধীনতা পূর্ব ও পরের অধিকাংশ সাহিত্যে রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা ছিল অপরিহার্য চাঁদপুরও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এ প্রসঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানও আহŸান করেছিলেন ”দেশের সাধারন মানুষ যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি-কান্না সুখ দুঃখকে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির উপহার করার জন্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি সেবীদের প্রতি আহŸান জানাচ্ছি”। চাঁদপুরের সাহিত্য্ঙ্গনও এই ধারার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। স্বাধীনতা উত্তরকালে চাঁদপুরের কৃতি সন্তান গীতিকার ও কবি মোখলেছুর রহমান মুকুল লিখলেন তার বিখ্যাত গান “এই বাংলায় এসেছিল দুর্জয় শপথের দিন।” গানটি তখন বার্লিনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শিশু উৎসবে গাওয়া হয়। পরবর্তী সময় তাঁর লেখা এই গান প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই গান ছাড়াও তাঁর লেখা ”স্বাধীনতা এক অন্ধকারের সূর্য জাগানো দিন।” ”আমার পোষা ময়নাটা আরতো কিছু বলেনা, বলে শুধু বাংলাদেশ আমার ঠিকানারে, আমার ঠিকানা”। তিনি আরো লিখলেন, ”আর কোথায় হয়ে মৌন মিছিল, এমন প্রভাত ফেরী”। একই সাথে বলা যায় চাঁদপুরের আর এক কৃতি হরিপদ চন্দের (বুদা) লেখা গান “কেঁদোনা মা কেঁদোনা।”
স্বাধীনতার পূর্বে চাঁদপুর সাহিত্য অঙ্গনে যে কয়জনের অবদান উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন প্রয়াত অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার, (বাংলা বিভাগ চাঁদপুর কলেজ), প্রয়াত অধ্যপক হেলাল উদ্দিন আহমদ (ইংরেজি বিভাগ চাঁদপুর কলেজ), প্রয়াত অধ্যাপক খলিলুর রহমান (১) (বাংলা বিভাগ চাঁদপুর কলেজ), প্রয়াত অধ্যাপক জয়সেন বড়–য়া (বাংলা বিভাগ চাঁদপুর কলেজ), বাবু জীবন কানাই চক্রবতী, কবি ও গীতিকার মোখলেছুর রহমান মুকুল, চারণ কবি সামছুল হক মোল্লা, শেখ নুরুজ্জামান, শাহ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ, সূফী মোশাররফ বাঙালী। স্বাধীনতার পূর্বে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় “অন্যগ্রাম” নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের হতো যার সময়কাল ছিল ১৯৬৬ইং থেকে পরবর্তী বেশ কিছু সময় পর্যন্ত। সেই সময় “হতভম্ব” নামে মোখলেছুর রহমান মুকুলের একটি প্রতিবাদী গল্প এতে ছাপা হয়ে। পরবর্তীতে ১৯৬৯ইং সালের গণআন্দোলনের ঢেউয়ে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়, বিশেষ করে ১৯৭২ইং সাল থেকে ধীরে ধীরে চাঁদপুরের সাহিত্য অঙ্গনে সুবাতাস বইতে শুরু করে। এবং খুব স্বাভাবিক ভাবে কবিতাই হয় তখন চাঁদপুরের সাহিত্যাঙ্গনের প্রধান হাতিয়ার। