আমার ছোটবেলার স্মৃৃতি-বিজড়িত ঈদ

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন ::
মেঘনা-ধনাগোদা নদীর তীরে কোনো এক অজপাড়া গাঁয়ে ষাটের দশকে আমার জন্ম। প্রায় ষাট বছর পূর্বের কথা, তার আগের কথা আমার স্মৃতির খাতায় জমা হয় নাই। ঐ দিনগুলো আর আজকের দিনগুলোর মধ্যে বিস্তর ফারাক! সে যা হোক, আমাদের ছোটবেলার ঈদ-আনন্দ হতো সেই সময়কার গ্রামবাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে। আজ সেই কথাই বলতে চাই, যে কথাগুলো অবিরত স্মৃতিপটে ভেসে বেড়ায়। বছরে দুটো ঈদ অসীম আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করতাম, একটি হলো রোজার ঈদ, অপরটি কোরবানির ঈদ। কবে রোজা শুরু হবে এ বিষয়টি গ্রামবাংলায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, কারণ সবার বাড়িতে যে রেডিও বা দৈনিক পত্রিকা থাকত এমনটা নয়। তাছাড়া সে সময়ে রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ একরকম কঠিনই ছিল। চাঁদ দেখা বিষয়টি ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য দাদি, মা, চাচিদের কাছে থাকত এ বিষয়ে নির্ভুল হিসেব।
রোজার মাস ঈমানদারদের জন্য অসীম রহমত ও ফজিলতের মাস! এ মাসে ধনী-গরীব প্রায় সকলেই ঘরে ঘরে মিলাদ পড়ান এবং ইফতারের সময় আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানান যেন তাঁদের অতীতের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। রোজার মাসের শেষের দিকে ঘরে ঘরে ঈদ আসে খুশির বার্তা নিয়ে! পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব মিলে সবাই দু’এক দিনের জন্য হলেও নির্মল আনন্দে মেতে ওঠে। আমাদের কালে আমরা কিভাবে ঈদের খুশিতে ফেটে পড়তাম তা আজও মনে হলে সুখ পাই, পাই অনাবিল আনন্দ। রোজার মাসের শেষের দিকে শুরু হতো গুঞ্জন, এবার রোজা একটি কম হবে নাকি পুরু ৩০টি হবে, এটাই ছিল আলোচনার শীর্ষ শিরোনাম। সে যা হোক, শেষ রোজার দিন মাগরিবের নামাজের পরে মসজিদ থেকে বেরিয়েই পশ্চিম-আকাশের দিকে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে খুঁজতাম ঈদের এক ফালি বাঁকা চাঁদ। এক চিলতে চিকন চাঁদ এই দেখি তো এই নেই! মুহূর্তেই যেন মিলিয়ে যেত। ফের খুঁজে পেলে আঙুল ঘুরিয়ে চিৎকার করে অন্যদেরকে দেখাতাম। খুশিতে নাচতে নাচতে এক দৌড়ে চলে আসতাম বাড়িতে। ঘরে এসে মাকে বলতাম, আজ সবার আগে আমিই চাঁদ দেখেছি। কাল ঈদ! মা হেসে হেসে বলতেন, ‘তাই নাকি? তুমি যে চাঁদ দেখেছ তার সাক্ষী রেখেছ কাকে? আর চাঁদ দেখে থাকলে কাল থেকে নয়, খুশির ঈদ এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে।’ রমজান মাসের শেষ দিনে চাঁদ দেখার সাথে সাথেই ঈদ শুরু হয়ে যেত। স্মৃতির পাতা থেকে আমাদের ছোটবেলাকার ঈদের কিছু কথা, কিছু স্মৃৃতি, কিছু অনুভূতি এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়।
তখনকার দিনে আমাদের ঈদের প্রস্তুতি বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত। এ তোড়জোড় আরম্ভ হতো রোজার শেষ দিকে হাতে মেহেদি পরার মধ্য দিয়ে। যাই হোক, ফিরে আসি ঈদের দিনের কথায়। সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রান্নাঘরে নানা জাতের মিষ্টান্ন বানানো শুরু হয়ে যেত। আমরা বিছানায় যাওয়ার আগেই কিছু খেয়ে নিতাম। কিন্তু ঈদের খুশিতে আর উত্তেজনায় চোখে ঘুম আসতে চাইত না। ফজরের আজানের সাথেসাথেই উঠে যেতাম এবং নামাজ পড়ে সমবয়সী বন্ধুদের সাথে গোসল করতে বাড়ির সামনে পুকুরে চলে যেতাম এবং গোসল সেরে জামাকাপড় পরে নিতাম। কাপড়গুলো আগেই ধুয়ে, শুকিয়ে, ভাঁজ করে অন্তত তিন-চার দিন বালিশের নিচে রাখতাম। তখন বাড়িতে লোহার ইস্ত্রি এসেছে কিনা সঠিক মনে নেই, এলেও ওটা ছোঁয়া আমাদের এখতিয়ারের বাইরেই ছিল। ঈদের দিন নতুন জামা-কাপড় পরার কথা জানতাম, তবে আমাদের ভাগ্যে তা খুব একটা জুটত না! এতে মোটেও খারাপ লাগত না, বলতে গেলে বাড়ির এবং গ্রামের সব ছেলেমেয়ের অবস্থাই ছিল একইরকম। আজ একা একা যখন সেই সব ঘটনা স্মৃতিচারণ করি তখন মনে মনে হাসি এবং এই প্রজম্মের শিশুদের সঙ্গে সেই সময়কার শিশুদের তুলনা করার চেষ্টা করি।
পূর্ব-আকাশে আলো ফোটার সাথে সাথে আমরা ছেলেরা দল বেঁধে বাড়ির মুরব্বিদের যাকে যেখানে পেতাম পা ছুঁয়ে সালাম করতাম। বাবা-মা, চাচা-চাচীদের পর সবশেষে যেতাম দাদীর ঘরে। দাদী বসে থাকতেন মিষ্টি দ্রব্যের ভাণ্ড হাতে নিয়ে। সালাম করার পর দাদী আদর করে সবার হাতে তুলে দিতেন মিষ্টি জাতীয় খাবার। খেতে খেতে নেচে নেচে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম। তারপর গ্রামের এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াতাম। মুরব্বিদের পায়ে ধরে সালাম করতাম, আর আমাদের বিভিন্ন জাতের পিঠা-সেমাই-শিন্নি খেতে দেয়া হতো। দু’এক ঘর খাওয়ার পরেই পেট ভরে যেত। সালাম করে খুশি মনেই চলে আসতাম। তবে কদাচিৎ কেউ সালামি হিসেবে দু’একটি কয়েন হাতে দিলে মনে হতো যেন সাত রাজার ধন পেয়ে গেছি!
ঈদের দিন সকালবেলায় বাড়ির সামনে কাছারি ঘরের উঠানে লাইন ধরে ফকির মিসকিনরা দাঁড়িয়ে থাকত ফেত্রা নেয়ার জন্য। ওরা চলে গেলে আমি আব্বার আশে পাশে ঘুর ঘুর করতাম। ভাবতাম, একটা সিকি বা আধুলি তো আমাকেও দিতে পারতেন, কিন্তু দিলেন না কেন? বাবা যে ফেত্রার পয়সা আমাকে দিতে পারেন না, সেটা তখন জানলে ওনার ওপর আমার এত অভিমান হতো না। তারপর সবার সাথে নামাজ পড়তে ঈদগাহ-মাঠে যেতাম। ঈদগাহের আশেপাশে দেখতে পেতাম সাদা টুপি মাথায় শুধু মানুষ আর মানুষ। গ্রামের ধনী-গরিব, ছোট-বড় সকলেই বছরে অন্তত দু’বার বিভিন্ন জায়গা থেকে ভালবাসার টানে একজায়গায় নামাজ পড়তে আসত, পরষ্পর আলিঙ্গন করে মতবিনিময় করে আনন্দ পেত। কিছু ফেরিওয়ালা হাওয়াই মিঠাই, বেলুন-বাঁশি, লেমনচুষ ইত্যাদি বিক্রি করত। নিজের পকেটে পয়সা থাকলে কিছু কিনতাম, না থাকলে মন খারাপ করে বাড়ি চলে আসতাম।
রোজার ঈদ হলে বাড়িতে মুরগি জবাই হতো তার সঙ্গে থাকত সেমাই, ফিন্নি, পোলাও, জর্দা ইত্যাদি। কুরবানির ঈদের সময় দেখতে পেতাম এক দল লোক এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে, তাদের খালি পা, গায়ে ছেঁড়াকাপড়, মাথায় গামছাবাঁধা, হাতে কাপড়ে পেঁচানো ছুরি-দা ইত্যাদি। কোরবানির ঈদে কেউবা গরু আবার কেউবা ছাগল কোরবানি দিত এবং এগুলো জবাই হতো বাড়ির উঠানে বা কাছারি ঘরের সামনের মাঠে। বাড়ির বাইরের ঘরের সামনে একদিকে চলত গোশ্ত কাটাকাটি আরেক দিকে চলত ঈদগাহ কমিটির মিটিং। উপস্থিত থাকতেন পুরো গ্রামের সব মাতব্বররা। নামাজের পরে ঈদগাহ থেকে যে চাঁদা তোলা হতো, তা এ মিটিংয়ে গোনাগুনি হতো। গোনাগুনির পর টাকাগুলো ঈদগাহের ঈমাম ও সহকারী ঈমামকে বণ্টন করে দেয়া হতো এবং কিছু টাকা ঈদগাহ উন্নয়নের জন্য রাখা হতো।
কোরবানি দেয়ার গরু কেনাসে এক মহা বিড়ম্বনার ব্যাপার। ঈদের কয়েকদিন আগেই গরু কেনার মহড়া চলত। মুল্য যাচাইয়ের জন্য কয়েকদিন এ বাজার না হয় ও বাজারে গিয়ে দেখা হতো। হরহামেশাই কোরবানির গরু কিনতে বড়দের সঙ্গে বাজারে গিয়েছি। বাজার থেকে গরু নিয়ে আসার সময় কতই না বিড়ম্বনা সয়েছি তা বিস্তারিত লিখলে কয়েক পৃষ্ঠা কাগজ লেগে যাবে। আমি যাই তো একপথে গরু যায় অন্য পথে, আবার বিনা দোষেই পথচারীকে শিং দিয়ে আঘাত করা ইত্যাদি ইত্যাদি। গরুকে বাড়িতে এনে গোসল করিয়ে পরিষ্কার করে ভাল খাবার দেয়া হতো। হাদিসে আছে আদরের জন্তুকে কোরবানি দিলে বেশি সোয়াব পাওয়া যায়, তাই…। আবার গরু জবাই করতে গিয়ে শিংয়ের গুঁতো এবং পায়ের লাথি…। গরু জবাই ও মাংস কাটাকাটি শেষ করা নিয়েও ছিল প্রতিযোগিতা, তাই ঈদগাহ থেকে ফেরত এসেই গরু জবাইয়ের প্রস্তুতি চলত। কিন্তু গরুও পালিয়ে বাঁচার চেষ্টায় পিছিয়ে থাকত না। একবার আমাদের কোরবানির গরু জবাইকালে পায়ের ও গলার ফসকা গিরো খুলে এগ্রাম তো ওগ্রাম পালিয়ে পূর্বের মালিককে মনে হয় খুজে বেড়িয়েছে এবং অনেককে আহত করেছে। অবশেষে শেষ বিকেলে আমরা ক্লান্ত শরীর নিয়ে কোরবানি শেষ করেছি। সেই দিনের প্রতিযোগিতায় আমরা পিছয়ে ছিলাম। পরবর্তিতে আর এমনটা হতে দেইনি, সতর্ক ছিলাম। আশা করি এ ব্যাপারে আপনারাও সর্তক আছেন !
ঈদের দিনে ইচ্ছেমতো পেট ভরে গোশ্ত খেতাম। বিকেলবেলা বা পরদিন ফুফু বা খালার বা মামার বাড়ি বেড়াতে যাওয়া ছিল ঈদ উদ্যাপনেরই অংশ। আমাদের বাড়িতে কোরবানির ঈদের দু’টো বিশেষত্ব ছিল। প্রথমটি হলো, যাঁদের নামে পশু কোরবানি করা হতো তাঁরা কোরবানি শেষ না পর্যন্ত কিছু খেতেন না। এ রকম নিয়ম ইসলামে আছে কিনা তা আমার জানা নেই। দ্বিতীয়টি হলো, আমার দাদী কোরবানির গোশ্ত শুকিয়ে প্রায় এক মাস ধরে সংরক্ষণ করে রাখতে পারতেন। সে যুগে রেফ্রিজারেশনের কথা গ্রামের লোকেরা কল্পনাও করতে পারেনি। দাদী আরেকটি কাজ করতেন, তা হলো ওই গোশ্ত দিয়ে একেক দিন একেক আত্মীয়কে দাওয়াত করে খাওয়াতেন। ছোটবড়, ছেলেমেয়ে, জোয়ান-বুড়ো সবার মিলনমেলা বস্ত বাড়ির আঙিনায়। হারিকেন জ্বালিয়ে আলো-আঁধারির মাঝে আমরা সবাই একসাথে ভাগ-যোগ করে খাবারগুলো খেতাম। কোনো কোনো সময় অন্ধকারের মধ্যে খাবারের প্লেটে যে পোকা-মাকড় পড়ত না তাও নয়। আর পড়লেই বা কী ? এত কিছু দেখে খাওয়ার সময় কোথায়? খাওয়া শেষ হলে পুকুরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসতাম। ঘরের এক কোণে মাটির কলসিতে ফিটকিরি দিয়ে পুকুরের পানি রাখা হতো, যা মগ দিয়ে ঢেলে খেয়ে নিতাম। তখনকার দিনে টিউবওয়েল বসানো বাড়ির সংখ্যা গ্রামে খুবই কম ছিল। আজকাল দেশে-বিদেশে নামি-দামি হোটেল, মোটেল ও কমিউনিটি সেন্টারে খাওয়া-দাওয়া হয়, কিন্তু ছোটবেলাকার সেই আনন্দ কোথাও খুঁজে পাই না।
সারা দিন হৈচৈ করে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও শুতে যেতে চাইতাম না। মনে হতো ঘুমাতে গেলেই তো আনন্দ হাতছাড়া হয়ে যাবে। অবশেষে অবসন্ন শরীর নিয়ে বিছানায় শুলেই ঘুমিয়ে পড়তাম। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে আগামী ঈদের স্বপ্ন দেখতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠলে দিন গুনতে শুরু করতাম কবে আবার আসবে খুশির ঈদ! আজও দিন গুনি আবার কবে আসবে ঈদ, খুশির ঈদ! তবে সেদিনের সাথে আজকের একটা পার্থক্য আছে। একটা জিনিস নিশ্চিত জানি, জীবনে যত ঈদই আসুক, ছোটবেলার সেই ঈদ আর আসবে না! সেই আনন্দও আর ফিরে পাব না! শৈশবের সাথে চির দিনের মতো হারিয়েছি সেই আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ফিরে পাব না সেই সময়, ফিরে পাব না সেই ঈদ, ফিরে পাব না সেই হাসি-খুশি আর কোলাহল!
দেশের পরিস্থিতি এখন যে দিকে যাচ্ছে তাতে মনে হয়, ছোটবেলার মধুর স্মৃতিকথা বিসর্জন দিতে হবে, সেদিন বুঝি আর বেশি দূরে নয়! এখন বাংলদেশের মানুষ আর গরিব নয়। সেখানে এখন অনেক লোক আছেন যারা প্রতিদিনই ঈদ করে থাকেন। এমন অনেক মানুষ আছেন যারা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে ঈদ করতে চান না! তারা ঈদ এলে ছেলেমেয়ে নিয়ে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর চলে যান, এমনকি ইউরোপ-আমেরিকাতে। যে দিন বাংলাদেশের সব মানুষ সব দিনই ঈদ করবে, সে দিন কি আমার ছেলেবেলার সেই ঈদ, সেই স্মৃতি, সেই আনন্দ থাকবে? নাকি উন্নয়নের হাওয়ায় হারিয়ে যাবে?
লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, পরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

শেয়ার করুন

Leave a Reply