৩০ সেপ্টেম্বর : জাতীয় কন্যা শিশু দিবস

মারুফা সুলতানা খান হীরামনি :
লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে কন্যা শিশুদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আরও বেশি সোচ্চার হওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে “জাতীয় কন্যা শিশু দিবস” ঘোষণা করেন। প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি উদযাপিত হয়। যদিও করোনা পরিস্থিতে স্বাভাবিক সব কিছুতেই কিছুটা পরিবর্তন এসেছে তবুও এই পরিবর্তিত অবস্থাতেই জাতীয় কন্যা শিশু দিবস উদযাপন করা হবে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য “আমরা সবাই সোচ্চার, বিশ্ব হবে সমতার“।


শিশুরা সব সময়ই জাতির ভবিষ্যতকে ধারণ করে থাকে, হউক সে কন্যা শিশু বা পুত্র শিশু। তবে একটি জাতির উন্নতি তখনই সম্ভব যখন কন্যা ও পুত্র উভয়ই সমঅধিকার পায়। তাই ২০২০ সালের জাতীয় কন্যা শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য অন্যান্য বছরের মতো এবারও যথার্থ। বাংলাদেশ সরকার কন্যা শিশুদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে যথাযথ গুরুত্বসহকারে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন ও তা বাস্তবায়ন করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেয়েদেরকে একটু বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে যাতে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে ছেলে ও মেয়েদের অনুপাত সমান থাকে। এই বাড়তি সুযোগ নিয়ে কিছু মহল নানান কথা বলেন, তবে এটা তাদের জেনে রাখা প্রয়োজন যে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার না দিলে সমতা আনা অসম্ভব। তাই সমতা সৃষ্টির জন্য সোচ্চার হয়ে যা যা করণীয় তাই করে যেতে হবে।


বাংলাদেশ সরকার শিশুদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে “জাতীয় শিশু নীতি, ২০১১” প্রণয়ন করেছেন। শিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় সকল উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ, কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও বাজেট প্রনয়ণের ক্ষেত্রে জাতীয় শিশু নীতি, ২০১১ প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্ব সহকারে ব্যবহার করা হয়। শিশু নীতি অনুসারে শিশু বলতে আঠারো বছরের কম বয়সী সকল ব্যাক্তিকে বুঝায়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু যার ৪৮ শতাংশই কন্যাশিশু যাদেরকে পিছনে রেখে কখনোই সরকারের রূপকল্প-২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অভিষ্ট : ০৫ এ লিঙ্গ সমতা অবস্থান করছে। অর্থাৎ সমতার ব্যাপারটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। মেয়েদের পুষ্টির চাহিদা, শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা, বৈষম্য দূরীকরণ নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসা, বলপূর্বক বাল্যবিবাহ, ধর্ষণসহ যেসব ঘৃণিত কাজকর্ম রয়েছে সেগুলোর নির্মূল করা ছাড়া উপয়ান্তর নেই। কন্যাশিশুদের সার্বিক উন্নতির জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ গণমাধ্যম কাজ করে যাচ্ছে, এসব কাজকে আরও গতিশীল ও কার্যকর করে তুলতে হবে।


বাংলাদেশ সরকার জাতীয় বাজেটের ২% শিশুদের জন্য বরাদ্দ রাখেন যা কন্যা ও পুত্র সকল শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হয়। তবে সমতা বিধানের লক্ষ্যে সরকার কন্যা শিশুদের জন্য নিয়মিত স্কুল, নিরাপত্তা, স্যানিটারি ব্যবস্থা, খেলাধূলার সুযোগ, হেল্পলাইন, শিশু বিকাশ কেন্দ্র, মাধ্যমিক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাসহ নানা ধরণের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন। তবুও পরিতাপের বিষয় এই যে এখনো কন্যা শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে তারা বিষয়টি চেপে রাখে সমাজে লোকলজ্জার ভয়ে। খুবই পীড়াদায়ক হলেও এটাই সত্য আমাদের সমাজে কেউ ধর্ষিত হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষিতার ছবি ভাইরাল হয়ে যায়, ফলে সেই ধর্ষিত নারীর জীবন আরও দুর্বিসহ হয়ে যায়। যদিও এখন এই বিষয়ে কিছুটা সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো কাজে গভীর রাতে একই বয়সী একটি ছেলে ও মেয়ে যদি রাস্তায় থাকে তখন ছেলেটির ভয় থাকে তার হাতে থাকা মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা ইত্যাদি হারানোর ভয়। বিপরীত দিকে মেয়েটির থাকে সম্ভ্রম হারানোর ভয়। মেয়েদের এই ভয় শিশুকাল থেকে শুরু করে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত থেকে যায়। এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে না বেরুতে পারলে সামগ্রিক উন্নতি অসম্ভব।


কন্যা শিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অভিভাবকদের সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হতে হবে। একটা সময় ছিলো যখন পরিবার থেকেই কন্যা সন্তানদের অবহেলার শুরু হতো, যদিও বর্তমানে এর পরিমাণ কমে গেছে তবে একেবারেই যে পরিবার থেকে মেয়েরা অবহেলিত হচ্ছে না তা বলা যাবে না। প্রচলিত একটি কথা আছে, “যে সন্তানকে তার মা আদর করে না, সে সন্তান অন্য কারোর আদরও পায় না। “তাই যতদিন একটি মেয়ে তার পরিবারে যথোপযুক্ত সম্মান পাবে না, ততদিন সে অন্য কোথাও উপযুক্ত সম্মান পাবে না। একটি মেয়ের গাত্রোবর্ণ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের যেমন উদ্বিগ্নতা থাকে তেমন একটি ছেলের ব্যাপারে থাকে না। সেখান থেকেই শুরু হয় বৈষম্য। আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে মেয়েটি যদি উজ্জ্বল বর্ণের অধিকারী হয় তাহলে তার পরিবার চিন্তা করে মেয়েটিকে সমাজের বাজে লোকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে আবার যদি মেয়েটি অনুজ্জ্বল বর্ণের অধিকারী হয় তখন পরিবারের চিন্তা শুরু হয় ঐ মেয়ের বিয়ে নিয়ে। সবার আগে অভিভাবকদের এই বিষয়টি থেকে বেরিয়ে কন্যা-পুত্র উভয়ের মধ্যে সমতা আনতে হবে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন প্রতিটি মৌলিক অধিকারের বেলায় সমতা আনা জাতীয় উন্নতির জন্য খুবই যুক্তিযুক্ত।

কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে সমতা বিধান করা সম্ভবপর নয়। এক্ষেত্রে সমাজের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। পরিবার থেকেই এই ভূমিকার শুরু। একটি মেয়ে শিশুকে জন্মের পর থেকে তার পোশাক-আশাক, চলা-ফেরা, আচার-আচরণে যে শিক্ষা পরিবার থেকে দেয়া হয় সমহারে একই শিক্ষা পুত্রদেরও দেয়া উচিত। মেয়েদেরকে অতিরিক্ত সতর্ক হতে না শিখিয়ে ছেলেদেরকে এমন শিক্ষা দেয়া উচিত যাতে তারা মেয়েদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেন যেমনটি ছেলেরা মেয়েদের থেকে পান। এক্ষেত্রে সমতা বিধান করা হলেই সমাজে এতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটতো না। মেয়েরা তাদের কাজের জন্য অবাধে বিচরণ করতে পারে না। পরিবার থেকে ছেলেরা চাইলেই যেকোনো জায়গায় যাওয়ার অনুমতি যেভাবে পায়, মেয়েরা পায় না। কারণ, অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকে। এই যে নিরাপত্তার অভাব, সেটা বেশিরভাগই আসে পুরুষশাসিত এই সমাজের পুরুষদের থেকে, তাই মেয়েদেরকে বাধা না দিয়ে ছেলেদেরকে নৈতিক শিক্ষা দেয়া উচিত। বিভিন্ন ধর্মেও মেয়েদেরকে নানাভাবে সম্মানিত করা হয়েছে। তবুও প্রায়শই সেই বিধান মেনে চলা হয় না যা খুবই পীড়াদায়ক।


কন্যা সন্তানদের তাদের অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে, যথাযথ অধিকার আদায় না হলে সেই অধিকার আদায়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি নিজে একজন কন্যাশিশু হিসেবে যথেষ্ট সুবিধা পেয়েছি আমার পিতা-মাতার জন্য। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমার পরিবার আমাকে কিছু সুযোগের অধিকার থেকে বঞ্ছিত করেন নি তা বলা যাবে না। কোথাও ঘুরতে গেলে আমার ছোট ভাই আগে থেকেই আমাকে সাবধান করে দিয়ে কিছু জায়গা এড়িয়ে যেতে বলতো কারণ ওখানে বখাটে ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। সেই হিসেব করে চলতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই আমার রাস্তাটা কিছুটা লম্বা হয়ে যেতো। এভাবেই পথ পাড়ি দিয়ে আজ আমি নিজে দুটি কন্যা সন্তানের জননী। খুব আশ্চর্যজনকভাবে আমার বড় কন্যার জন্ম এই জাতীয় কন্যাশিশু দিবস অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর।


কন্যা শিশু এবং পুত্র শিশু উভয়ই আশীর্বাদ যদি তাদেরকে যথোপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা যায়। সমাজ বদলাচ্ছে ইতিবাচকভাবেই, তবে কিছু নেতিবাচক বিষয় যে নেই সেটা একেবারেই বলা যাবে না। এখনো ছোট ছোট শিশুদের ধর্ষণের খবর যখন পাই তখন মনটা বিষিয়ে উঠে। কবে মুক্তি পাবো আমরা এই অমাবস্যা থেকে ? নৈতিক শিক্ষা খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। পরিবার থেকেই সেই শিক্ষার শুরু করতে হবে, এই দায়িত্ব প্রতিটি সম্মাননীয় অভিভাবকের।
কন্যা ও পুত্র উভয়ের অধিকারে সমতা না আনা পর্যন্ত দেশের সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকার এই সমতা আনয়নের ব্যাপারে যত কর্মপরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছেন সেগুলোতে দেশের প্রতিটি নাগরিকের একাত্বতা খুব জরুরি তাছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগেও সকল বিষয়ে সমতা আনয়নের ব্যাপারে জোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই আমরা উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারবো।
মারুফা সুলতানা খান হীরামনি, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, পরিবেশ অধিদপ্তর, সদর দপ্তর, ঢাকা

শেয়ার করুন

Leave a Reply