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মোখলেছুর রহমান মুকুলের কলমেই চাঁদপুরে আধুনিক কবিতার চর্চা শুরু। এই সময় চাঁদপুর সাহিত্য অঙ্গনে বাবু জীবন কানাই চক্রবর্তী, কিশোর কুমার শংকর, কবি ও গীতিকার মোখলেছুর রহমান মুকুল, মনীষা চক্রবর্তী, পার্থ সারথী চক্রবর্তী, হরিপদ চন্দ (বুদা) প্রমুখ বিশিষ্ট কবি ও লিখিয়েরা চাঁদপুরের সাহিত্য অঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। ঠিক তখনই এই ¯্রােতের সাথে ১৯৭২ইং শেষের দিকে এবং ১৯৭৩ইং শুরুর দিকে যুক্ত হতে থাকেন সাহিত্যের নতুন মুখ ইলিয়াস পারভেজ, ফেরদৌস মোবারক, আবুল হোসেন বাঙালী সহ বেশ কিছু সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ কিছু টগবগে তরুণ। সেই সময় চাঁদপুরের সাহিত্য চর্চায় দেয়াল পত্রিকা এক বিশাল ভ‚মিকা পালন করে। দেয়াল পত্রিকা ছাড়াও তখন জাতীয় দিবস কেন্দ্রিক বেশকিছু ছোট কাগজ বের হতো। বিশেষ করে বিজয় দিবস, শহীদ দিবস। তবে অধিকাংশ সাহিত্য পত্রিকা গুলো শহীদ দিবসেই প্রকাশিত হতো। এ সব ছোট কাগজ ওই দিবস পর্যন্ত সীমিত থাকত। তাই সাহিত্য চর্চার সুযোগটাও দিবস ভিত্তিক সিমীত হয়ে যেতো।
চাঁদপুরের সে সময়কে দেয়াল পত্রিকার স্বর্ণ যুগ বলা যায়। ওই সময় দেয়াল পত্রিকার কল্যাণে বেশ কিছু কবি ও সাহিত্যিক বেরিয়ে আসেন। সেই সময় “সূর্যের আলো” “দীপিকা” সহ বিভিন্ন নামে দেয়াল পত্রিকা বের হতো। এক্ষেত্রে চাঁদপুর কলেজ ও জেলা ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র সমিতি, ছাত্রলীগ প্রমুখ ছাত্র সংগঠন গুলো অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছিল। সেই সময় দেয়াল পত্রিকার লেখা নিয়ে প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হতো। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত এমনি একটি দেয়াল পত্রিকার লেখা প্রতিযোগিতায় অন্যান্যর সাথে এই লেখকও পুরস্কৃত হন।
১৯৭৫-৭৬ইং সাল থেকে চাঁদপুরের সাহিত্য অঙ্গনে আরো বেগবান হতে থাকে। এই সময় বেশ কিছু সাহিত্য প্রেমীরা তাদের প্রতিভা বিকাশ করতে থাকেন। এদের মধ্যে যাদের নাম প্রথম সারিতে চলে আসে তারা হলেন। অধ্যাপক খলিলুর রহমান (২) (বাংলা বিভাগ চাঁদপুর কলেজ), প্রবন্ধিক অধ্যাপক কাজি আকবর হোসেন, মামুন মোরশেদ, হারুন-অর-রশিদ, ফেরদৌস মোবারক, ইলিয়াস পারভেজ (বর্তমানে ইলিয়াস ফারুকী নামে লেখালেখি করছেন) মাহবুব আনোয়ার বাবলু, মহিবুল আহসান আল মাঝি, আব্দুর রহিম, মাহবুবুর রহমান সেলিম, আহমেদ বাবলু, এলিজা পারভিন পারুল, চিরঞ্জিত দাস বিষ্ণু, মোহাম্মদ জিকরুল হাসান বাবুল, সম্ভু আচার্যী মান্না, ডেভিড বি আর সকরার, সিদ্দিকুর রহমান বাবুল, তাজুল ইসলাম ফিরোজী, সাহাবুদ্দিন অনু, জাফর-আল-হাবিব, সেলিম রেজা, ফারুক হাসান, মাসুদা বেগম (অধ্যপিকা, বাংলা বিভাগ, চাঁদপুর মহিলা কলেজ), প্রাবন্ধিক সুরাইয়া আকতার। ১৯৮২ইং সালে সুরাইয়া আকতার এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ে ছড়া সংকলন ”জল পড়ে পাতা নড়ে”। তখন এই সকল কবি লেখকরা মূলতঃ ১৯৭৮ইং সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেয়াল পত্রিকা এবং বিভিন্ন জাতীয় সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোতে তাদের লেখালেখি চালিয়ে যান। সে সময় বিচ্ছিন্ন ভাবে দু’একটি ছোট কাগজ বের হলেও তা নিয়মিত ছিল না। কিন্তু ওই সময়টাতে চাঁদপুরের দুটো সপ্তাহিক পত্রিকা এই সকল লেখিয়েদের সাথে সব সময় সঙ্গ দিয়েছিল। এই পত্রিকা দুটো একটি ছিল মিয়া মোহাম্মদ আব্দুল খালেক এর “চাঁদপুর বার্তা” এবং মাঞমুদ সেলিম রেজার “রক্তিম সূর্য”। পত্রিকাগুলো সাপ্তাহিক হলেও বিশেষ বিশেষ দিনে কবিতার জন্য একটি পুরো পাতা বরাদ্দ থাকতো। চাঁদপুরে সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই দুটো পত্রিকার ভ‚মিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও শ্রদ্ধেয় সামছুল হকের “রক্তিম আভার” কথা উল্লেখ করা যায়।
১৯৭৯ইং সাল থেকে বেশ কয়েকজন যুবকের অক্লান্ত পরিশ্রমে চাঁদপুরে প্রকাশ হতে শুরু করে ছোট কাগজ সংকলন। মূলত প্রথম দিকে ওগুলো কবিতা পত্র হিসাবেই প্রকাশ করা হতো। এই কবিতা পত্রগুলোর মধ্যে একটি ছিল “উঠোন” যার সম্পাদক ছিলেন হারুন-অর-রশিদ এবং প্রকাশক ছিলেন ইলিয়াস পারভেজ (বর্তমানে ইলিয়াস ফারুকী)। এই সংখ্যায় স্থানীয়রা সহ জাতীয় পর্যায়ের বেশ অনেকেই তাদের লেখা দিয়ে ছিলেন। সেই সময়ের সব চাইতে খ্যাতিমান কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, জাফর ওয়াজেদ, লাল চাঁন প্রমুখের লেখাও এতে স্থান পায়। কিন্ত ওই এক সংখ্যার পরে “উঠোন” আর প্রকাশিত হতে পারে নাই। এর পরেই ইলিয়াস পারভেজ এর সম্পাদনায় এবং অজিত কুমার মুকুলের প্রকাশনায় প্রকাশিত হয় “জিগীষা”। এই ছোট কাগজের প্রথম সংখ্যা কবিতা পত্র হিসেবে থাকলেও দ্বিতীয় সংখ্যায় এতে একটি ছোট গল্প সংকলিত হয়। যার লেখক ছিলেন মহিবুল আহসান আলমাঝি। “জিগীষা” অনিয়মিত ভাবে তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রায় সেই একই সময়ে ফেরদৌস মোবারক ও মহিবুল আহসান আল মাঝির যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশ হতে থাকে “রানার” নামে একটি ছোট কাগজ। “রানার” অনিয়মিত ভাবে চারটি সংখ্যা প্রকাশ করে। ১৯৭৮-৭৯এর দিকে সে সময় আরো বেশ কিছু প্রতিশ্রæতিশীল লেখক/কবি উঠে আসেন এদের মধ্যে তিনজনের কথা উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন কবি মিনু আহমেদ, কবি দিলিপ মালাকার, কবি মোর্শেদা খানম বেবী যিনি বর্তমানে মোর্শেদা নাসির নামে জাতীয় লেখিকা সংঘের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন, প্রণব কুমার মাজুমদার তিনি বর্তমানে স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক, কবি, প্রত্রিকা সম্পাদক এবং জিয়াউল আহসান টিটু । সম্ভবত ১৯৮৫ইং কবি মোর্শেদা খানম বেবী (মোর্শেদা নাসির) তিনি স্বাধীনতা উত্তর তাঁর কবিতা সমুহ গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করেন “বিবসনা হৃদয়” শিরোনামে। অবশ্য এর আগে স্বাধীনতা উত্তর চাঁদপুরে প্রথম কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ পায় মোখলেছুর রহমান মুকুলের “এক মুঠো রৌদ্র চ‚র্ণ” (১৯৭৪ইং)।
১৯৭৯ইং এর দিকে প্রথম ফেরদৌস মোবারক, আবুল হোসেন বাঙালী এবং আবুল হোসেন জোড় পুকুর পাড়ে প্রথম চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমির স্বপ্ন দেখেন এবং মুখে মুখে এর প্রচার চলতে থাকে। সম্ভবত প্রস্তাবিত চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে প্রথম আনুষ্ঠানিক সভা অনুষ্ঠিত হয় “মোহনা” সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন মজুমদার সাহেবের তালতলার ’কবি ভবন’ বাসায়। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে অধ্যাপক খোরশেদুল ইসলাম, অধ্যাপক জাকির হোসেন মজুমদার, আবুল হোসেন বাঙালী, কাজী সাহাদৎ হোসেন, মোর্শেদা খানম বেবী (বর্তমানে মোর্শেদা নাসির)। তৎকালীন চাঁদপুরের ডি.সি জনাব এস.এম সামছুল আলম সাহেব এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। এবং পরবর্তীতে তারই প্রচেষ্টায় ৬ই মে ১৯৮৭ইং সালে জোড় পুকুর পাড়ে চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়।
১৯৮২ইং সালের চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন সঙ্গীত নিকেতন সপ্তাহ ব্যাপি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেই উপলক্ষে ”ঐকতান” নামে একটি স্মরনিকা বের হয় যার সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত অজিত কুমার মুকুল এবং সহকারী সম্পাদক হিসেবে হরিপদ চন্দ (বুদা) ও মামুন মোরশেদ দায়িত্ব পালন করেন।
বর্তমান সময়ে জাতীয় পর্যায়ের গীতিকার কবি কবির বকুল ১৯৮৭ইং সালে চাঁদপুরের সাহিত্য জগতে প্রতিবাদী কন্ঠ হয়ে উঠেন তাঁর “আমি বিদ্রোহী বলছি” কবিতা গ্রন্থের মাধ্যমে। মূলতঃ যা ছিল স্বৈরশাসক বিরোধী লেখা। আরো একজন গানের ব্যক্তিত্ব মিলন খান স্বনামে খ্যাত চাঁদপুরের আর এক মুখ উজ্জল করা সন্তান এবং একজন গীতিকবি তিনি ”ময়না” ”পাথর কালো রাত” প্রমুখ জনপ্রিয় গানসহ শতাধিক সফল গানের রচয়িতা। ফেরদৌস মোবারক ১৯৮৭ইং সালে ”উত্তরকাল” নামে একটি ছোট কাগজ সম্পাদনা করেন। পরবর্তীতে যার তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। এই সময় খোকন দাস ও খিজির আহমেদ রনির কবিতা চাঁদপুরের সাহিত্য আকাশে বেশ পরিচিত ছিল।
১৯৭৯ইং সালের দিকে তৎকালীন সময় ইলিয়াস পারভেজ এর সম্পাদিত সাইক্লোস্টাইল কবিতা পত্র “সপ্তর্ষি” এবং আহমেদ বাবলু সম্পাদিত আরো একটি সাইক্লোস্টাইল কবিতা পত্র বের হতো। (দুঃখিত যার নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না।)
১৯৭৯ইং বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব নাজমুল আহসান নিজাম সম্পাদিত ”জাগ্রত বাংলা” নামে একটি ছোট কাগজ বের হয়ে। যদিও এর পূর্বে তিনি ”বিস্ফোরণ” নামে ১৯৭৬-৭৭ইং সালে আরো একটি ছোট কাগজ বের করে ছিলেন যার সম্পাদকীয়তে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা থাকায় তৎকালীন ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব ডি.কে চৌধুরী এটার প্রকাশনা আটকে দিয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে (তৎকালীন প্রশাসনের কড়াকড়িতে) বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দেয়ার শর্তে তা প্রকাশের ছাড় পত্র পায়।
তখন চাঁদপুরের সাহিত্যে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধের পাশাপাশি নাটক লেখার চর্চাও ছিল নিয়মিত বিষয়। এ ক্ষেত্রে অগ্রনী ভুমিকায় ছিলেন মহসীন কায়েস, অজিত কুমার মুকুল, সিদ্দিকুর রহমান বাবুল প্রমুখ। এদের মধ্যে মহসীন কয়েসের রচনা “অনিয়ম বারে বারে” (১৯৮০ইং) “অজ্ঞাতবাস” (১৯৯০ইং) এবং “মধ্য রাতের তক্ষক” ”ধোঁয়াশা আকাশ” অজিত কুমার মুকুলের লেখা। ”এখানেই শেষ না” “প্রতিরোধ” এবং “অবক্ষয়” এর মতো নাটকও ছিল। মহসীন কায়েসের নাটক “বসন্ত শেষে” ১৩/০১/২০০১ইং তে বিটিভিতে প্রচারিত হয়। এবং “অনিয়ম বারে বারে” ২০১০ইং সালে একুশে টিভিতে প্রচারিত হয়।
স্বাধীনতা উত্তর চাঁদপুরে দুটো নাট্যগোষ্ঠির সুনাম বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। যার একটি “বর্ণচোরা নাট্যগোষ্ঠি” (১৯৭৮ইং) অন্যটি “অনন্যা নাট্যগোষ্ঠি” এ দুটো নাট্য দলেরই নিজস্ব নাট্য রচয়িতা ছিল। বর্ণচোরা নাট্যগোষ্ঠি তাদের নাট্যদলের সদস্য মহসীন কায়েসের লেখা “অনিয়ম বারে বারে” নাটকটি মঞ্চস্থ করে এবং জাতীয় নাট্য উৎসবে এই দল “নিহত সংলাপ” মঞ্চস্থ করে শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে পুরস্কৃত হয়ে। এই নাটকের নির্দেশক অভিনেতা মহসীন কায়েস শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার পান এবং এই নাটকে অভিনেত্রী ভারতী মন্ডল হন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী।
যে মাটিতে জন্মে ছিলেন সওগাত সম্পাদক মোঃ নাসির উদ্দিন, দৃষ্টিপাতের লেখক যাযাবর (বিনয় ভ’ষণ মুখোপধ্যায়), কবি ইদ্রিস মিয়ার মতো লোক এবং ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এবং আরো অনেকে। সেই পদ্মা, মেঘনা, ডাকাতিয়া, বিধৌত মাটিতে সাহিত্য মিইয়ে যাবে তা কী করে হয়ে? বর্তমানে আরো এক ঝাঁক তরুন, যুবা সাহিত্যিক/কবি প্রতিনিয়ত চাঁদপুরের মুখ উজ্জল করে চলেছেন তাদের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। এদের মধ্যে মাঈনুল ইসলাম মানিক, আশিক বিন রহীম। এরা দুজন চাঁদপুর থেকে ২০১৯ইং সালে নয়াদিল্লিতে সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন। এদের সমসাময়িক আরো একজন জেমকন তরুন সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত কবি ও গল্পকার রফিকুজ্জামান রনির নামও উল্লেখযোগ্য। এরা ছাড়াও বর্তমানে চাঁদপুরে আরো অনেক প্রতিভাবান কবি ও সাহিত্যিক প্রতিনিয়ত লিখে যাচ্ছেন।
কৈফিয়ৎ : আমার এই লেখা অনেকটা আমার স্মৃতি থেকে লেখা। অজান্তে এ লেখায় যদি কোন তথ্যের ভুল থাকে সে জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী। তথ্য সরবরাহ করলে আমি তা সংশোধন করে নেব। এ লেখা নিয়ে যদি কেউ আমাকে তথ্য সরবরাহ করেন তা কৃতজ্ঞতা সহ গ্রহন করে পরবর্তীতে সংযোজন করব। এই লেখা তৈরীতে আমাকে বিভিন্ন ভাবে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন জনাব মোখলেছুর রহমান মুকুল, নাজমুল আহসান নিজাম, মামুন মোরশেদ, মোর্শেদা নাসির এবং প্রণব কুমার মজুমদার। আমি এঁদের সকলের নিকট কৃতজ্ঞ।
-ইলিয়াস ফারুকী, লেখক ও কবি

শেয়ার করুন

Leave a Reply