‘জ্বীনের বাদশা’ জাকির আটক

কচুয়ার দুই পরিবারের কাছ থেকে ৮০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ
চাঁদপুর প্রতিদিন ডেস্ক :
চাঁদপুরের কচুয়ার দুই পরিবারের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জাকির হোসেন নামের এক কথিত জ্বীনের বাদশাকে আটক করেছে র‌্যাব। এছাড়া প্রতারণার অর্থে তৈরীকৃত বাড়ি শনাক্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় কচুয়া থানায় একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। র‌্যাব-১১ এর উপ-পরিচালক (কোম্পানী অধিনায়ক) মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন শনিবার এ তথ্য জানিয়েছেন।
র‌্যাব জানায়, জনৈক ভুক্তভোগি দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে নিজ বাড়ি চাঁদপুর কচুয়া হতে ছেলে মেয়েদের ভালো পড়াশোনা নিশ্চিতের জন্য ২০১৩ সালে নারায়নগঞ্জে বসবাস শুরু করে। স্বামি প্রবাসী হওয়ায় ২০২০ সালের অক্টোবরে করোনাকালে তাৎক্ষনিক বিভিন্ন সহযোগীতা প্রাপ্তির আশায় জাকির হোসেনের সাথে আনোয়ারা মঞ্জিল ২৫৩/পাইনাআদি, নতুন মহল্লা, আবাসিক এলাকা সিদ্দরগঞ্জ নারায়নগঞ্জের বাসার ৬ষ্ঠ তলায় সাবলেটে উঠেন। সাবলেট প্রতিবেশীর সাথে স্বভাবতই ভাব জমে ওঠে তার৷ সে বছরেরই কোন এক দিন আলাপচারিতার এক পর্যায়ে জনৈক ভুক্তভোগির নিজের একটি শারিরীক ব্যাধির কথা জানান সাবলেট প্রতিবেশী নারীকে। সেই নারী তাকে অভয় দিয়ে বলেন তার কাছে রয়েছে মুশকিল আসানের উপায়। কারণ তার স্বামীই নাকি বিভিন্ন রোগের ঝার ফুঁক করেন! অল্পশিক্ষিত জনৈক ভুক্তভোগি বিষয়টিতে আগ্রহ দেখান। প্রতিবেশী নারীর স্বামী জাকির হোসেনের শরণাপন্ন হন তিনি। কেবল ঝাড়ফুঁকেই তুষ্ট হয়ে জাকিরের প্রতি অগাধ ভক্তি জমে তার। ওদিকে নতুন ভক্ত পেয়ে জাকির খুলে দেয় তার অগাধ শক্তির ডালা। জনৈক ভুক্তভোগিকে সে জানায় তার ওপর ভর করে জ্বীনের মহান বাদশা। ডাকলেই জাকিরের কাছে চলে আসে একের পর এক জ্বীন। আর তাদের মাধ্যমেই অনেক অসাধ্য সাধন ও রোগের চিকিৎসা করেন তিনি৷ জনৈক ভুক্তভোগি এসব জেনে ভক্তিতে শ্রদ্ধায় পুরোপুরি দূর্বল হয়ে পড়েন কথিত জ্বীনের বাদশা জাকিরের ওপর। তাই এবার নিজ মেয়ের একটি সমস্যা নিয়ে আবারও তিনি জাকিরের কাছে যান। তবে জাকির এবার ঝাড়ফুঁক নয়।করতে চান আরো বড় কিছুর আয়োজন। প্রাথমিকভাবে নিজ খরচেই ব্যবস্থা করেন জ্বীন আমন্ত্রণের আয়োজন। কিন্তু প্রথমবার কথিত জ্বীন এসে যা বলে গেলো তাতে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় জনৈক ভুক্তভোগি পরিবারে। আবারো তিনি শরণাপন্ন হন জাকিরের। কারণ তার ধারণা সমস্যার সমাধান না করলে মেয়ের ঘোর বিপদ অবশ্যম্ভাবী। জাকির জানান আবারো তিনি জ্বীনের বাদশাকে ডাকবেন। আবারো আসরের আয়োজন করতে হবে। কিন্তু এবার বিনা খরচে জ্বীনের বাদশা আসবেন না। লাগবে ৫ লক্ষ টাকা। অন্ধভক্ত জনৈক ভুক্তভোগি মেয়েকে বাঁচাতে তাতেই রাজী হয়ে গেলেন। জাকিরের হাতে তুলে দিলেন ৫ লক্ষ টাকা। এবার জাকির আবারো জ্বীনের বাদশাকে আমন্ত্রণের আয়োজন করলো। পূর্ব