বিশ্বকবির জীবন দর্শন
মাহবুবুর রহমান সেলিম :
কবিগুরু বিশ্বখ্যাত অনন্য সাহিত্যে সাধনায় নতুন ধারার উদ্ভাবক। চিত্র রূপময়তা, ঐতিহ্য প্রীতি, বাস্তব চেতনা ও শুদ্ধ জ্ঞান সম্বলিত একজন সুন্দর স্বপ্নদ্রষ্টা। মানব প্রেম, আবেগ, সত্য সুন্দরের সন্ধান কবিতায় ও চিত্রকলা শব্দের শিখর সন্ধানী আপন গৌরবোজ্জ্বল মহিমায়। কবিতায় আবহমান কাল ধরে চলমান বিশলতায় আনেন নতুন আপ্লুত সজীবতা। ছন্দে, বর্ণে ও গন্ধে সৃজনশীল পূর্ণতা মহাকালের সৃষ্টিশীল কাব্য ভান্ডারে। বহু বর্ণময় কাব্য রচনা দার্শনিক গাম্ভীরে উৎফুল্লতায় ভরা উৎসবে উদ্ভাসিত। সকল ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিলেন সর্বদাই সোচ্চার এবং শক্ত অবস্থান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তিনি সর্বাঙ্গে সর্বদায় ছিলেন সত্যবাদী, যা তিনি ধারন করে রাখতেন অন্তরের অন্তঃস্থলে। তিনি মানব জীবনের বর্ণময় বরেণ্য চিরসবুজের কবি। সামাজিক অভিজ্ঞতার নানা মননশীল উষ্ণতা ছিল তার চিন্তার ছোঁয়ায় এবং যা তার লেখনীতে তথা কাব্যে, গল্পে, ও গানে ফুটে উঠত নির্মল আলিঙ্গনে সীমাহীন গভীরতায়। পাখিদের বিচিত্র নানা বর্ণের পালকের মতো অপরূপ ছন্দে ভরপুর কাব্যের লিখন। মন হারিয়ে যায় দূর আকাশের নীলিমায়। প্রকৃতির নানা রূপময় সৌন্দর্যের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস ফুটে তার কাব্যে। ভাববাদী এবং সেইসাথে প্রকৃতবাদী মানব দরদী কবি জীবন পূর্ণিমাতে উজ্জল সাহিত্যে, উপন্যাসে এবং কবিতায়। কেবল জ্ঞানের সীমাবদ্ধ না থেকে বোধের শিক্ষায় মানুষের অতি কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার প্রবণতা। সামাজিক গুণের ভাব গাম্ভীর্যতা হৃদয় জুড়ে বর্ণে গন্ধে হাসনেহেনার মতো মাতাল করা জীবন ভুবনে। জীবন দর্শনে জীবনের অগ্রগতি প্রকৃতির অনুরাগের ডালিতে শত ফুলের মতো অপরূপ। ভরপুর চেতনার রং আলোময় নিদারুণ সৃষ্টি। পূর্ণিমার আলোর সাগরে ভেসে বেড়ায় হৃদয় জুড়ানো নির্মল অনুভূতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় অন্ধ গোরামির বিরুদ্ধে সর্বদাই ছিল সোচ্চার কবির কলম এবং সৃজনশীল সংস্কৃতির নিবিড় বন্ধন। বিশ্ব প্রকৃতির রূপের শোভা নির্মল আকাশ, বাতাস ও তারার রাজ্যে লেখনীর বিস্তৃত ক্যানভাস। কবি বন্দনায় দৃঢ়বদ্ধ বিশ্ব সত্তার সাথে। বাংলার অতীত এবং বর্তমান লোকসাহিত্যের ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্য মুগ্ধ কবি তার নান্দনিক ভাষায় বলেন “জনপদের হৃদয় কলবর”। মানুষ মানুষের ঐক্য বন্ধন ও সৌভ্রাতের সেতুবন্ধন। রবি ঠাকুরের ভাষায় যা ছিল “রূপসাগরে অরূপ রতন”। তিনি সর্বদা স্বদেশী বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নিজেকে শামিল করেছিলেন। জীবন চলার পথে মানব চিন্তার জীবন দর্শন যা বহে আনতো কবির জীবনে নির্ধারুণ সফলতা। চিত্রশিল্পী ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিক সহ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিশ্ব বরেণ্য কবি ছিলেন নিঃসন্দেহে কবিদের গুরু। খোলা মাঠে সবুজ গালিচায় গাছের পাতায় অনেক শীতল অনুভূতি তাতেই ছিলেন মুগ্ধ কবি। তারই লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ঊনিশ একুশ শতকে শান্তিনিকেতন। যার তিনটি উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে দ্বিতীয় আদর্শ প্রাকৃতিক ভাবধারায় শিশুদের বেড়ে ওঠা এবং সবশেষে পরিবর্তনশীলতার আবর্তে এই উপমহাদেশের শহর ও গ্রামের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করা। প্রাচীন সাহিত্যের দুরূহতা থেকে সরে এসে কাব্য রচনায় সহজ ও সরল পথ অনুসরণ করেন। কবির সমগ্র জীবনের সাহিত্যকর্মের ডাল-পালা সুউচ্চ বটবৃক্ষের মতো বিশাল শিকড় ছড়িয়ে রেখেছে এই সুজলা সুফলা শ্যামল বাংলার মাটিতে। প্রকৃতির বৃহৎ অঙ্গন কবিকে অভিভূত করে। আকাশের তারার সাথে মিশে আছে চেতনার উন্মেষ। সাহিত্যকর্মের বিচিত্র পথ চলার আত্মশক্তিতে মনোনিবেশ। সমকালীন সমাজের সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহ, অর্পিত দায়িত্ব এবং প্রথাবদ্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, এইভাবে কবি বাংলা সাহিত্যে এনেছেন নতুন প্রাণ। অভিনবত্ব কলাকৌশল, নিরন্তর জীবন তত্ত্ব এবং বিশ্ববোধের সেতুবন্ধন। ইতিহাস বিকাশে অর্পিত দায়িত্ব পালনে অবিচল এই মানবী কবি। সরল অনাড়ম্বর জীবনধারা কবির জীবনকে করেছে গভীর অর্থবহ এবং অভিজ্ঞতালব্ধ নতুন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মহান ব্যক্তিত্ব। তারই চেতনায় নিগূঢ় পরিবর্তন এবং দার্শনিক নির্লিপ্ততা। কবি আপন করে নিয়েছিলেন এই সমাজ ও ধরিত্রী। তাই একসময় মনের অজান্তে গেয়ে ছিলেন,
” মরিতে চাহিনা আমিই সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই”
মধুসূদন দত্তের পর বাংলা কবিতা রাজ্যে এক বিশাল ঝুড়ি নিয়ে ছন্দময় কাব্যে রবি ঠাকুরের পদার্পণ। তিনি ছন্দ গুরু তা ছিল সৃষ্টির অপূর্বতা এবং মাহাত্ম্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চোদ্দ ভাই বোনদের মধ্যে ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ভ্রমণ পিপাসু রবি ঠাকুর পারিবারিক গণ্ডি থেকে বের হয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার জন্য সর্বদাই থাকতেন উদগ্রীব। সময় পেলে গঙ্গায় সাঁতার কাটতেন এবং পাহাড়ি সবুজ ঘেরা রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো ছিল খুবই পছন্দনীয়। ডালহৌসির দুই হাজার তিনশ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বাংলায় বসে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতেন। সেই নয়নাভিরাম ও প্রাণ জুড়ানো বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি কবির মনে আবেগ উপলব্ধি ও কাব্য অনুভূতির জন্ম দেয়। ছবি ছিলেন একজন বৃক্ষ প্রেমী।গানে, কাব্যে ও সাহিত্যে তাই স্থান পেয়েছে অসংখ্য ফুল ও বৃক্ষের নাম। কবির ঝুলিতে আছে ৯৫ টি ছোট গল্প ৫২ টি কাব্যগ্রন্থ ৩৮টি নাটক ১৩ টি উপন্যাস ও ৩৬ টি প্রবন্ধ। গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান ১৯ টি খন্ডে। ছবি আঁকার প্রবল আগ্রহ ও প্রবণতা ছিল। এঁকেছেন প্রায় দুই হাজারের বেশি ছবি এর মধ্যে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে শোভা পাচ্ছে কবির ১৫৭৪ টি ছবি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কবিগুরুর মোট ৩১১ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯০৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ ইংরেজি অনুবাদের ফলে, এই উপমহাদেশে তথা এশিয়ায় সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন এই মহা বরেণ্য কবি। মনের উদারতায় উদ্ভাসিত, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক সমন্বয় ঘটানো, ইচ্ছে মত ঘুরে বেড়ানো শিশুদের সাথে সবুজ মাঠে এবং বিভিন্ন দার্শনিক ভাবধারার মিলনে মানব জীবনের এই কবি। রুপালি চাদরে ঢাকা সোনার বাংলায়। তিনিই বিশ্বময় বিশ্বকবি। স্বীকৃত নবজাগ্রত বাঙালি সমাজের অগ্রদূত বিশুদ্ধ সত্যের আত্মপ্রত্যয়।
লেখক মাহবুবুর রহমান সেলিম
সভাপতি “শিল্প চূড়া” সাহিত্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন
সভাপতি “মাদকমুক্ত চাঁদপুর গরি”
প্রধান নির্বাহী সম্পাদক “দৈনিকএকাত্তর কন্ঠ”।