চাঁদপুরে করোনার এক মাস

আক্রান্ত হয়েছেন ৯ পুলিশ সদস্য, ইউএনও, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ইউপি সচিব, সাধারণ মানুষ

‘মানুষ যদি মাস্ক পড়ে এবং ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখে তাহলে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকবে না’

ইব্রাহীম রনি :
করোনায় আক্রান্ত চাঁদপুর এক মাস পার করেছে গতকাল ৯ মে। ৯ এপ্রিল থেকে গত এক মাসে জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬ জন। এর মধ্যে মৃত ৪ জন, সুস্থ হয়েছেন ১১ জন। বাকীরা হাসপাতাল ও নিজ নিজ বাসা-বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছেন একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ৫ জন এসআই ও ৪ জন কনস্টেবলসহ ৯ জন পুলিশ সদস্য, একজন ডাক্তার, একজন নার্স, ৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। বাকীরা বিভিন্ন পেশার জনসাধারণ।
জেলায় করোনা আক্রান্ত শুরু হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে মতলব উত্তরে আসা এক যুবকের রিপোর্ট পজেটিভ আসার মধ্য দিয়ে। এরপর ওই উপজেলায় এক ডাক্তারসহ আরও ২ জন করোনা আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে জেলার ৭টি উপজেলা করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এখনো করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি মতলব দক্ষিণ উপজেলায়। তবে সদর উপজেলা এবং ফরিদগঞ্জ উপজেলায় করোনাভাইরাস কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে বলে গত ৬ এপ্রিল জানান সিভিল সার্জন। এর ফলে সদরে প্রতিদিই বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন সদর উপজেলায়। এ উপজেলায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ জন। আর ফরিদগঞ্জে ৬ জন, মতলব উত্তরে ৫ জন, হাজীগঞ্জে ৪ জন, কচুয়ায় ২ জন, হাইমচরে ২ জন, শাহরাস্তিতে ২ জন করোনা পজেটিভ রিপোর্ট এসেছে।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত এক মাসে জেলা থেকে পাঠানো ৬৯২ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৪৬ জনের রিপোর্ট পজেটিভ আসে। আর নেগেটিভ আসে ৬৪৮ জনের। এছাড়া ঢাকায় করোনা পজেটিভ হওয়ার পর চাঁদপুর এসেছেন ৩ জন। আক্রান্তদের মধ্যে গতকাল ৯ মে পর্যন্ত মৃত ৪ জন, সুস্থ হয়েছেন ১১ জন। বাকীরা হাসপাতাল ও নিজ নিজ বাসা-বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত আইসোলেশনে রোগী ভর্তি হয়েছেন ৪৩ জন। এদের মধ্যে এখনো ১১ জন আইসোলেশনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে ৩ হাজার ৬২৪ জনকে। এদের মধ্যে হোম কোয়ারেন্টাইন থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৩ হাজার ৪৩৮ জন। বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন ১৮৬ জন।

এদিকে করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসার কিছু সময় আগেই বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়ে জেলাকে লকডাউন করার ঘোষণা দেন জেলা প্রশাসক মো. মাজেদুর রহমান খান। এরপর থেকেই সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরতে কঠোর অবস্থানে যায় সেনাবাহিনী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওষুধের দোকান ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকান ছাড়া বন্ধ করে দেয়া হয় অন্য সব মার্কেট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। করোনা সংক্রমণ রোধে জেলাজুড়ে পরিচালিত বহু মোবাইল কোর্ট। লকডাউনের কারণে সন্ধ্যার পরই সুনশান নীরবতা নেমে আসে ব্যস্ততম শহরে। তবে প্রথম বেশ কিছু দিন শহরে যানবাহন ও জনসমাগম একেবারেই কম দেখা গেলেও ধীরে ধীরে তা বেড়েই চলেছে। এতে করে সচেতনদের মাঝে বেড়েছে আতংক।
সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সাজেদা পলিন, গত ১২ এপ্রিল সদরে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। এরপর মাঝে মধ্যে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলেও গত এক সপ্তাহে রোগী শনাক্তের হার বেড়ে গেছে। ইতিমধ্যেই অনেকেই সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া আমরা কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করছি। যারা আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছেন তাদেরকে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দিচ্ছি।
তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে পৌরসভা আছে। এ কারণে আমাদের এরিয়াটাও বড়। যেহেতু আমাদের এখানে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে- তাই এখানে আমাদের আরও কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, এখানে দেখা যাচ্ছে- যেখানে রোগী ষনাক্ত হচ্ছে সেখানেই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সব জায়গায় নয়।
চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি এখনো খুব একটা খারাপ বলা যায় না এখনো। পুলিশ সদস্যরা আক্রান্ত হওয়ায় একটু বেশি হয়ে গেছে। ওনারাতো সবাই একত্রে থাকে-তাই হয়তো। এছাড়া উপজেলাগুলোতে দুজন-একজন করে হলে তাকে বেশি বলা যায় না। এখনো আমরা মনে করি আয়ত্বের মধ্যে আছে।
তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যদি আর আক্রান্ত না হয় তাহলে হয়তো সদরে খুব একটা বাড়বে না। সামনের রিপোর্টগুলো আসলে বুঝা যাবে।
তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা ব্যারাকে থাকেন একসাথে। ইতিমধ্যেই তারা দু’একটা হোটেল নিয়েছে পুলিশ সদস্যদের কোয়ারেন্টাইন করার জন্য। তারা যদি কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করে তাহলে পুলিশের মধ্যে আক্রান্তের হার কমে যাবে।
তিনি বলেন, মানুষ যদি মাস্ক পড়ে এবং ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখে তাহলে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকবে না।
তিনি বলেন, দোকানপাট খুললে মানুষ বের হয়ে যাবে নানা অজুহাতে। ঈদ পর্যন্ত যদি দোকানপাট বন্ধ রাখা যায় তাহলে সবার জন্য অনেকটা সেফ হবে।

চাঁদপুরে দুর্যোগকালে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্রের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে সেবাবাহিনী।

এদিকে স্থানীয়রা জানান, সারাদেশের ন্যায় চাঁদপুরে দীর্ঘ সময় লকডাউন চলার কারণে শ্রমজীবী, বিভিন্ন মার্কেট-দোকানপাটে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, নি¤œ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ বিভিন্ন শ্রেনি-পেশার মানুষ পড়েছেন আর্থিক সংকটে। যদিও এ সময়ে জেলা প্রশাসন, সেনাবাহীনি, পুলিশ বিভাগ, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভার মাধ্যমে চাল-ডালসহ বিভিন্ন নিত্যপন্যের সমন্বয়ে উপহার তথা ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া এ দুর্যোগকালে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন বিভিন্ন রাজনীতিবীদ, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সমাজসেবকসহ সামর্থবান মানুষজন। তবে এসব সবার ঘরে যায়নি। যারা চেয়েছেন তারাই পেয়েছেন।

সামাজিক দূরত্ব না মানা এবং দোকান খোলায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়।

অন্যদিকে গত এক মাসে সামাজিক দূরত্ব না মানা, দোকান খোলা রাখা এবং লকডাউনের মধ্যে রাস্তায় যানবাহন বের করার দায়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে। এসব মোবাইল কোর্টে অনেককে করা হয়েছে জরিমানা। দীর্ঘ দিন মার্কেট-দোকানপাট বন্ধ থাকার পর ঈদকে সামনে রেখে তা খোলার সম্ভাবনা দেখা দিলেও করোনা প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় মার্কেট, দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসক।

শেয়ার করুন

Leave a Reply