নির্ধারিতভাবেই ফের জ্বীনের বাদশা জাকিরের শরীরে ভর করলো। এবার জ্বীনের বাদশা জাকিরের মুখ দিয়ে বললো- জনৈক ভুক্তভোগি মেয়ের ওপর ভর করা সেই বদজ্বীনকে পাতিলবন্দী করতে হবে। শুধু তাই নয় জ্বীনের বাদশা আরো জানালো জনৈক ভুক্তভোগি অন্যান্য ছেলেমেয়ের মধ্যেও আরো কয়েকটি ভয়ংকর খন্নাস জ্বীন ভর করে আছে। পাতিলবন্দী করতে হবে তাদেরও! যার জন্য প্রয়োজন তিন মাসের মধ্যে ২৫ লক্ষ টাকা। নয়তো কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো পরিবারকে একে একে মেরে ফেলবে সেসব বদজ্বীনেরা। অন্যদিকে যদি বদজ্বীন বিতাড়িত হয়ে যায় তবে জনৈক ভুক্তভোগি পাবে জীনদের লুকায়ীত গুপ্তধন। সন্তানদের প্রান বাঁচাতে ও গুপ্তধনের লোভে নিজের সকল গহনা, জমানো টাকা ও আত্নীয়দের নিকট হতে ধার করে তিন মাসের মধ্যেই ২৫ লাখ টাকা জাকিরের হাতে তুলে দেন জনৈক ভুক্তভোগি আর বদজ্বীনরাও হয় পাতিলবন্দী। বদজ্বীন বন্দী সেসব মাটির পাতিল নিজ চোখে দেখে বেশ তৃপ্ত হন জনৈক ভুক্তভোগি । এরই মধ্যে জানুয়ারি ২০২১ সালে জনৈক ভুক্তভোগি বাসা পরিবর্তন করে একই এলাকায় সিদ্দিরগঞ্জের পাইনাদি নতুন মহল্লা বাসায় উঠেন।
গত বছরের মার্চ মাসে কচুয়া গ্রামের বাড়ি থেকে জনৈক ভুক্তভোগি বাসায় বেড়াতে আসে তার বোনের মেয়ে। জাকিরের চোখ পড়ে বোনের মেয়ের দিকে। কারণ এবার বোনের মেয়ে ওপরও ভয়ংকর জ্বীনের আছর দেখতে পেয়েছেন তিনি! বিষয়টি তিনি একান্তে জনৈক ভুক্তভোগি ডেকে জানান। বোনের মেয়ের এমন বিপদে আবারো বিমর্ষ হয়ে পড়েন রোমানা। বোনকে জানান তার মেয়ের বিপদের কথা! বোনও আতঁকে ওঠেন এমন আচমকা বিপদসংকেত পেয়ে। তবে এবার জনৈক ভুক্তভোগি তার বোনকে অভয় দিয়ে বললেন মুশকিল আসানের উপায়। জানালেন জাকিরের কেরামতির কথা। তাই রোমানার সেই বোনও এবার শরণাপন্ন হলো জাকিরের। জাকিরের মাধ্যমে কথিত জ্বীনের বাদশা জানালো আবুল খায়েরের ছেলে মেয়েদের ওপর ভয়ংকর জ্বীনের আছর আছে। সেসব জ্বীনকে শীঘ্রই পাতিলবন্দী করতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এসব শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন গ্রাম্য আবুল খায়ের। তবে জ্বীনের বাদশা আশার বাণীও শোনালেন। কৃষক আবুল খায়েরের মধ্যে নাকি জ্বীনের বাদশা এক অলৌকিক চিহ্ন দেখতে পেয়েছে। কিছু সাধনা করলে আবুল খায়ের হয়ে যেতে পারবেন অদৃশ্য জগতের মহা ক্ষমতার অধিকারী। তখন সে যা চাইবে তাই হবে। ছেলে মেয়েদের জীবন বাঁচানোর জন্য ও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য জমানো অর্থ, জমি-জামা বিক্রি ও লোন করে ০৬ মাসে বিভিন্ন ধাপে জাকিরের হাতে তুলে দেন ৫০ লক্ষ টাকা। বিভিন্ন ধাপে টাকা প্রাপ্তিতে জাকির পূর্ব পদ্ধতি অবলম্ভন করে একে একে সব কটি জ্বীনকে পাতিল বন্ধি করে। তবে খায়ের সাহেবের অলৌকিক শক্তি প্রাপ্তির অপেক্ষা শেষ হয় না। এমতাবস্থায় খায়ের সাহেব জাকিরের সাথে যোগাযোগ করলে জাকির জানায় খায়ের সাহেবকে অলৌকিক শক্তির অধিকারী করার জন্য জাকিরকে ১০০টি নদীর পানিতে শুকর ও চিলের হৃদপিন্ড দিয়ে সাধনা করতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন আরও ২০ লক্ষ টাকা। টাকা সংগ্রহের কোন পথ না পেয়ে খায়ের সাহেব এবার বিষয়টি তার বড় ছেলেকে জানায়। আবুল খায়েরের ছেলে বুঝতে পারেন তার পরিবার ভয়ানক প্রতারণার শিকার হয়েছে। এমতাবস্থায় তার ছেলে গত ২২/০১/২০২২ইং তারিখে র‌্যাব-১১ সিপিসি-২ কুমিল্লা ক্যাম্পে ঘটনার বিবরণ দিয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ছায়া তদন্ত শুরু করে র‌্যাব-১১, সিপিসি-২। অত;পর গোয়েন্দা তৎপরতা এবং তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে ২৮ জানুয়ারি রাতে কুমিল্লা জেলার গৌরিপুর বাসস্ট্যান্ড হতে কথিত জ্বীনের বাদশা মোঃ জাকির হোসেনকে আটক করতে সক্ষম হয় র‌্যাব-১১ সিপিসি-২ এর একটি আভিযানিক দল। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার নারায়ন গঞ্জের বাসা হতে কথিত জ্বীন বন্দীর কাজে ব্যবহৃত অসংখ্য মাটির পাতিল তাবিজ কবজ ইত্যাদি উদ্ধার করে র‌্যাব।
র‌্যাব জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাকিরের কাছ থেকে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। মূলত ১৯৯৫ সালে ঢাকা আসেন জাকির এবং দীর্ঘ ৭ বছর বাসের হেলপার হিসেবে কাজ করেন। এরপর বিআরটিএ ও পাসপোর্ট অফিসে দালালের কাজ করতেন। পাশাপাশি চোরাই মোবাইলের কারবারও করতেন মুগদার একটি বাসায় থেকে। ইতোমধ্যে ২০১৫ সালে চাঁদপুরের হাইমচরের নূরজাহানকে বিয়েও করেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারী শুরু হলে তার সকল ব্যবসা বন্ধ হবার উপক্রম হলে সস্তায় সাবলেট বাসা নেন নারায়ণগঞ্জে। বিভিন্ন বই পড়ে এবং মাজারের ফকিরদের দেখে জ্বীন ও ঝাড়ফুঁক সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণা নিয়ে ওঝা সেজে বসেন অষ্টম শ্রেনী পাশ জাকির। কোরআন শরীফ পড়তে না জানলেও আজগুবি সব মন্ত্র বলে ঝাড়ফুঁকের নাটক করতেন। আর বিভিন্ন মাটির পাতিল, প্রাণীর হাড়গোড় ইত্যাদি বস্তু ব্যবহার করে নাটকীয় কারবার করে ভুক্তভোগীদের প্রভাবিত করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। এতোদিন ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বরিশালে ৫ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বানিয়েছেন প্রসাদসম একটি বাড়ি। যার ১ম তলার ভিতর ও বাহির টাইলস করা সহকাজ সম্পন্ন করেছে এই টাকা দিয়ে। এমনকি ১ম ভুক্তভোগীর অজান্তেই তার বড় মেয়েকে জ্বীনের বিভিন্ন কথা বলে প্রভাবিত করে কোন ধরণের কাবিন ও সাক্ষী ছাড়াই গোপনে বিয়ে করেছেন তিনি! যেহেতু তার মূল বাড়ি সম্পর্কে কোন তথ্য ভূক্তভোগীদের নিকট ছিলোনা। তাই বাকি ২০ লক্ষ টাকা আদায় করে সে একে বারে নারায়নগঞ্জ ত্যাগ করে বরিশালে বসবাসের পরিকল্পনা করেছিলো।
উল্লেখ্য, আসামী মোঃ জাকির হোসেনের পিতা-মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ ও মাতা-কোহিনুর বেগম এবং তার স্থায়ী ঠিকানাঃ সলিয়া বাকপুর, বানারী পাড়া, বরিশাল। উক্ত বিষয়ে গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply