৩ বছর ধরে উত্তম কুমারের অবৈধ দখলে মাতৃপীঠ স্কুলের পরিত্যক্ত বাসভবন

বাসভবন ছাড়তে চূড়ান্ত নোটিশ দিলেন জেলা প্রশাসক
: নিজস্ব প্রতিবেদক :
পরিত্যক্ত ঘোষণার ৩ বছর পরেও বাসভবন ছাড়ছেন না এক সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অপ্রিয় হলেও সত্য, উত্তম কুমার সাহা নামের এই প্রধান শিক্ষক যে স্কুলের পরিত্যক্ত বাসভবন ছাড়ছেন না, ওই স্কুল থেকে বিদায় নিয়ে অন্য একটি জেলার ঐতিহ্যবাহী সরকারি স্কুলে আড়াই বছর তিনি! সেখানে তিনি এবং তার পরিবার অবস্থান না করে আগের স্কুলের পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ ভবনটিতে কোনরকম বাড়িভাড়া ছাড়াই সবরকম প্যাসিলিটিজ পেয়ে দিব্বি বাস করছেন। অবৈধ ও সম্পুর্ন ঝুঁকির মধ্যে তিনি এবং তার পরিবারের এখানে বসবাস নিয়ে বিব্রত স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকসহ স্কুলের শিক্ষকরা। কখনো খোলেন না তার বাসভবনের প্রধান ফটক। যাওয়া আসা স্কুল গেট দিয়েই। জানা গেলো, এখানে থেকে আবার এই স্কুলে অথবা জেলার নামকরা স্কুলে আসার জন্য তদবির করছেন। একাধিকবার তাকে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানালেও তিনি তাঁর বাসভবন ত্যাগ করেননি। শেষ সোমবার অপরাহ্নে চুড়ান্ত বাসভবন ছাড়ার নোটিশ দিলেন জেলা প্রশাসক।
চাঁদপুর জেলা শহরের মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ২০০৯ সালে এই স্কুলে যোগদান করেন এবং যোগদানের সাথে সাথেই তিনি বিদ্যালয় সংলগ্ন প্রধান শিক্ষকের একতল বিশিষ্ট বাসভবনে স্বপরিবারে উঠেন। টানা ১০ বছর এই স্কুলে থাকা, এবং তার বিরুদ্ধে টিফিন, বেতন, অবৈধভাবে ভর্তি বাণিজ্য ইত্যাদি কারণে তাকে ২০১৯ সালে শিক্ষা অধিদপ্তর বদলি করে লক্ষ্মীপুর জেলার সরকারি সামাদ স্কুলে। কিন্তু সামাদ স্কুলে বদলী হলেও তিনি আগের জেলা চাঁদপুর মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বাসভবনটি আজও অবদি ছাড়েননি। যা জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর তিনি থাকতেই অর্থাৎ ২০১৮ সালেই বাসের অযোগ্য বলে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।
বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রাণকৃষ্ণ দেবনাথের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ২০১৮ সালে ২০ সেপ্টেম্বর স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি সাবেক জেলা প্রশাসক মাজেদুর রহমান খানের সভাপতিত্বে এক সভায় এটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং বসবাসের অযোগ্য ঘোষনা করে শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের প্রকৌশলী। শুধু তাই নয়, এটি ভাঙা, টেণ্ডার প্রক্রিয়া, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিসহ যাবতীয় কাজ দ্রুত সম্পাদনে সিদ্ধান্ত হয় সভায়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এই সিদ্ধান্তের পরও তিনি ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে চাঁদপুরে এই স্কুলে থাকা কালিন অবস্থাতেও পরিত্যক্ত বাড়ি ছড়েননি। ২০১৯ সালে তিনি বাড়ি ছাড়ছেন না এবং টেন্ডার প্রক্রিয়া করা যাচ্ছে না এমনটা স্কুল কর্তৃপক্ষ সভাপতি জেলা প্রশাসককে জানালে জেলা সাবেক জেলা প্রশাসক নিজে স্বশরীরে এসে তাকে বাসভবন ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে যান। কিন্তু তিনি সে সময়েও বাসভবন ছাড়েননি। বরং প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়া আর তদবীরে নিয়ে তিনি চাঁদপুরে স্বপদে ফিরে আসার জন্য চেষ্টা তদবীর চালিয়ে যান এবং যা এখনো অব্যহত রেখেছেন।
বাসভবন না ছাড়ার কারণে এটাকে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ফেলে ধ্বংস করা যাচ্ছে না যেমনি চরম একটা ভয়ের কারণও হয়ে দাঁড়ায় বর্তমান স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে। কারণ, ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষনা করায় এটি যে কোন মুহুর্তে ধ্বসে যাওয়ার আশংকা রয়েছে এবং প্রাণহানির মতো চরম দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
পরবর্তীতে বিষয়টি বর্তমান জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ গত এপ্রিল মাসে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা চান। নতুন জেলা প্রশাসক তথা স্কুল সভাপতির চিঠি পেয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লিখিতভাবে বিষয়টি অবহিত করেন সভাপতির কাছে। তারপর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৌখিক ভাবেও বাসভবনটি ছেড়ে দিতে তাকে বলা হয়। কিন্তু তিনি তা করেননি।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, তিনি আমার বস ছিলেন। ওনাকে আমি বহুবার বলেছি স্যার, আপনি বাসাটি ছেড়ে দিন। এটি পরিত্যক্ত, যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাছাড়া বাসাভাড়া না দিয়ে এরকমভাবে থাকাটাও অন্যায়। তিনি আমার কথা শুনেননি।
স্কুলের শিক্ষকরা জানালেন, এটিতে বরং তিনি পোক্ত করে বসে আছেন। একাধিক রুমে এসি চলে। এটি আরো ভয়ানক। তাছাড়া তার পানির বিল আমাদের স্কুল দেয়।
স্থানীয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান এবং জসীম উদ্দিন যারা এটিকে পরিত্যক্ত ঘোষনা করেছেন, তাদের সাথে আলাপ হলে তারা জানান, যে কোন ভবনই পরিত্যক্ত ঘোষনার পর সেটাতে থাকাই ঝ্ুঁকিপূর্ণ। আর এটি তো কোনভাবেই না। আর পরিত্যক্ত ভবনের গ্যাস লাইন, বিদ্যুৎ এগুলো বিচ্ছিন্ন করে দিতে হয়।
এ ব্যাপারে মাতৃপীঠ স্কুলের সভাপতি চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ জানান, সোমবার প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার যিনি তাতে পরিবার নিয়ে বাস করছেন, তাকে পরিত্যক্ত বাসভবনটি ছেড়ে দেয়ার চুড়ান্ত নোটিশ আমি দিয়েছি। তিনি বলেন, আগের নথি ঘেটে দেখলাম, তার বিরুদ্ধে আরো কিছু অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও আনা হয়েছে। এসব বিষয়সহ যা কিছু আছে তা আমি মাউশিকেও জানিয়ে চিঠি লিখিছি।
জানা গেলো, গত ২ আড়াই বছর তিনি যে নতুন স্কুলটিতে আছেন, সেই বাসভবনেও তিনি থাকেন না। অথচ প্রতিমাসেই বাড়িভাড়া তুলে নেন। এছাড়া গত দুই আড়াই বছরে তার নতুন সামাদ স্কুলে সপ্তাহে ১/২ দিন হাজির থাকতেন। তার স্ত্রী চাঁদপুর শহরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। প্রথেমে ছিলেন উত্তম কুমার সাহার পৈতৃক বাড়ি জেলার হাজিগঞ্জের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে তদবীর করে সম্পুর্ন অনিয়ম করে নিয়ে আসা হয় হাসান আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে এ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের মাঝে জানাজানি হয় এবং বিষয়টি সংবাদপত্রে এলে তাকে আবার তার স্ত্রীকে হাজিগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তদবীরে আনা হয় শহরে। এখনো তারা এই পরিত্যক্ত ভবনের ছাদের নীচে কোন রকম ভাতা না দিয়ে এবং স্কুলের চতুর্থ শ্রেনির কর্মচারীদের ব্যবহার করে ব্যবহার করে বহাল তবিয়তে।
এ বিষয়ে এই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার সাহা বলেন, আমি খুব তাড়াতাড়িই এটি ছেড়ে দিব। একজন শিক্ষক হয়ে এতোদিন বাসভবন দখলে রাখলেন কেন- এর কোন সদুত্তোর দিতে পারিনি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply